
মাহমুদুর রহমান
গত সপ্তাহের মন্তব্য প্রতিবেদনের একটি ভুল সংশোধন করে আজকের লেখা শুরু করব। আমার লেখায় ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি আবদুর রউফ সম্পর্কে আমি একটি ভুল তথ্য দিয়েছিলাম।
আমি লিখেছিলাম, মাগুরার বিতর্কিত উপনির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিচারপতি রউফ পদত্যাগ করেছিলেন। প্রকৃত তথ্য হলো, তিনি তার পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করে ১৯৯৫ সালে অবসরে গিয়েছিলেন। এই স্মৃতিভ্রষ্টতার জন্য আমি দুঃখিত। এবার আজকের প্রসঙ্গ।
বিএনপির শামসুজ্জামান দুদু কিছুদিন কাশিমপুর ২ নম্বর জেলখানায় আমার সঙ্গে বন্দি ছিলেন। ছাত্রদলের সাবেক সভাপতিকে তখন আমার কাছে বেশ মার্জিত এবং লেখাপড়া জানা মানুষ মনে হয়েছিল। সেই সময় একবার আমার সঙ্গে রাজনৈতিক বিতর্ককালে মনোমালিন্য হলে তিনি বয়োকনিষ্ঠ হিসেবে আমার সেলে এসে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। তার মধ্যে ভুল স্বীকারের মানসিকতা দেখে আনন্দিত হয়েছিলাম। আমার দেশ পুনঃপ্রকাশের দিন থেকেই বিএনপি আমাদের ইসলামপন্থি ট্যাগ দিয়ে বেশ বৈরী আচরণ শুরু করেছিল।
অনলাইনে দলটির এক অংশের পত্রিকা বয়কটের প্রচারণায় বিস্মিত হয়েছি। বিএনপির কোনো কেন্দ্রীয় নেতা অদ্যাবধি নিজ থেকে আমাদের শুভেচ্ছা জানানোর কোনো প্রয়োজনবোধ করেননি। তারা কেউ কারওয়ান বাজারে আমার দেশ-এর নতুন অফিসেও আসেননি। এমন একটা ‘মুখ দেখাদেখি নেই’ পরিস্থিতিতে দুদু কিন্তু একবার আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। তার অপ্রত্যাশিত আগমনে আমরা সবাই আশ্চর্য ও খুশি হয়েছিলাম। দুদু ঘুরে যাওয়ার পর অবশ্য আরেক সাবেক ডাকসাইটে ছাত্রনেতা এ্যানিও অফিসে এসেছিলেন।
তিনিও আমার সঙ্গে কিছুদিন কাশিমপুর জেলে বন্দি ছিলেন। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গেই আমার দীর্ঘ জেলবাসের অম্লমধুর স্মৃতি রয়েছে। যাই হোক, ৬ জুলাই আমার মায়ের মৃত্যুর পর জাতীয়তাবাদী দলের অনেক নেতা ও কর্মী আমার বাসায় এসেছেন এবং মায়ের জানাজায় অংশ নিয়েছেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান আমার মায়ের মৃত্যুর দিন সন্ধ্যায় লন্ডন থেকে টেলিফোন করে সান্ত্বনা দিয়েছেন। আমি তাদের সবার কাছে সবিশেষ কৃতজ্ঞ। একসময় তাদের অধিকাংশ আমার বন্ধু ছিলেন। মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি।
শামসুজ্জামান দুদুর সাম্প্রতিক বেশকিছু ভাইরাল হওয়া উক্তি শুনে আমি একাধারে স্তম্ভিত ও দুঃখিত হয়েছি। এমন একজন পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদের মুখ থেকে এ ধরনের বাক্য নিঃসৃত হওয়া অবিশ্বাস্য এবং দুঃখজনক। তাকে নিয়ে নানারকম প্যারোডি রচিত হয়েছে। বিএনপির আরেক নেতা বরকতউল্লা বুলুও প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস ও নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমানের পরিবার নিয়ে রীতিমতো অশ্লীল মন্তব্য করেছেন।
এর আগে তারেক রহমানের নাম উচ্চারণের আগে ওজু করে নিতে হবে বলে তিনি তেলবাজির প্রতিযোগিতায় নির্লজ্জ আওয়ামীদেরও প্রায় ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। যতদূর মনে পড়ে, এক আওয়ামী নেতা একবার বলেছিলেন, শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপ্নে দেখলে নাকি বেহেশতে যাওয়া সুনিশ্চিত! নাউজুবিল্লাহ। এ-জাতীয় অর্বাচীন বক্তব্যের জন্য প্রবীণ বয়সে পৌঁছানো দুদু ও বুলুকে দল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে সতর্ক করাও হয়েছে। শোনা কথা, লন্ডন বৈঠকেও নাকি স্বয়ং তারেক রহমান তার দলের নেতাদের অমার্জিত বক্তব্যের জন্য ড. ইউনূসের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
