Image description
রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি

পদোন্নতি, বদলি, চাকরিতে নিয়মিতকরণ ও ঠিকাদারিসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির পরিচালনা পর্ষদ সদস্য, পরিচালক এবং কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। দুর্নীতির এসব বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে হয় তদন্ত। আর তদন্তে এসব অভিযোগের প্রমাণ মিললেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ। সম্প্রতি রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির অনিয়মের সঙ্গে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতার তথ্য প্রকাশ পেলে বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসে। এমন পরিস্থিতিতে গত ১৮ মে (রোববার) অনিয়মের খোঁজে অভিযানও চালায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ ঘটনার পর থেকে ফারাবীকে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ম্যানেজিং বোর্ডের সদস্য পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে অভিযুক্ত বাকিরা এখনো বহাল তবিয়তে।

রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির অভিযোগ ও তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মুহাম্মদ তুহিন ফারাবীর বিরুদ্ধে বদলি, পদায়ন ও তদবির বাণিজ্যসহ ৩২০ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। এই অভিযোগে তাকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। সেইসঙ্গে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিতে দুদকের অভিযানের পর থেকে ফারাবীকে ম্যানেজিং বোর্ডের সদস্য পদ থেকেও সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

জানা গেছে, তুহিন ফারাবী স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ম্যানেজিং বোর্ড সদস্য হিসেবে প্রথম পর্যায়ে তিন মাস এবং পরবর্তী সময়ে চলতি বছরের ৫ মার্চ থেকে পরবর্তী ৬ মাসের জন্য নিয়োগ পান। তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতো রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিতেও দুর্নীতির সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বদলি, চুক্তিভিত্তিক চাকরি থেকে নিয়মিতকরণ, পদোন্নতি, পদায়ন, নিয়োগ ও টেন্ডার বাণিজ্য করেছেন। অন্যদিকে, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির বর্তমান ট্রেজারার মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম মুখ্য সংগঠক ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির বর্তমান ম্যানেজিং বোর্ড সদস্য ডা. মাহমুদা আলম মিতু এবং পরিচালক ইমাম জাফর শিকদারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি, বদলি, নিয়োগ ও পদায়ন বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। তুহিন ফারাবী ছাড়া অভিযুক্ত বাকিরা এখনো সোসাইটিতে রয়েছেন বহালতবিয়তে।

সোসাইটির ম্যানেজিং বোর্ডের একাধিক সদস্য অভিযোগ করে বলেন, ‘আর্ত মানবতার সেবায় নিয়োজিত রেড ক্রিসেন্টকে চোরের খনিতে পরিণত করা হয়েছে। তাদের অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলা যায় না, কথা বললে হেয়প্রতিপন্ন করা হয়। এসব নিয়ে সরকারের সজাগ দৃষ্টি দেওয়া দরকার।

তুহিন ফারাবীর যত অনিয়ম: স্বাস্থ্য উপদেষ্টার এপিএস হয়ে রেড ক্রিসেন্টের ম্যানেজিং বোর্ডের সদস্য হয়েই তুহিন ফারাবী সোসাইটির পরিচালক ইমাম জাফর শিকদারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নানা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। সোসাইটির মহাসচিব ড. কবীর মোহম্মদ আশরাফ, এইচআর বিভাগের কো-অর্ডিনেটর মো. নিজাম উদ্দিন, চেয়ারম্যানের বর্তমান পিএস আসিফ আলমাজ এবং লিগ্যাল অ্যাফেয়ার্সের আইনজীবী খোরশেদ আলম সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। তুহিন ফারাবী তার নিজের প্রভাব খাটিয়ে বন্ধু এবং ব্যবসায়িক অংশীদার মুনতাসীর মামুনকে নিয়মনীতি না মেনেই সরাসরি উপপরিচালক পদে যুব ও স্বেচ্ছাসেবক বিভাগে নিয়োগ দেন। গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সহযোগী হিসেবে পরিচিত মোহাম্মদ আমিনুল ইসলামকে সোসাইটির ট্রেজারার নিয়োগ দেন।

পরিচালক ইমাম জাফর শিকদারের অন্তহীন দুর্নীতি: সোসাইটির যুব স্বেচ্ছাসেবক প্রোগ্রামের পরিচালক থাকা অবস্থায় ইমাম জাফর শিকদার কোনো ধরনের কর্মসূচির আয়োজন না করেই যুব ও সহশিক্ষা কার্যক্রমের মিথ্যা তথ্য দেখিয়ে অবৈধভাবে সহশিক্ষার টাকা উত্তোলন করেন। শুধু তাই নয়, নিজে ফেঁসে যাবেন বুঝতে পেরে ইমাম জাফর শিকদার বাকি ১২ হাসপাতালের তদন্ত কার্যক্রম স্থগিত করেন। সোসাইটির অভ্যন্তরীণ তদন্তে এত অনিয়মের অভিযোগ প্রমাণের পরও ইমাম জাফর শিকদারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।

টেন্ডার বাণিজ্য: রেড ক্রিসেন্টে ইমাম জাফর শিকদার যোগদানের পর থেকে বেনামে ৩টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে টেন্ডার বাণিজ্য করে আসছেন। এস আলম প্রগ্রেসিভ এবং ফারহান ইঞ্জিনিয়ারিং নামের বেনামি তিন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি কাজ বাগিয়ে নিতেন।

সোসাইটির জাতীয় সদর দপ্তরে সহশিক্ষা কার্যক্রমের অর্থ দিয়ে প্রথম পর্যায়ে ৪ থেকে ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ট্রেনিং সেন্টার করার জন্য নামফলক উদ্বোধন করা হয়। পরে অর্থ আত্মসাতের উদ্দেশ্যে ৪ থেকে ৫ কোটি টাকার বাজেট পরিবর্তন করে ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে ট্রেনিং সেন্টার করার জন্য টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়।

