
৫ই আগস্ট শুধুমাত্র ঘটনাবহুল একটি দিন নয়-এটি ছিল এক অভূতপূর্ব গণপ্রতিরোধ। যেখানে জনতার ক্রোধ, বেদনা ও নৈতিক জাগরণ একত্রিত হয়ে ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে বিস্ফোরিত হয়েছিল। অথচ
অন্তর্বর্তী সরকার সেটিকে “জুলাই গণ-অভ্যুত্থান দিবস” নামে এক শীতল, কাঠামোগত রাষ্ট্রীয় অনুশোচনার মুখোশে ঢেকে দিতে চাইছে, কোথাও রক্তাক্ত ফ্যাসিবাদ শব্দটি নেই-যেন এটি একটি ভুল বোঝাবুঝির ফল, একটি অনাকাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক বিচ্যুতি, অতীতের দুর্ঘটনা কিংবা ভুলে যাওয়ার মতো একটি অধ্যায়।
অথচ ‘Anti-Fascist Day’ শব্দবন্ধটি একটি নৈতিক স্পষ্টতা এনে দেয়-এখানে কারা অন্যায় করেছে, কারা প্রতিরোধ করেছে এবং কোন আদর্শকে প্রত্যাখ্যান করেছে একটি জাতি। তাই ৫ই আগস্টকে শুধু “গণ-অভ্যুত্থান দিবস” বললে এ আন্দোলনের নৈতিক ও ঐতিহাসিক গভীরতা অস্বীকার করা হয়। এই দিনটিকে Anti-Fascist Day ঘোষণা করতে হবে-যাতে তা শুধুমাত্র একটি আন্দোলনের স্মারক নয়, বরং এক চিরকালীন নাগরিক অঙ্গীকারের দিন হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়।
ফ্যাসিবাদ শব্দটি উচ্চারণ না করা সরকারের বিপজ্জনক নীরবতা:
“ফ্যাসিবাদ”, “গণহত্যা”, “রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস”-এই শব্দগুলো উচ্চারণ না করলেই যেন ইতিহাস একটু নিরাপদ থাকে, অথচ বাস্তবতা আরও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। জুলাই-আগস্ট ২০২৪-এর ঘটনাপ্রবাহ কোনো সাধারণ সংঘর্ষ নয়; এটি ছিল এক গণতান্ত্রিক অভ্যুত্থান, যা সরাসরি ফ্যাসিবাদী নিপীড়ন-ব্যবস্থার বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছিল। এই আন্দোলনের স্মরণে যদি “ফ্যাসিবাদ” শব্দটি অনুপস্থিত থাকে, তাহলে তা হবে ইতিহাসের সঙ্গে প্রতারণা। কারণ, ফ্যাসিবাদকে চিহ্নিত না করলে, তাকে প্রতিরোধও করা যায় না। ৫ই আগস্ট সেই দিন-যেদিন এক ভয়ঙ্কর অধ্যায়ের অবসান ঘটে; একটি নিষ্ঠুর শাসনের পর্দা নামে।
এই শাসন ছিল শুধু গণতন্ত্র ধ্বংসের নয়-মানবতার বিরুদ্ধে সংঘটিত এক দীর্ঘস্থায়ী অপরাধ। যেখানে রাষ্ট্র নিজেই পরিণত হয়েছিল আতঙ্ক, নির্যাতন ও মৃত্যুর কারখানায়।
গুম, খুন, নিপীড়ন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, পুলিশি দমন, গ্রেপ্তার-নির্যাতন-এই সময়ে রাষ্ট্র ছিল এক দৈনিক নরকযাত্রা।
শিশুর কাঁধে লাশ, মায়ের মুখে আহাজারি, ছাত্রের বুকে গুলি-এসব ছিল প্রতিদিনের বাস্তবতা। ৫ই আগস্ট তাই শুধুই রাজনৈতিক পরিবর্তন নয়-এটি ছিল এক নৃশংসতার অবসান এবং এক মানবিক সম্ভাবনার নতুন সূচনা।
কেন আমরা ফ্যাসিবাদ প্রত্যাখ্যান করি: আমরা ফ্যাসিবাদকে প্রত্যাখ্যান করি কারণ, এটি মানুষের চিন্তা, বিবেক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে ধ্বংস করে। ফ্যাসিবাদে জনগণ আর নাগরিক থাকে না-পরিণত হয় প্রজায়, যারা কেবল ভয় আর প্রপাগান্ডার মধ্যে বেঁচে থাকে।
আমরা প্রত্যাখ্যান করি কারণ, এটি ব্যক্তির মর্যাদাকে অস্বীকার করে, মানুষকে সংখ্যায় পরিণত করে, নাগরিককে পরিণত করে রাষ্ট্রযন্ত্রের নিঃস্ব একটি যন্ত্রাংশে।
আমরা বিশ্বাস করি-
রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য ভয় তৈরির জন্য নয়, বরং ভরসা দেয়ার জন্য।
রাষ্ট্রের কাজ নীরবতা চাপানো নয়, বরং সত্য প্রকাশের পথ উন্মুক্ত করা।
ফ্যাসিবাদ একটি রাজনৈতিক কৌশল নয়-এটি এক নৈতিক বিপর্যয়, যা সত্য, ন্যায়, ও মানবিক মর্যাদাকে চূর্ণ করে। ফ্যাসিবাদে রাষ্ট্র হয় ব্যক্তির দাস; ক্ষমতা হয় সত্যের বিকল্প, আর ভয় হয় শাসনের একমাত্র হাতিয়ার।
