Image description
ড. মো: মাহবুবুল আলম

 

জুলাই’ ২৪ গণঅভ্যুত্থানের এক মাস পূর্তিতে প্রথম সারির জাতীয় দৈনিকে একটি লেখা লিখেছিলাম। শিরোনাম ছিল- ‘অন্তবর্তী সরকারকে ব্যর্থ হতে দেয়া যাবে না।’ দিনটি ছিল ৫ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪।  আমার ধারণা তখনকার প্রেক্ষিতে আমার শিরোনামটি খুব বেশি অস্বাভাবিক ছিল না। বরং বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক সকল মানুষের কণ্ঠে একই ধ্বনি উচ্চারিত হয়েছিলো। দুই-তিনদিনের মধ্যে এদেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও তার বক্তব্যে একই অভিমত ব্যক্ত করেন। এই দেশের পুনর্গঠনের জন্য অর্ন্তবর্তী সরকারের সফল হওয়ার খুব বেশি প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে সকলের মাঝে শঙ্কা, ‘বাংলাদেশ কি আরেকটা সুবর্ণ সুযোগ হারালো’? 

 

কোটা থেকে শুরু হয়ে যখন আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিলো, মতপথ ভুলে সকল রাজনৈতিক-সামাজিক ব্যক্তি-গোষ্ঠীর আকাঙ্ক্ষা এক বিন্দুতে মিলে গেলো, ধর্ম-বর্ণ-বয়স-পেশা ব্যতিরেকে সবাই রাজপথে নেমে আসলো এক দলীয় শাসনের অবিচারের বিরুদ্ধে, তখন ফ্যাসিস্টদের জন্য আর জায়গা থাকলো না। অন্যায়-সন্ত্রাস-দুর্নীতি আর অপশাসনের বিরুদ্ধে সবার সমস্বরে প্রতিবাদ ও আন্দোলন স্বাভাবিকভাবে  ব্যক্তি-গোষ্ঠী স্বার্থের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়নি, যা হয়েছে গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে। 

সবচেয়ে বড় চমকটা এসেছে ছাত্র প্রতিনিধিদের সরকারের অংশ হয়ে আসাটা। যদিও তাদের সবচেয়ে বড় নেতা নাহিদ ইসলাম নৈতিকভাবে সরকার থেকে পদত্যাগ করে রাজনৈতিক দল গঠনে উদ্যোগী হয়েছেন, কিন্তু ততক্ষণে ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে। 

 

প্রধান উপদেষ্টার ছাত্রদের তার নিয়োগকর্তা হিসেবে অতি-আবেগী সম্বোধন, প্রশাসক হিসেবে তার নেতৃত্বের জায়গাটা দুর্বল করে দিয়েছে। আনসার বিদ্রোহ, ছাত্র-কর্তৃক বিচারালয় ঘেরাও, গণঅভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসায় অবহেলা ও তাদের আন্দোলন সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করতে না পারার ব্যর্থতা, শাসক হিসেবে তার দূরদৃষ্টির অভাবকে প্রতীয়মান করে। 

প্রধান উপদেষ্টা কিছু উদ্দীপনা তৈরির চেষ্টা করেছেন। বিদেশ থেকে কিছু করিৎকর্মা বাংলাদেশিদের দেশে ফেরত এনেছেন, বড় বড় দায়িত্ব দিয়েছেন। যারা তাদের মতো করে কাজ করে অভ্যস্ত ও সফল কিন্তু বাংলাদেশে ব্যর্থ হয়েছেন বা হচ্ছেন। একটি উদাহরণ হলো বিনিয়োগ সম্মেলন। এ দেশকে বিশ্ববাসীর কাছে চমৎকারভাবে উপস্থাপনা বাহবা দাবি করে, কিন্তু প্রক্রিয়া ঠিক না করে শুধু ভালো উপস্থাপনা বিনিয়োগ পেতে যে যথেষ্ট নয়, তা আবারো প্রমাণিত। 

 

আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের লন্ডভণ্ড অর্থনৈতিক নীতি আর কোন দেশের জন্য কতো সমস্যার কারণ হলো তা জানা নেই, কিন্তু বাংলাদেশের জন্য যে এটি বড় রকমের সমস্যা ও দুর্যোগ নিয়ে উপস্থিত হয়েছে সেটা অনস্বীকার্য।  ব্যাংকিংখাতে স্থিতি আনয়ন এবং দ্রব্যমূল্য মোটামুটি সহনশীল রাখতে পারলেও, বাণিজ্য ঘাটতি মিটিয়ে আমেরিকার শুল্ক নীতির বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। যদিও সরকার তার দরকষাকষি চালিয়ে যাচ্ছেন তবে সেই দরকষাকষি যেন শুধু ধনিকশ্রেণিকে একচেটিয়া সুবিধা না দেয়, সে ব্যাপারে সচেষ্ট থাকতে হবে। 

