
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর বছর পূর্তি হতে চলছে। ৫ আগস্ট হাসিনা পালিয়ে গেলেও পুরো জুলাই ছিল রক্তভেজা এক বর্ষার মাস। ১৪ জুলাই হাসিনা আওয়ামীপন্থি দলদাস সাংবাদিকদের নিয়ে মতবিনিময়ে বসেছিলেন। সেখানে তিনি ছাত্রদের রাজাকারের নাতিপুতি বলে অভিহিত করেছিলেন। এরপর সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো থেকে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। মুখে স্লোগান ছিল তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার। হাসিনা পতনের ৩৬ দিনের আন্দোলনে সবচেয়ে শক্তিশালী ও প্রভাবশালী স্লোগান ছিল এটি।
হাসিনা তার দেড় দশকের শাসনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ বলে দেশকে বিভাজনের মাধ্যমে তার ক্ষমতা টিকিয়ে রেখেছিলেন। যারা তার নিপীড়নমূলক শাসনের বিরুদ্ধে কথা বলার চেষ্টা করেছেন, তাদের রাজাকার, পাকিস্তানপন্থি কিংবা রাজাকারের সহযোগী হিসেবে আখ্যায়িত করে কোণঠাসা করার চেষ্টা করেছেন। এমনকি জিয়াউর রহমানের মতো একজন সেক্টর কমান্ডারকে তারা পাকিস্তানের চর হিসেবে পরিচিত করার চেষ্টা করা হয়।
আওয়ামী লীগের এই বিভক্তি ও বিভাজনের রাজনীতির চূড়ান্ত রূপ ছিল ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে শাহবাগে জমায়েত। যেখান থেকে দেশের আইন ও বিচারব্যবস্থার মৃত্যু ঘটিয়ে ফাঁসির রাজনীতি শুরু করা হয়। আমার দেশ প্রথম জানিয়েছিল শাহবাগ থেকে ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। শাহবাগের ফ্যাসিবাদী জমায়েতের পরিণতি হিসেবে বিএনপি ও জামায়াতের নেতাদের প্রহসনমূলক বিচারের নামে একের পর এক মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। আবার অনেকে জেলে মারা যান। এদের হত্যার পক্ষে একটি যুক্তি দাঁড় করানো হয়েছিল, এরা রাজাকার। হাসিনার শাসনামলে রাজাকার শব্দটি ছিল ভিন্নমত দমন ও নাগরিক অধিকার হরণের সবচেয়ে বড় অস্ত্র। শুধু তাই নয়, ভিন্নমতাবলম্বীদের দেশছাড়া করা কিংবা পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হতো। এ কারণে হাসিনার দুঃশাসনের বিরুদ্ধে জুলাইয়ের আন্দোলনে আরেকটি জনপ্রিয় স্লোগান ছিলকথায় কথায় বাংলা ছাড়, বাংলা কী তোর বাপ-দাদার। রাস্তার রাস্তায় গ্রাফিতির ভাষা ছিলো দেশটা কারো বাপের না।
শেখ হাসিনার দুঃশাসনের অবসান ও পলায়নের পর এদেশের মানুষের আশা ছিল বিভক্তি এবং বিভাজনের রাজনীতির অবসান হবে। দেশদ্রোহী কিংবা রাজাকার বলে হত্যা ও দেশছাড়া করার যে রাজনৈতিক ক্ষেত্র তৈরি করা হয়েছিল, সে ধরনের পরিস্থিতি যেন আর ফিরে না আসে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে অভ্যুত্থানের এক বছর পার না হতেই আবার সেই শাহবাগের ঘৃণিত চেতনার রাজনীতি দেশে ফিরে এসেছে। রাজপথে ধরে ধরে জবাই করা, দেশছাড়া করা কিংবা পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়ার স্লোগান শুরু হয়েছে।
১ জুলাই থেকে আরেক জুলাইয়ের মধ্যে আবার যে সংঘাতের রাজনীতির স্লোগান ফিরে এসেছে, এটি সাধারণ কোনো কাকতালীয় ব্যাপার নয়। এর পেছনে কাজ করছে পরাজিত শাহবাগিদের বুদ্ধি ও পরিশ্রম। এই শাহবাগিদের একটি অংশ হাসিনার পতনের শেষদিকে বিদেশে বসে হঠাৎ করে হাসিনাবিরোধী ভূমিকা নিতে থাকে। আন্দোলনকারীদের একটি অংশের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে। হাসিনার পতনের পর এরা আবার নতুন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আওয়াজ তোলে। হঠাৎ করে এদের অনেকে বিএনপির মতো প্রধান রাজনৈতিক দলের বুদ্ধিদাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়।