হাসিনার শাসন ছিল এক দীর্ঘস্থায়ী ফ্যাসিবাদী প্রকল্প, যা ধাপে ধাপে জনগণকে অধিকার থেকে নিঃস্ব করেছে, নিঃশব্দ করেছে প্রতিবাদে এবং নিষ্ক্রিয় করেছে রাজনৈতিক ও নৈতিক সচেতনতায়।
ফ্যাসিবাদবিরোধী দিবসের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দাবি:
৫ই আগস্টের Anti-Fascist প্রতিরোধ কেবল জাতীয় নয়-এটি ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্তর্জাতিকতারই অংশ, যা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দাবি করে ‘Anti-Fascist Day’ হিসেবে।
বিশ্ব জুড়ে, বিশেষ করে ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকায়, Anti-Fascist Day কেবল অতীত স্মরণ নয়, ভবিষ্যতের প্রতিজ্ঞাও। বাংলাদেশের ৫ই আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান সেই আন্তর্জাতিক ঐতিহ্যেরই অংশ।
১৯৭১ সালে আমরা পাকিস্তানি দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিলাম,
২০২৪ সালে জনগণ রুখে দাঁড়িয়েছে রাষ্ট্রীয় ফ্যাসিবাদ, বিচারহীনতা, সামরিক-প্রশাসনিক স্বৈরতন্ত্র ও পুলিশি গুলিবর্ষণের বিরুদ্ধে।
এই আন্দোলন তাই আন্তর্জাতিক ন্যায় ও গণতান্ত্রিক মুক্তির একটি অধ্যায়- ৫ই আগস্ট তার প্রতীক।
জুলাই অভ্যুত্থান ও ৫ই আগস্টের ঐতিহাসিক সূত্র: জুলাই অভ্যুত্থান ছিল এক অগ্নিগর্ভ গণপ্রতিরোধ। যেখানে ছাত্র, নারী, যুবক, শ্রমজীবী, লেখক, বুদ্ধিজীবী সকলেই একটি সত্য ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রের স্বপ্নে এক হয়েছিলেন।
তারা নিরস্ত্র ছিলেন, কিন্তু ভয়হীন।
সশস্ত্র রাষ্ট্র যখন দমনযন্ত্র চালায়, রাজপথ তখন রক্তে রঞ্জিত হয়। আর তারই জবাবে ফেটে পড়ে জনতার ঘোষণা- ‘দেশটা কারও পৈতৃক সম্পত্তি নয়!’ এটি ছিল শাসকের বিরুদ্ধে জনতার এক সর্বাত্মক নৈতিক প্রত্যাখ্যান।
৫ই আগস্ট সেই অভ্যুত্থানের প্রথম প্রভাত-যে দিন জনগণ স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেয়,
রাষ্ট্রের মালিকানা পৈতৃক নয়-এটি জনতার, সংগ্রামী মানুষের, প্রতিরোধকারীদের।
কেন ৫ই আগস্টকে Anti-Fascist Day ঘোষণা জরুরি:
১. ইতিহাসকে নৈতিকভাবে স্মরণ করা মানে কেবল অতীত জানা নয়-এটি নাগরিকের কর্তব্য। হানা আরেন্টের কথায়- “ফ্যাসিবাদ তখনই জয়ী হয়, যখন জনগণকে ভুলে যায়।”
২. ৫ই আগস্টকে স্বীকৃতি দেয়া হবে এক নৈতিক স্বীকারোক্তি-এটি প্রমাণ করবে যে, জনগণের প্রতিরোধ ছিল নিপীড়নের বিরুদ্ধে বৈধ অধিকার ও দায়িত্ব।
৩. রাষ্ট্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দিনটি পালন করা- নাগরিকদের জন্য হবে এক নৈতিক পাঠ, গণতন্ত্র কোনো দান নয়, এটি রক্তমাখা সংগ্রামের ফল।
৫ই আগস্ট Anti-Fascist Day দিবস: প্রতিরোধ ও প্রত্যয়ের রূপরেখা:
গণোৎসব ও শ্রদ্ধা:
এই দিনটি হবে গণতন্ত্র ও নৈতিকতার প্রতীকী উদ্যাপন। গুলিবিদ্ধ শহীদদের স্মরণে স্থায়ী শ্রদ্ধাঞ্জলি।
রাজপথে প্রতিধ্বনি:
গণ-বক্তৃতা ও মশাল মিছিলের মাধ্যমে রাজপথে প্রতিধ্বনিত হবে ন্যায় ও স্বাধীনতার শপথ।
সাংস্কৃতিক জাগরণ:
নাটক, কবিতা, গান ও চিত্রকলায় রচিত হবে ফ্যাসিবাদবিরোধী সৃজনশীল প্রতিরোধ।
নৈতিক অঙ্গীকারপত্র পাঠ:
৫ই আগস্ট Anti-Fascist Day-তে জনগণের সামনে পাঠ করা হবে Anti-Fascist নৈতিক অঙ্গীকারপত্র-
“ফ্যাসিবাদ প্রতিহত করবো, গণতন্ত্র রক্ষা করবো।” এটি হবে এক নৈতিক প্রতিজ্ঞা। যেখানে আমরা স্বাধীনতা, ন্যায় ও মানবিকমর্যাদার পক্ষে অবস্থান নেবো।
ফ্যাসিবাদবিরোধী প্রতিরোধকে রূপ দেবো গণতান্ত্রিক নাগরিক চেতনার এক অভিন্ন নৈতিক সংবিধানে।
আমাদের দাবি:
৫ই আগস্টকে রাষ্ট্রীয়ভাবে Anti-Fascist Day হিসেবে ঘোষণা করতে হবে। যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানে ও বুঝতে পারে-এই মাটিতে ফ্যাসিবাদের কোনো স্থান নেই।