অমার্জিত বক্তব্যে ইদানীং দুদু ও বুলুকে হারিয়ে দিয়ে বিভিন্ন টকশোতে বিএনপির সবচেয়ে আক্রমণাত্মক খেলোয়াড় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন একসময়কার বাকশাল ও হাইব্রিড নেতা ফজলুর রহমান এবং মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক সহকর্মী মরহুম অলি আহাদের কন্যা রুমিন ফারহানা। দুজনেই জ্বালাময়ী বক্তা এবং তাদের মুজিবপ্রেমের বহর দেখলে তাজ্জব হতে হয়। মনে হয় তারা কেমন করে যেন ভুল দলে চলে এসেছেন। প্রচুর সমালোচনা সত্ত্বেও তাদের কথাবার্তায় কোনো বাছবিচার কিংবা থামাথামি নেই। জাতীয়তাবাদী দলের যে শীর্ষ নেতৃত্ব দুদু ও বুলুকে সতর্ক করেছেন, তারা যে কেন এই দুই লাইটওয়েট নেতা-নেত্রী এবং সমগোত্রীয় আরো কয়েকজন বিএনপির টকশো অতিথিদের ক্রমাগত ছাড় দিয়ে চলেছেন, সেটা আমার জানা নেই।
তবে দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় শুধু এটুকু বলতে পারি, জনমতের বিচারে ফজলুর রহমান ও রুমিন ফারহানা গংয়ের কর্মকাণ্ডে বিএনপি যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের বিতর্কের ধরন ও বক্তব্যের সঙ্গে বিএনপির এযাবৎকালের ভাবমূর্তি ও ঘোষিত আদর্শ একেবারেই বেমানান। আমার মন্তব্যে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব দ্বিমত পোষণ করলে তারা যেকোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রতিষ্ঠান দিয়ে জনমত জরিপ করিয়ে দেখতে পারেন। ড. ইউনূস সরকারের সঙ্গে অনাকাঙ্ক্ষিত দূরত্ব সৃষ্টিতে তাদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে।
পাঠক এমন ভুল ধারণা মোটেও করবেন না যে, শেখ হাসিনার মতো অসহ্য বাচালতা ক্ষেত্রবিশেষে কেবল বিএনপির মধ্যেই সীমাবদ্ধ—এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীও সীমা ছাড়িয়ে গিয়ে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও স্বাধীনতার মহান ঘোষক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সম্পর্কে অসৌজন্যমূলক কথা বলার ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন। তরুণ দলটির আরো কিছু অপরিণামদর্শী নেতার বক্তব্যেও আদবের যথেষ্ট অভাব দেখা যাচ্ছে। তারা যত তাড়াতাড়ি তরুণ বয়সের এসব চপলতা কাটিয়ে উঠতে পারবেন, ততই তাদের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক জীবনের জন্য মঙ্গল হবে। তাদের আমি সবসময়ই ‘হাসিনা সিনড্রম’ থেকে বেঁচে থাকার পরামর্শ দিয়ে যাব। তবে সবচেয়ে আশ্চর্য হয়েছি ইসলামী আন্দোলনের চেয়ারম্যান ফয়জুল করিমের বেশ কিছু বক্তব্যে। একে তো মুরুব্বি, তার ওপর পীর বংশের একজনের কাছ থেকে এ ধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য আমরা প্রত্যাশা করি না।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ২০০৭ সালে এক-এগারোর ভারতীয় দালাল ও অবৈধ সরকারের সময় আয়নাঘরে নির্যাতিত হয়েছিলেন। জাতীয়তাবাদী রাজনীতির চেতনা ধ্বংস করে বাংলাদেশে ভারতীয় হেজেমনি প্রতিষ্ঠার হীন উদ্দেশ্য নিয়েই মইন-মাসুদ গং তারেক রহমানকে চিরতরে পঙ্গু করে দিতে চেয়েছিল। যেসব ভাগ্যবান ব্যক্তি শেখ হাসিনার আমলে নিরাপদে ছিলেন, তাদের ফ্যাসিস্ট সরকারের জুলুমের সব ভিকটিমের প্রতি নিদেনপক্ষে শ্রদ্ধাশীল থাকা উচিত। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত জিয়া পরিবারের ওপর যে ভয়াবহ জুলুম হয়েছে, সেটাকে তুচ্ছ করার যেকোনো প্রচেষ্টার প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করতে নিজে একজন ভিকটিম হিসেবে আমি কখনো কুণ্ঠিত হব না। জামায়াতে ইসলামীর কিছু নেতার বক্তব্যেও ঔদ্ধত্য প্রকাশ পাচ্ছে। দলমত নির্বিশেষে রাজনৈতিক বক্তৃতার নামে সব অসভ্যতার আমি নিন্দা জানাই।
এ দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে আমার আবেদন—আপনারা যার যার দলের অশালীন উক্তিকারী নেতাদের এখনই থামান। অমার্জিত ও লাগামহীন বক্তব্য থেকেই সন্ত্রাসী মানসিকতার উৎপত্তি হয়ে থাকে। শেখ হাসিনা তার বক্তব্যের মাধ্যমে সমাজকে বিভক্ত করেই সব গণহত্যার পক্ষে বৈধতা সৃষ্টি করতেন। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর ঢাকায় টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে লগিবৈঠার নৃশংসতা থেকেই পরবর্তী সব গণহত্যার বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল। আজ পর্যন্ত সেই হত্যার বিচার হয়নি। এই বিচারহীনতাই সমাজকে ক্ষয়প্রাপ্ত করে অবধারিত ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। ২০১৩ সালে আমার দেশ রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থাকে রক্ষা করার জন্যই শাহবাগের ফ্যাসিবাদী আন্দোলনের বিরুদ্ধে একাকী লড়াই করার দুঃসাহস দেখিয়েছিল।
