Image description

আমীন আল রশীদ 

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকটি হয়ে গেলো গত শুক্রবার (১৩ জুন) লন্ডনের ডোরচেস্টার হোটেলে। প্রধান উপদেষ্টা তার চারদিনের লন্ডন সফরে সফরসঙ্গীদের নিয়ে হোটেলে অবস্থান করেন। যদিও এ সফরে তার সঙ্গীর সংখ্যা এবং বিলাসবহুল হোটেলের খরচ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকে তীর্যক মন্তব্যও করেন।

সরকারপ্রধানদের বড় বহর নিয়ে বিদেশ সফর এবং বিলাসবহুল হোটেলে থাকার বিনিময়ে বিপুল অর্থ খরচের ঘটনা এটিই প্রথম নয়। তবে অতীতে হয়েছে বলে এখনো হবে, এটি যেমন যৌক্তিক নয়, তেমনি সোশ্যাল মিডিয়ায় এখন খোদ সরকারপ্রধানের সফরেরও যে সমালোচনা করা যায়, সেটিও কম অগ্রগতি নয়।

আসা যাক এই সফরের সবচেয়ে প্রধান আকর্ষণ প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং দীর্ঘদিন ধরে লন্ডনে নির্বাসিত জীবনযাপনকারী বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠক প্রসঙ্গে। বৈঠকটি প্রধান উপদেষ্টার সরকারি সফরসূচিতে অন্তর্ভুক্ত না থাকলেও তার লন্ডন সফরে যাওয়ার পরপরই গুঞ্জন শুরু হয় যে, তারেক রহমানের সঙ্গে তার বৈঠক হতে পারে। পরে বিএনপির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয় যে, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আগ্রহেই বৈঠকটি হচ্ছে। সুতরাং এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকের যে বহুমাত্রিক প্রতিক্রিয়া হবে—সেটিই স্বাভাবিক।

কেন এই বৈঠকটি গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম ও প্রধান কারণ, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে বিএনপির যে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল, সেটি এই বৈঠকের মধ্য দিয়ে কিছুটা হলেও নিরসন করা গেছে। বিএনপি যেমন এতদিন ডিসেম্বরেই নির্বাচন হতে হবে বলে অনড় ছিল এবং প্রধান উপদেষ্টাও শুরু থেকে ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনে এবং সবশেষ জাতির উদ্দেশে ভাষণে এপ্রিলের প্রথমার্ধে ভোট হবে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন—সেই জায়গা থেকে উভয় পক্ষই সরে গেছে। তারা ডিসেম্বর ও এপ্রিলের মাঝামাঝি একটা সময়ের ব্যাপারে শর্তসাপেক্ষে একমত হয়েছেন। সেটি হলো, আগামী ফেব্রুয়ারিতে রোজা শুরুর আগের সপ্তাহে। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি রোজা শুরু হওয়ার কথা। সেই অঙ্ক কষে অনেকে নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ হিসেবে ১২ ফেব্রুয়ারির কথা লিখেছেন। অনেকে ৮ তারিখেরও কথাও বলছেন। যদিও নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণার এখতিয়ার কেবল নির্বাচন কমিশনের। তারা তফসিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত নির্বাচনের কোনো তারিখের ব্যাপারেই নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ নেই।

 

প্রশ্ন হলো, এই বৈঠকের মধ্য দিয়ে কি সত্যিই নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা কেটে গেছে? নিশ্চয়ই না। কেননা, লন্ডনে অনুষ্ঠিত বৈঠক শেষে যে যৌথ বিবৃতি দেওয়া হয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে, ‘জনাব তারেক রহমান প্রধান উপদেষ্টার কাছে আগামী বছরের রমজানের আগে নির্বাচন আয়োজনের জন্য প্রস্তাব করেন। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াও মনে করেন ওই সময় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ভালো হয়। প্রধান উপদেষ্টা বলেন যে, তিনি আগামী বছরের এপ্রিলের প্রথমার্ধের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছেন। সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে ২০২৬ সালের রমজান শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহেও নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে সেই সময়ের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতিঅর্জন করা প্রয়োজন হবে।’ তার মানে আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে যদি এই সময়ের মধ্যে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা যায় এবং সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতিঅর্জন করা যায়।

প্রশ্ন হলো, প্রধান উপদেষ্টার ভাষায় বিচার ও সংস্কারে যদি ‘পর্যাপ্ত অগ্রগতি’ না হয়, তাহলে কি ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে না? সংস্কার ও বিচারে ‘পর্যাপ্ত অগ্রগতি’ বলতে প্রধান উপদেষ্টা বিচারের কোন পর্যায় এবং সংস্কার বলতে সুনির্দিষ্টভাবে কোন কোন কাজ বোঝাচ্ছেন, সেটি এখনো পরিষ্কার নয়। তাছাড়া বিচার কার্যক্রম যদি আদালতের এখতিয়ার ও স্বাধীনতার ওপর নির্ভরশীল হয়, তাহলে সেখানে ‘পর্যাপ্ত অগ্রগতি’ না হওয়ার দায়ভার কি বিএনপির ওপরে চাপানো যাবে? একইভাবে সংস্কার বাস্তবায়নের মূল দায়িত্ব সরকারের। তাকে আগে তালিকা তৈরি করতে হবে যে, কোথায় কতটুকু সংস্কার তারা ফেব্রুয়ারির আগে করতে চায় এবং সেখানে বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে সরকার কী ধরনের সহযোগিতা প্রত্যাশা করে, সেটিও পরিষ্কার থাকা বাঞ্ছনীয়।

বৈঠকের রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া কী হলো?

১. স্বভাবতই এই বৈঠকের ফলাফলে বিএনপি খুশি। কেননা, নির্বাচন ইস্যুতে সরকারের সঙ্গে তাদের যে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল, সেটা আপাতদৃষ্টিতে অনেকখানি কেটে গেলো। এই ইস্যুতে যদি বিএনপিকে রাজপথে নামতে হতো, তাহলে সেখানে রক্তপাত, গ্রেফতার ও আটকের পাশাপাশি দেশের রাজনীতি ফের একটা অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে যাত্রা শুরু করতো। সুতরাং, এ বৈঠকের মধ্য দিয়ে যদি সেই সংঘাত এড়ানো গিয়ে থাকে, সেটি শুধু সরকার ও বিএনপি নয়, বরং দেশের জন্যও মঙ্গল।

 

এই বৈঠকের সবচেয়ে ভালো দিক হলো, আলাপ-আলোচনা ও সংলাপের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা কোনো সমস্যার সমাধানে পৌঁছাতে পারেন না, বরং রাজপথেই সমাধান করতে হয়—এই যে একটা দুর্নাম রয়েছে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসার একটি উপায় হতে পারে এই বৈঠক—যদি সত্যিই আগামী ফেব্রুয়ারিতে একটি অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ-গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশে একটি গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার সূচনা করা যায়।

লন্ডন বৈঠকের পরে ঢাকায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, ‘সবকিছু যে একটা অনিশ্চিত অবস্থায় চলে গিয়েছিল, সেই অবস্থা কাটিয়ে জাতিকে আবার সামনে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন দুই নেতা। এই বৈঠকে সফল হওয়ার মাধ্যমে তারেক রহমান তার রাষ্ট্রনায়কোচিত গুণ প্রমাণ করেছেন। এই দুই নেতা প্রমাণ করলেন যে, বাংলাদেশের মানুষ এখনো প্রয়োজনের সময় ঐক্যবদ্ধ হতে পারে, নেতারা নেতৃত্ব দিতে পারে।’

২. জামায়াত এই বৈঠককে স্বাভাবিক মনে করলেও বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতি দেওয়ায় প্রধান উপদেষ্টার নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন হয়েছে বলে মনে করে। জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পরেও লন্ডন সফরে গিয়ে একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করে বিদেশে যৌথ প্রেস ব্রিফিং এবং বৈঠকের বিষয়ে যৌথ বিবৃতি দেওয়াটা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ব্যত্যয় বলে মনে করে জামায়াত। সেই সাথে তারা মনে করে, এর মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা একটি দলের প্রতি বিশেষ অনুরাগ প্রকাশ করেছেন, যা তার নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন করেছে।

৩. এই সময়ের রাজনীতিতে একটি বড় শক্তি ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ মনে করে, তারেক রহমান ডিসেম্বর থেকে সরে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের প্রস্তাব দিয়েছেন, প্রধান উপদেষ্টাও শর্তসাপেক্ষে তা বিবেচনার কথা বলেন। নিজস্ব অবস্থানকে যৌক্তিক কারণে পুনর্বিবেচনা করার এ ঘটনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইতিবাচক দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

৪. জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) তাদের আগের অবস্থানে অনড় যে, তারা মনে করে, জুলাই ঘোষণাপত্র কার্যকর এবং বিচারের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার আগে নির্বাচন হতে পারে না। তারা ইউনূস-তারেক বৈঠকের পরে যে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়েছে, সেখানে বলেছে, নির্বাচন প্রশ্নে সরকার কেবল একটি রাজনৈতিক দলের অবস্থান ও দাবিকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে বলে বারবার প্রতীয়মান হচ্ছে। এনসিপি মনে করে, লন্ডনের বৈঠকে নির্বাচনের তারিখ–সংক্রান্ত আলোচনা যতটুকু গুরুত্ব পেয়েছে, অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে নাগরিকদের প্রধান দাবি তথা বিচার ও সংস্কার ততটুকু গুরুত্ব পায়নি। জুলাই ঘোষণাপত্র প্রণয়ন, জুলাই সনদ কার্যকর এবং বিচারের সুস্পষ্ট পথনকশা ছাড়া জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন গণঅভ্যুত্থানকে স্রেফ একটি ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমে পরিণত করবে বলেও মনে করে জাতীয় নাগরিক পার্টি।

প্রতিক্রিয়ার তাৎপর্য

রাজনৈতিক দলগুলোর এই প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে যে, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে প্রধান শক্তি হিসেবে পরিচিত এনসিপি ও জামায়াতের সঙ্গে সরকারের হয়তো একটা দূরত্ব তৈরি হলো। যদিও এই সরকার গঠিত হয়েছিল জুলাই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী সব দলের সমর্থনে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এর মধ্যে দু-একটি দল অধিকতর সরকারপন্থি বা কোনো কোনো দলের প্রতি সরকারের বিশেষ পক্ষপাত আছে বলে প্রতীয়মান হয়েছে। তার বিপরীতে সংস্কার ও নির্বাচন ইস্যুতে বিএনপির সঙ্গে সরকারের দূরত্ব ক্রমশ বাড়ছিল। এরকম বাস্তবতায় বিএনপির সঙ্গে সরকারের দূরত্ব কমে আসা এবং জামায়াত ও এনসিপির সঙ্গে সরকারের দূরত্ব তৈরিকে রাজনীতির নতুন মেরুকরণ হিসেবেই দেখতে হবে।

যদিও এখনই সব বিষয়ে উপসংহারে পৌঁছানোর সুযোগ নেই। কেননা ফেব্রুয়ারি আসতে এখনো প্রায় ৮ মাস বাকি। এই সময়ের মধ্যে দেশের রাজনীতিতে আরও কী কী মেরুকরণ ঘটবে; দেশের আইনশৃঙ্খলা ও অর্থনীতি, বিশেষ করে সীমান্ত পরিস্থিতি কেমন হবে তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করবে।

বলা হয়, বাংলাদেশের রাজনীতির অনেক ইস্যু বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের হাতে থাকে না। ভূরাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশ যেহেতু একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় অবস্থান করছে, ফলে এখানে প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তান ছাড়াও বৈশ্বিক পরাশক্তি চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের অনেক স্বার্থ রয়েছে। সুতরাং, বৈশ্বিক শক্তিগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা ও অন্তর্দ্বন্দ্বও অনেক সময় বাংলাদেশের রাজনীতির নিয়ামক হয়ে ওঠে। ফলে ইউনূস-তারেক বৈঠকের মধ্য দিয়ে সব রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা কেটে গেলো; ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে আর বিএনপি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করবে—রাজনীতির অঙ্কটা এত সরল নাও হতে পারে। এখনো অনেক ‘যদি কিন্তু’ রয়ে গেছে।

পরিশেষে, এই বৈঠকের সবচেয়ে ভালো দিক হলো, আলাপ-আলোচনা ও সংলাপের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা কোনো সমস্যার সমাধানে পৌঁছাতে পারেন না, বরং রাজপথেই সমাধান করতে হয়—এই যে একটা দুর্নাম রয়েছে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসার একটি উপায় হতে পারে এই বৈঠক—যদি সত্যিই আগামী ফেব্রুয়ারিতে একটি অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ-গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশে একটি গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার সূচনা করা যায়।

লেখক : সাংবাদিক ও লেখক।