তবে সবকিছু ছাপিয়ে যে ব্যাপার দুটোতে এই সরকার সবচেয়ে হতাশ করেছে তা হলো আইন-শৃঙ্খলার অবনতি এবং যততত্র মামলা-বাণিজ্য। গত এক বছরে কখনো কখনো মনে হয়েছে, রাষ্ট্রে সরকার বলে কিছু নেই। এই নিরাপত্তাহীনতার বোধ তৈরি করা বোধকরি এই সরকারের তেমন দরকার ছিলো না। যে একচ্ছত্র ম্যান্ডেট আর সমর্থন নিয়ে এই সরকার ক্ষমতায় বসেছিলেন, ভবিষ্যতে আর কোনো সরকার এভাবে মসনদে বসবেন কি না সন্দেহ।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে ত্বরিৎ সিদ্ধান্ত নিতে অপরাগতা, কখনো বা ত্বরিৎগতিতে নেয়া সিদ্ধান্ত আবার ত্বরিৎগতিতে পরিবর্তন করে, সরকার তার দ্বিধাদ্বন্দ্বের বিষয়টি প্রকাশ করেছেন। এটি করে জনগণের মাঝে সরকার সম্পর্কে আস্থাহীনতা তৈরি করেছে আবার ‘সরকারের ভেতর আরেক সরকার’ আছেন- এই বোধও তৈরি করেছেন। 

আইন উপদেষ্টা যততত্র মামলা-বন্ধে কোনো কার্যকর উপায় খুঁজতে ব্যর্থ হয়েছেন। প্রকৃত অপরাধীর অপরাধের মাত্রা প্রশমিতকরণে যা কাজে লেগেছে, কিন্তু শুধু দল করার জন্য বা লঘু অপরাধে অনেকে জেলে গিয়েছেন। বিশ্বমানের বিচারের কথা থাকলেও, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যালের বিচারেও তেমন অগ্রগতি হয়নি। অথচ ছিঁচকে অপরাধীরা সপ্তাহান্তে জামিন পেয়ে আবারও অপরাধে জড়িয়েছেন। 

দখল বাণিজ্য পুরোদমে চলেছে, কোথাও কোথাও শুধু ব্যানার পরিবর্তন হয়েছে। আগের প্রশাসকের মতো শুধু প্রচারের নিমিত্তে খাল পরিস্কার আর উদ্ধার অভিযান চললেও, সুপারশপ থেকে পর্যাপ্ত বিকল্প ব্যতীত পলিথিন দূর করা আর সেইন্টমার্টিন নিয়ে অহেতুক বিতর্ক তৈরি করা ছাড়া পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের কাজ নিয়ে তেমন সফলতা নেই। বরং কোনো কোনো জায়গায় গত প্রশাসকের আমলে উদ্ধার হওয়া জায়গা নতুনভাবে দখল হয়ে যেতে দেখা গিয়েছে। 

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিশেষ করে পুলিশ বাহিনীকে এখনো পুরোপুরি কর্মক্ষম করে তুলতে না পারার ব্যর্থতা কার, তা খতিয়ে দেখার সময় এসেছে। চৌকস কর্মকর্তা হিসেবে পুলিশ বাহিনীতে শুনেছি পুলিশের বর্তমান কর্তাব্যক্তিদের বিশেষ কদর আছে। তদুপরি, পুলিশের কাজের প্রতি অনীহা, সন্ত্রাস দমনে ব্যর্থতার দায়ভার সম্মিলিতভাবে সরকার, মন্ত্রণালয় ও বাহিনী- সবার উপর বর্তায়। 

বর্তমান সরকারের ব্যর্থতার আরো বড় একটা কারণ হলো, সংস্কার কমিশনগুলোকে কার্যকর করতে না পারা। এটি অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই, বড় রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার প্রশ্নে ভিন্নমত সংস্কার কমিটিগুলোর জন্য তাদের কাজকে কঠিন করে তুলেছে। কিন্তু যৌক্তিক সংস্কারের প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর উপর যৌক্তিক চাপ প্রয়োগের প্রশ্নে সরকার কেন সামাজিক সমর্থন পেলো না, তার বিশ্লেষণ করা অতীব জরুরি। 

কিছু কিছু সংস্কার প্রশ্নে অহেতুক কালক্ষেপণ ও বিতর্ক তৈরির চেষ্টা হয়েছে, যেমন: পিআর পদ্ধতি প্রণয়ন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় যা খুব একটা হালে পানি পাবে না, তা বোঝা যায়। আবার কোনো কোনো বিষয়ে সংস্কারের কোনো উদ্যোগ দেখেনি, যেমন: রাজনৈতিক দলগুলোর আর্থিক ব্যবস্থাপনা কী হবে। সুশাসন নিশ্চিত করতে চাইলে যার কোনো বিকল্প নেই। 

বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি’র কিছু নেতাকর্মীর আচরণ যথেষ্ট হতাশাজনক। তার প্রকাশ দলটির কয়েকশত নেতাকর্মীর দল থেকে অব্যহতি বা বহিষ্কার। এটা স্পষ্ট- এই অংশটি ১/১১ বা গত ১৭ বছরের অপরাজনীতি থেকে কিছুই শিখেনি। দলের হাইকমান্ড থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে যথাপোযুক্ত ব্যবস্থা নেয়ার কথা বললেও, নেয়া হয়েছে বলে মনে হয়নি। খুব সম্ভবত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এই অংশটি আগেভাগেই বিএনপিকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় চিন্তা করে তোয়াজ করার নীতিতে চলে এসেছে। আরো একটি মজার বিষয় হলো, অনেক নেতাকর্মীকে দল থেকে বহিষ্কার করা হলেও, দলীয় কার্যক্রমে ঠিকই অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়, যেটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে হয়ত: ভুল বার্তা দেয়। তাছাড়া এই দলটিতে এখন সুসময়ের নেতাকর্মীর ছড়াছড়ি। গত ১৭ বছর রাজপথে ছিলেন না, এমন অনেক নেতাকর্মীকে কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে হরহামেশাই দেখা যায়। অপশাসনের ১৭ বছরে রাজনৈতিক দল হিসেবে সবচয়ে বেশি খেসরাত দেয়া দলটির সঠিক রাস্তায় পথ চলার সময় এসেছে। না হলে দলটির হয়ত বড় বেশি মূল্য দিতে হতে পারে। সমস্যা হলো, দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ব্যতীত অন্যদের মাঝে সততা, নৈতিকতার বোধ ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এখনো তেমন প্রকটভাবে প্রকাশিত নয়। দল ও দেশের স্বার্থেই রাজনৈতিক সংস্কার প্রশ্নে দলটির নিজ উদ্যোগে নেতৃত্ব দিতে হবে। সাথে সাথে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। 

তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, সংস্কার প্রশ্নে সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণ বা তাদের পাশে না পাওয়ার একটি বড় কারণ, গণঅভ্যুত্থানের মূল চালিকা শক্তি ছাত্রদের নিজেদের তৈরি না করে অতিদ্রুত ক্ষমতার বলয়ে ঢুকে যাওয়া এবং রাজনৈতিক দল গঠন। গণঅভ্যুত্থানের প্রশ্নে মীমংসা, রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর পূনর্গঠন, সংস্কার প্রশ্নে জাতীয় ঐক্যমত গঠন, নির্বাচন-বিচার-আইন বিভাগের সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত না করা পর্যন্ত সরকারের সহযোগী হিসাবে জনগনকে পাশে নিয়ে অপেক্ষা করা যেতো। অথচ গণঅভ্যুত্থানে বিপুল সাহসে নেতৃত্ব দেওয়া মানুষগুলো ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে নিজেদের কৃতিত্ব জাহিরে এবং কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় ডুবে গেলো। 

সবসময়ের সুযোগ সন্ধানী গোষ্ঠীরা সুযোগ নিলো। গাড়ী দিলো, অর্থ দিলো, প্রচার দিলো, মাথায় বসালো ছুঁড়ে ফেলবার জন্য। কেউ কেউ ২০-২৫ দিন আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে নিজকে শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক নেতা ভাবা শুরু করলো, ভাষা বদলে গেলো, অপরকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা শুরু করলো। নেতৃস্থানীয় কাউকে ভালো চলতে দেখে আরেকদল শুরু করলো চাঁদাবাজি। হুমকির মুখে ফেলে দিলো সংস্কার, রাজনীতি ও সমাজ। নিয়োগকর্তা ছাত্রদের এই অর্বাচীন কাণ্ডজ্ঞান ও কার্যক্রম অবশ্যই অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য দুশ্চিন্তার। ভিন্ন মতের মানুষ নিয়ে গঠিত এই সরকারের পথচলার জন্য হুমকিস্বরূপ। সংকটের সময়েই একজন নেতার পরিচয় সবচেয়ে বড় হয়ে উঠে। ড. মুহাম্মদ ইউনুস সেই নেতা হয়ে উঠবেন কী না- তা অচিরেই হয়ত আপনি জেনে যাবেন। না হলে, এদেশ হারাবে আরেকটি বড় সুযোগ। 

 

লেখক- অধ্যাপক, কৃষি সম্প্রসারণ ও ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগ 

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়