এদেশের মানুষের কাছে বিএনপির রাজনৈতিক পরিচয় জাতীয়তাবাদী ইসলামি মূল্যবোধে বিশ্বাসী একটি দল হিসেবে। যে দলের প্রতিষ্ঠাতা একজন মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার পরও সংবিধানে সংযোজন করেছিলেন বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন, আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস হবে যাবতীয় কর্মকাণ্ডের ভিত্তি। হঠাৎ করে সেই বিএনপির পরিচয় দেওয়া হচ্ছে সেন্টার লেফট ও একটি উগ্র সেক্যুলার রাজনৈতিক দল হিসেবে। এ দলের পক্ষ নিয়ে এমন সব ভিডিও, মিম ও স্লোগান দেওয়া হচ্ছে, যা ছিল পতিত আওয়ামী লীগের নিপীড়নমূলক স্লোগানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। অনেকে মনে করেন, বিএনপির জনভিত্তির মূল অংশটিকে বিএনপি থেকে বিচ্ছিন্ন করার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা থেকে একটি মহল দলটিকে নতুন পরিচয়ে পরিচিত করতে যাচ্ছে।
হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপট বদলে গেছে। বিএনপি এখন দেশের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি। বিএনপির যেকোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত শুধু দলের জন্য নয়, দেশের জাতীয় ঐক্য ও সার্বভৌমত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত। বাস্তবতা হচ্ছে, বিএনপিকে শুধু একটি বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে দেখলে হবে না, বিএনপির ওপর নির্ভর করছে দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির ভবিষ্যৎ। শুধু নিজের রাজনীতি নয়, দেশের স্বার্থে বিএনপিকে এখন অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর গতিপথ নির্ধারণ করে দিতে হবে। দায়িত্ব নিতে হবে জাতীয় অভিভাবকের। যেমনটি আমরা দেখেছিলাম সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মধ্যে। যার প্রতিফলন ঘটেছিল ১৯৭৯ সালের পার্লামেন্টে। যেখানে শহীদ জিয়াউর রহমান সব দলের প্রতিনিধিত্বমূলক সংসদ তৈরি করে গণতান্ত্রিক রাজনীতির সূচনা করেছিলেন। যার মধ্য দিয়ে শুধু মুজিবের বাকশাল নয়, একদলীয় শাসনের চিন্তার কবর রচিত হয়েছিল। জিয়াউর রহমান তখন শুধু বিএনপি নেতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন জাতির কান্ডারি। এ কারণে এদেশের মানুষ জিয়াউর রহমানকে বহুদলীয় গণতন্ত্রের জনক বলে থাকেন।
মনে রাখতে হবে, শেখ মুজিবের পতনের পর দেশে চরম এক অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছিল। অবশেষে ৭ নভেম্বরের সিপাহি জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে এদেশের মানুষ রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমানকে পেয়েছিলেন। বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক শূন্যতা থেকে জিয়াউর রহমানের উত্থান হয়েছিল। আজকে বাংলাদেশ অনেকটা একই পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। দেশে এক ধরনের রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে বিএনপি অভ্যন্তরীণভাবে চাপের মুখে পড়েছে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, গত দেড় দশক শেখ হাসিনা গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত চোরতন্ত্র কায়েম করেছিলেন। শেখ হাসিনা দলের নেতাকর্মীদের জন্য চাঁদাবাজি ও লুটপাটকে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় রূপ দিয়েছিলেন। খোদ শেখ হাসিনার অফিসের একজন পিয়ন ৪০০ কোটি টাকার মালিক বনে গিয়েছিলেন। হেলিকপ্টার নিয়ে চলাফেরা করতেন।
হাসিনার পতনের পর খুব স্বাভাবিকভাবে বিএনপির মাঠপর্যায়ের একটি অংশ এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব ও চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি হচ্ছে। এতে শতাধিক লোকের প্রাণহানি ঘটেছে। এর মধ্যে নির্মম ঘটনা ঘটেছে পুরান ঢাকায়। সেখানে যুবদলের একজন সদস্যকে পাথর ছুড়ে হত্যা করা হয়েছে। এই নির্মমতা সাধারণ মানুষকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। দল হিসেবে অভিযোগ পাওয়া মাত্র প্রতিটি চাঁদাবাজির ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। তাদের দল থেকে বহিষ্কার করেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে গ্রেপ্তারের জন্য অনুরোধ করেছে। কিন্তু এরপরও তাদের থামানো যাচ্ছে না। পাটগ্রাম ও নওগাঁর মতো কিছু এলাকায় থানা থেকে আসামি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। বাস্তবতা হচ্ছে, বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব অনেকটা এদের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শক্ত অবস্থান ছাড়া এদের দমন করা বা পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব নয়। শুধু বিএনপিকে দোষারোপ করে এর সমাধান হবে না। এ সমস্যার মূলে রয়েছে ফ্যাসিস্ট আমলে চাঁদাবাজি ও দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার প্রভাব।
যুবদলসহ বিএনপির বিরুদ্ধে ওঠা চাঁদাবাজির অভিযোগ নিয়ে অন্য রাজনৈতিক দলগুলো সোচ্চার। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এমনটা হওয়া স্বাভাবিক। যাতে দলগুলো সাধারণ মানুষের জবাবদিহির মধ্যে আসে। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় পুরান ঢাকার হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিএনপির শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে অশ্লীল ভাষায় স্লোগান দেওয়া হয়েছে। নতুন প্রজন্ম বা জেন জিরা ৩৬ দিনের আন্দোলনে হাসিনাকে তাড়িয়েছে। সেই আন্দোলনে বিক্ষুব্ধের মুখে ক্ষোভ ও রাগ থেকে অশ্লীল স্লোগান এসেছে। মানুষ সে স্লোগান নিয়ে কোনো আপত্তি করেনি। এখন ফ্যাসিস্ট নেই, দেশকে গড়তে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যেমন সহাবস্থান লাগবে, তেমনি পরস্পরকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতে হবে। এই আন্দোলন-সংগ্রামে বিএনপিসহ হাসিনাবিরোধী সব রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের কমবেশি ভূমিকা ছিল। এই আন্দোলনে বিএনপির শীর্ষ নেতার ভূমিকা কোনো অংশে কম নয়। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতাকে যদি অশ্লীলভাবে আক্রমণ করা হয়, তাহলে নেতাকর্মীদের মধ্যে এর প্রতিক্রিয়া হবে। দেশকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে হলে জুলাই বিপ্লবে অংশ নেওয়া তরুণদের আরো ধৈর্যশীল হতে হবে। বিভেদ-বিভাজন যেন না বাড়ে, সে ব্যাপারে সবার সতর্ক থাকা উচিত। মনে রাখতে হবে, পলাতক ফ্যাসিস্টরা ওত পেতে আছে। নিজেদের মধ্যে বিভেদের সুযোগ তারা নেবে। ইতোমধ্যে এর আলামত আমরা দেখছি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তারা বিএনপির বিরুদ্ধে নানা ধরনের প্রচারণা চালাচ্ছে। বিএনপিকে জাতীয়তাবাদী মব পার্টি বলে মিথ্যা প্রচারণা চালানো হচ্ছে।