সুশীল ও মিডিয়া জগতে সেই সময় যারা বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার বয়ান ও পাটাতন নির্মাণে সোৎসাহে অংশ নিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে অনেকেই ভোল পাল্টে এখন বিএনপির ঘাড়ে সওয়ার হয়েছেন। তাদের প্ররোচনায় জাতীয়তাবাদী দল তার মূল আদর্শ থেকে বিচ্যুত হচ্ছে কি না, সেটা দলটির নীতিনির্ধারকদের বিবেচনার বিষয়। জুলাই বিপ্লবোত্তর বাংলাদেশে সরকারের ব্যর্থতায় প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধনে ধীরগতি এবং সংস্কার অসমাপ্ত রেখেই ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের উদগ্র ও অশোভন ব্যগ্রতা ফ্যাসিবাদবিরোধী জাতীয় ঐক্যকে অতি অল্প সময়ের মধ্যে বিনষ্ট করেছে। এই অনৈক্যের দায় কম বা বেশি সবাইকেই নিতে হবে। এর ফলে সমাজে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, তারই বিষময় ফল আমরা কদিন আগে পুরোনো ঢাকায় প্রত্যক্ষ করেছি। সেদিন যে নৃশংসতার সঙ্গে দিনেদুপুরে নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে, তার সঠিক বর্ণনা দেওয়ার মতো ভাষা আমার জানা নেই। ভিডিওতে হত্যাকারীদের দেখে আমার কাছে মানুষ বলে মনে হয়নি। এই চরিত্রের কর্মী নামের সন্ত্রাসীরা বিএনপির ভয়ংকর বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমরা দ্রুত বেগে ২০০৬ সালের মতো অরাজক পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হচ্ছি কি না, এই প্রশ্ন আজ সবার। সেই সময় আমাদের প্রতিবেশী আধিপত্যবাদী রাষ্ট্র একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতি ও অভ্যন্তরীণ অরাজক পরিস্থিতির সুযোগ গ্রহণ করেছিল। দেশীয় এজেন্টদের মাধ্যমে সেই পরিকল্পনা সফলভাবে বাস্তবায়িত হলে দীর্ঘকালের জন্য বাংলাদেশের জনগণ অধিকারহীন হয়ে পড়েছিল এবং রাষ্ট্র সার্বভৌমত্ব হারিয়েছিল।
বাংলাদেশের অকুতোভয় তরুণ ছাত্রজনতা মহান জুলাই বিপ্লবে অকাতরে জীবন বিলিয়ে দিয়ে জনগণের হারানো অধিকার এবং দেশের সার্বভৌমত্ব ফিরিয়ে এনেছে। মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, গণতান্ত্রিক এবং প্রকৃত স্বাধীন দেশ গঠন করতে না পারলে আমরা সেই সব দেশপ্রেমিক ও লড়াকু তরুণদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করব। জুলাই বিপ্লবের বৃহত্তর ঐক্য ধরে রাখার জন্য বাংলাদেশের বৃহত্তম দল হিসেবে বিএনপির সর্বাধিক দায়িত্ব থাকলেও সেই গুরুদায়িত্ব তারা কতখানি পালন করেছে, সেই বিবেচনা দলের শীর্ষ নেতৃত্বের। পুরোনো ঢাকার নারকীয় ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপির নীতিনির্ধারকদের সারা দেশে দলের ক্রিমিনালদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি গণমাধ্যমে
দায়িত্বজ্ঞানহীন ও উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে যারা পরিস্থিতিকে বিষময় করে তুলছেন তাদের ব্যাপারেও সিদ্ধান্তে আসা উচিত। জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ সব দলকে রাজনৈতিক বক্তব্যে শিষ্টাচার রক্ষা করার আহ্বান জানাচ্ছি। রাজনৈতিক দলগুলোর বিক্ষোভ সমাবেশে যেসব অশালীন ভাষা ও স্লোগান ব্যবহার করা হচ্ছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়। ভুলে যাবেন না, আওয়ামী ফ্যাসিবাদ এবং ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও তাদের দালালগোষ্ঠী আপাতত পরাজিত হলেও আমাদের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে। আজ জুলাই বিপ্লবের আইকন আবু সাঈদের প্রথম শাহাদাতবার্ষিকী। জাতির কী দুর্ভাগ্য, এক বছরের মধ্যেই বিপ্লবের সহযোদ্ধারা একে অপরকে খতম করার মিশনে নেমেছেন। ক্ষমতার জন্য অস্থির হয়ে তারা দেশ ও জাতিকে কঠিন সংকটে ফেলে দিচ্ছেন। ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।