নিয়োগ বাণিজ্য: রেড ক্রিসেন্টে যোগদানের পর থেকে তিনি নিয়োগ বাণিজ্য করে আসছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সিভি পাঠানোর পর যার সঙ্গে তার বেশি টাকার চুক্তি হয়, তাকেই তিনি নিয়োগের ব্যবস্থা করেন। হলি ফ্যামিলি মেডিকেল কলেজে ভর্তি এবং হলি ফ্যামিলি হাসপাতালসহ রেড ক্রিসেন্টের সব অঙ্গপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ ও ভর্তি নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন।

অবৈধভাবে আত্মীয়-স্বজনকে নিয়োগ: ইমাম জাফর শিকদার সোসাইটির সাবেক চেয়ারম্যানের মাধ্যমে তার ফুপাতো ভাই এ এস এম জাহিদুর রহমানকে সোসাইটির প্রশিক্ষণ বিভাগের উপসহকারী পরিচালক পদে নিয়োগ দেন। আরেক ফুপাতো ভাই সাইদুর রহমান সোহানকে কোস্টাল ডিআরআর প্রকল্পে প্রোজেক্ট অফিসার পদে নিয়োগ দেন। এ ছাড়া সাইদুর রহমানের স্ত্রী হামিদা বানুকে ডিসিআরএম বিভাগের স্লিপ প্রকল্পে কোনো নিয়োগ প্রক্রিয়া ছাড়াই ফাইন্যান্স অফিসার পদে নিয়োগ দেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস: গ্রিপ প্রকল্পের স্কিল ডেভেলপমেন্ট কর্মকর্তা পদে প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে পরিচালক ইমাম জাফর শিকদার সরাসরি জড়িয়ে পড়েন। এ নিয়ে গত বছরের ১৪ মে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সব বোর্ড সদস্যকে ম্যানেজ করে সেই যাত্রায় পার পেয়ে যান।

যুব ও স্বেচ্ছাসেবক প্রকল্পে দুর্নীতি: ইমাম জাফর শিকদার যুব ও স্বেচ্ছাসেবক বিভাগে যোগদানের পর থেকে দুর্নীতির যেন মহোৎসব শুরু করেন। দীর্ঘদিন যুব ও স্বেচ্ছাসেবক বিভাগে জাপান রেড ক্রসের অর্থায়নে জাপান ফ্রেন্ডশিপ প্রকল্প চলমান ছিল। প্রকল্পের আওতায় দেশের প্রায় ২৫ জেলায় রেড ক্রিসেন্ট ইউনিট পরিচালিত হতো। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কোনো ধরনের ট্রেনিং না করেই লাখ লাখ টাকার ভুয়া বিল বা ভাউচার দাখিল করে বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করেছেন।

পরিচালকের দুর্নীতির দুই প্রধান সহযোগী: ইমাম জাফর শিকদারের দুর্নীতির সব কাজের সহযোগী অফিস সহায়ক সুমন মিয়া। সুমনকে তিনি যে বিভাগে বদলি হয়ে যান সেখানে নিয়ে যান। এ ছাড়া গাড়িচালক সোহরাব চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন দুই বছর আগে। সোসাইটির গাড়ি না থাকায় অনেক চালক বসে বসে বেতন নিচ্ছেন। এমন অবস্থায় ইমাম জাফর শিকদার তার অবৈধ কাজে সহযোগিতার জন্য ৬৫ হাজার টাকা বেতনে সোহরাবকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়েছেন।

ডিসিআরএম বিভাগের চলমান বিভিন্ন প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎ: রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ডিসিআরএম বিভাগের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা দাতাদের অর্থে ৩০টি প্রকল্প চলমান। এসব প্রকল্পের মাধ্যমে দুস্থ ও অসহায় মানুষকে সহযোগিতার কথা থাকলেও সেই টাকা আত্মসাৎ করে ইমাম জাফর শিদকার নিজে নিচ্ছেন।

অবৈধ সম্পদের পাহাড়: ইমাম জাফর শিদকার সোসাইটিতে যোগদানের পর অবৈধ উপায়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন এবং তার নামে-বেনামে বিপুল সম্পদ রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ঢাকায় ৩ হাজার স্কয়ার ফুটের ফ্ল্যাট, যার দাম প্রায় ৩ কোটি টাকা, কক্সবাজারে হোটেলের শেয়ার ও ১টি ফ্ল্যাট, পুলিশ প্লাজায় ১টি ফ্ল্যাট, উত্তরার দিয়াবাড়ীতে ১টি ফ্ল্যাট এবং রেড ক্রিসেন্ট সুরমা ভবনে রয়েছে ১টি ফ্ল্যাট। এ ছাড়া রয়েছে বরিশাল, পটুয়াখালীতে জমি-বাড়ি, বিভিন্ন ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা ও ব্যক্তিগত ২টি গাড়ি।

তবে নিজের বিরুদ্ধে ওঠা বিস্তর এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ইমাম জাফর শিকদার। তিনি বলেন, ‘পেশাগত প্রতিহিংসা থেকে আমার বিরুদ্ধে এসব মিথ্যা অভিযোগ উপস্থাপন করা হচ্ছে। এসব অনিয়মের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমি ষড়যন্ত্রের শিকার।’

পরিচালনা পর্ষদ সদস্য ফারাবীর বক্তব্য জানতে তার মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করে এবং কল করার কারণ জানতে বার্তা পাঠিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি।

এ ছাড়া রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল অধ্যাপক ডা. মো. আজিজুল ইসলামের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করে ও বার্তা পাঠিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি।