Image description

আমীন আল রশীদ

 

গোপালগঞ্জে সমাবেশ করতে গিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের হামলার মুখে সেনাবাহিনীর প্রহরায় শহর ছাড়েন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতারা। এটি ধারণা করা অমূলক নয় যে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনী কঠোর না হলে সেখানে হয়তো আরও বেশি প্রাণহানি হতো এবং এনসিপির অনেক নেতার জীবনই হয়তো বিপন্ন হতো।

একই ঘটনা ঘটে শনিবার কক্সবাজারের চকরিয়ায়ও। এদিন এক সমাবেশে বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদকে কটূক্তি করার জেরে এনসিপির সভামঞ্চ ভাঙচুর করেন স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীরা। ফলে সমাবেশ পণ্ড হয়ে যায়। বিকালে সেনাবাহিনীর বিশেষ পাহারায় কক্সবাজার ত্যাগ করেন এনসিপির নেতারা।

নজিরবিহীন নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে এনসিপির পদযাত্রা ও সমাবেশের বিষয়ে কক্সবাজার জেলা বিএনপির সভাপতি সাবেক সংসদ সদস্য শাজাহান চৌধুরী বলেন, ‘সেনাবাহিনী, বিজিবি, র‍্যাব, পুলিশসহ সরকারের সকল সংস্থার নিরাপত্তা বলয়ে এনসিপির সমাবেশ উদ্দেশ্যপূর্ণ, রহস্যজনক ও উসকানিমূলক।’ তিনি সালাহউদ্দিন আহমদকে নিয়ে এনসিপি নেতা নাসিরুদ্দীন পাটওয়ারীর বক্তব্যকে ‘ধৃষ্টতাপূর্ণ’ ও ‘বেয়াদবি’ বলেও মন্তব্য করেন।

বিগত সরকারের আমলে সরকারবিরোধীদের পক্ষ থেকে তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ, সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর ব্যাপারে বলা হতো, ‘তারা পারলে পুলিশ ছাড়া মাঠে নামুক।’ এ সময় দেখা যেত, সামনে ও পেছনে বিপুল সংখ্যক পুলিশ, তার মাঝখানে মিছিল করছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা। এমনকি এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আচরণ এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, অনেকে পুলিশ বাহিনীকে ‘পুলিশ লীগ’ বলে অভিহিত করতেন।

 

এরকম বাস্তবতায় গণঅভ্যুত্থানের পরে গঠিত এনসিপির ব্যাপারেও এখন প্রশ্ন উঠছে যে, তাদের কেন সেনা প্রহরায় সমাবেশ করতে হচ্ছে? বস্তুত জুলাই অভ্যুত্থানে সামনের সারিতে থাকা তরুণদের নেতৃত্বে এই দলটি গঠনের আগে থেকেই অনেকে এই দলটিকে ‘কিংস পার্টি’ বলে অভিহিত করছেন, যা এখন নানান ঘটনায় প্রতীয়মান হচ্ছে।

অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রহরা ব্যতিরেকে এনসিপি কি সারাদেশে বিনা বাধায় কর্মসূচি পালন করতে পারবে? যদি না পারে তাহলে সেখানে দুটি প্রশ্ন সামনে আসবে। ১. অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে একটি ‘নির্দলীয়’ অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও কেন একটি রাজনৈতিক দল নিরাপদে সমাবেশ বা কর্মসূচি পালন করতে পারবে না? কেন তাদের পুলিশি বা সেনা প্রহরা দিতে হবে?; ২. অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা দলটিকেও কেন এই ধরনের সুরক্ষাবলয় নিয়ে কর্মসূচি পালন করতে হচ্ছে? জনগণের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক গড়ে উঠছে না কেন? রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধা নিয়ে তাদের রাজনীতি করতে হচ্ছে কেন?

গণমাধ্যমের খবর বলছে,  রোববার চট্টগ্রামে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জুলাই পদযাত্রা ও সমাবেশ কেন্দ্র করে সমাবেশস্থল ও হোটেল নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেওয়া হয়। সতর্ক অবস্থানে ছিল পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। শনিবার বিকালে ডগ স্কোয়াড দিয়ে পুরো মোটেল সৈকত তল্লাশি চালায় সিএমপির নগর পুলিশের একটি দল। যে তিনটি ফ্লোরে নেতারা থাকবেন, সেখানে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য ছাড়া আর কাউকে অবস্থান করতে দেওয়া হচ্ছে না। শনিবার রাতে বান্দরবান প্রেস ক্লাবের সামনে এনসিপির সমাবেশ হয়। সেখানেও কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয় প্রশাসন।

শত্রুকে আপনি দুভাবে মোকাবিলা করতে পারেন। ১. তার ওপর আক্রমণ করে; ২. তাকে নিজের পক্ষে নিয়ে। আক্রমণ করে তখনই আপনি শত্রুকে ঘায়েল করতে পারবেন যখন আপনি তার চেয়ে বেশি শক্তিশালী। ক্ষমতা দেখানোর জন্য শত্রুর বাড়িতে গিয়ে সেনা প্রহরায় ‘পালিয়ে’ আসার মধ্য দিয়ে এনসিপির ক্ষমতার প্রকাশ ঘটল নাকি দুর্বলতা, সেই বিবেচনাটি তাদের করতে হবে।

গত ১১ জুলাই একটি টেলিভিশন চ্যানেলের খবরে বলা হয়, এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতারা সাতক্ষীরায় যাবেন। তাদের আগমন ঘিরে নড়েচড়ে বসেছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ। দীর্ঘদিনের খানাখন্দে ভরা খুলনা রোড মোড়, শহীদ আসিফ চত্বর ও আশপাশের এলাকায় হঠাৎ শুরু হয়েছে তড়িঘড়ি সড়ক সংস্কার কার্যক্রম।

প্রশ্ন হলো, অন্য কোনো দল দেশের কোথাও কর্মসূচি পালন করতে গেলে কি স্থানীয় প্রশাসন এই বিশেষ ব্যবস্থা বা নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলে? এনসিপির জন্য এটা কেন প্রয়োজন হচ্ছে এবং এই ধরনের বিশেষ সুবিধা দিয়ে সরকার নিজেই কি এটা স্বীকার করে নিচ্ছে যে, এনসিপি হচ্ছে ‘সরকারি দল’?

জুলাই অভ্যুত্থান এবং সেই অভ্যুত্থানে সরকারের পতন হওয়া পর্যন্ত এই তরুণদের যে জনসমর্থন ছিল এবং তাদের হাত ধরে একটি নতুন ধারার রাজনীতির সূচনা হবে বলে জনমনে যে প্রতীতির জন্ম হয়েছিল, নানান ঘটনায় তারা সেই সম্ভাবনা নিজেরাই নষ্ট করেছেন বলে অনেকেই মনে করেন। বিশেষ করে ‘মব’ সৃষ্টি করে ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন স্থাপনা ভাঙচুরসহ নানান ঘটনায় তারা সমালোচিত হয়েছেন।

এক বছর আগেও যাদের জীবন-যাপন ছিল অতি সাধারণ, দ্রুততম সময়ের মধ্যে তাদের দামি গাড়ি ও লাইফস্টাইল নিয়ে সমালোচনা হয়েছে। এনসিপির নেতা এবং সরকারে থাকা তাদের কোনো কোনো সহযোদ্ধা উপদেষ্টার পিএস বা ব্যক্তিগত কর্মকর্তার দুর্নীতির অভিযোগ গণমাধ্যমে এসেছে। দুদককেও তদন্ত করতে হয়েছে। অথচ তারা শুরু থেকেই নতুন বাংলাদেশের কথা বলছিলেন। তাদের দলের অন্যতম শীর্ষ নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেছিলেন: ‘যেখানে ঘুস, সেখানেই ঘুসি।’ অথচ তার দলের নেতাদের অনেকেই আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ থেকে মুক্ত থাকতে পারেননি। শুধু তাই নয়, খোদ তাদের দলের একজন কর্মী যৌন হয়রানির অভিযোগে দারুণভাবে সমালোচিত হয়েছেন দলের যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার, যা তাদের নতুন বাংলাদেশ ভাবনার সঙ্গে একেবারেই বেমানান।

অনেকেই এটা মনে করেন যে, দ্রুততম সময়ের মধ্যে ক্ষমতা ও অর্থবিত্তের মালিক হওয়া এবং রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য পাওয়ার কারণে তারা নিজেদের ভীষণ শক্তিশালী ভাবছেন। বাস্তবতা হলো, মানুষের যখন অর্থবিত্ত হয়ে যায়, তখন অনেকেরই নৈতিক স্খলন ঘটে। কিন্তু একজন সাধারণ মানুষ বা অন্য যে কোনো পেশার মানুষের নৈতিক স্খলনের চেয়ে রাজনীতিবিদের নৈতিক স্খলন অনেক বেশি আলোচনার জন্ম দেয়। কেননা, রাজনীতিবিদদের প্রতি গণমাধ্যম তো বটেই, সাধারণ মানুষেরও চোখ থাকে। ফলে তারা সামান্য বিচ্যুত হলেও সেটি বড় খবরের জন্ম দেয়। এনসিপির কোনো কোনো নেতা সেই বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারেননি অথবা ক্ষমতার মোহে তাদের দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে গেছে।

এনসিপির এই তরুণরা যে নতুন বাংলাদেশের কথা বলছিলেন বা এখনো বলেন, তার সঙ্গে তাদের ভাষা ও বডি ল্যাঙ্গুয়েজের পার্থক্য অনেক। তাদের মধ্যে বিনয়ের বিপরীতে ঔদ্ধত্যের প্রকাশ বেশি। ভালোবাসার চেয়ে প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসায় তারা বেশি আগ্রহী, যা সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাদের যোগসূত্র স্থাপনের পথে প্রধান অন্তরায়।

তাদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলনে আওয়ামী লীগের পতন হয়েছে, এটা যেমন ঐতিহাসিকভাবে সত্য, তেমনি রাজনৈতিক কারণে দেশের ৬৩টি জেলার সঙ্গে গোপালগঞ্জের যে একটি মৌলিক পার্থক্য রয়েছে, অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর জন্মস্থান এবং যেখানে তার সমাধি—সেখানের অধিকাংশ মানুষ যে আওয়ামী লীগের সমর্থক, এই বাস্তবতা উপলব্ধি করে গোপালগঞ্জে কর্মসূচি নেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের অনেক বেশি কৌশলী হওয়া উচিত ছিল।

এটি তাদের বিবেচনায় রাখা দরকার ছিল যে, আওয়ামী লীগ বা কোনো একটি রাজনৈতিক আদর্শ বুলডোজার দিয়ে নির্মূল করা যায় না। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দিয়েও একটি দলের শেকড় উপড়ে ফেলা যায় না। বরং কোনো একটি রাজনৈতিক দল বা আদর্শকে ম্লান করে দিতে হয় ওই দলের চেয়ে উত্তম রাজনীতি চর্চার মধ্য দিয়ে।

সুতরাং, এনসিপি যদি গোপালগঞ্জের কর্মসূচি দেশের অন্যান্য জেলার মতোই একটি ধারাবাহিক কর্মসূচির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতো এবং এই জেলার মানুষকে আস্থায় নিয়ে তাদের প্রতি প্রতিহিংসা নয়, বরং ভালোবাসা দিয়ে তাদের মন জয় করার চেষ্টা করতো, তাহলে গোপালগঞ্জের সহিংসতা হয়তো এড়ানো যেতো। দলের তাদের বক্তব্য ও বডি ল্যাঙ্গুয়েজের মধ্য দিয়ে যদি এটা বোঝাতে পারতেন যে, আওয়ামী লীগ যাই করুক না কেন, গোপালগঞ্জের সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাদের কোনো বিরোধ নেই, বরং তারাও গোপালগঞ্জের মানুষকে আস্থায় নিয়েই রাজনীতি করতে চান, তাহলে তাদের নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে মানুষ আশ্বস্ত হতে পারত।

বলাই হয়, শত্রুকে আপনি দুভাবে মোকাবিলা করতে পারেন। ১. তার ওপর আক্রমণ করে; ২. তাকে নিজের পক্ষে নিয়ে। আক্রমণ করে তখনই আপনি শত্রুকে ঘায়েল করতে পারবেন যখন আপনি তার চেয়ে বেশি শক্তিশালী। ক্ষমতা দেখানোর জন্য শত্রুর বাড়িতে গিয়ে সেনা প্রহরায় ‘পালিয়ে’ আসার মধ্য দিয়ে এনসিপির ক্ষমতার প্রকাশ ঘটল নাকি দুর্বলতা, সেই বিবেচনাটি তাদের করতে হবে।

মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্রের সব শক্তিও আওয়ামী লীগের পক্ষে ছিল। কিন্তু জনগণ রাস্তায় নেমে গিয়েছিল বলে সেই রাষ্ট্রীয় শক্তি সরকারের মসনদ টেকাতে পারেনি। অন্তর্বর্তী সরকার অনন্তকাল ক্ষমতায় থাকবে না। সুতরাং এনসিপিও খুব বেশিদিন সরকারি আনুকূল্য পাবে না। যদি তারা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসতে না পারে তাহলে তাদের আর দশটা দলের মতো রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য ছাড়াই রাজনীতি করতে হবে। সেক্ষেত্রে প্রয়োজন হবে জনগণের সমর্থন। আর জনগণের সমর্থন থাকলে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য ছাড়াই তারা নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে ভূমিকা রাখতে পারবেন।

লেখক : সাংবাদিক ও লেখক।