Image description

ড. মুহাম্মাদ সাইদুল ইসলাম

সহকারী অধ্যাপক, নানইয়াং টেকনোলোজিকাল ইউনিভার্সিটি (NTU), সিঙ্গাপুর

নতুন সময়ের দাবিতে নতুন রাজনৈতিক ঐক্য
বাংলাদেশ এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব রাষ্ট্রকে একটি অস্থির, একদলীয় ও দমনমূলক অবস্থান থেকে ধাক্কা দিয়ে বের করে এনেছে। কিন্তু ইতিহাস জানে, বিপ্লবের চেয়েও কঠিন তার উত্তরাধিকার রক্ষা—গঠনের রাজনীতি, ন্যায়ভিত্তিক পুনর্গঠন, এবং দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা। সেজন্য প্রয়োজন একটি মৌলিক রাজনৈতিক বন্দোবস্ত (political settlement), যা ন্যায়ের ভিত্তিতে টেকসই গণতন্ত্র ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবে।

নতুন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কোনো একক দলের হাতে নয়; এটি সকল নাগরিকের সম্মিলিত স্বপ্ন ও সংগ্রামের ফল। রাজনৈতিক মতপার্থক্য সত্ত্বেও অন্তত নয়টি মৌলিক প্রশ্নে সমস্ত রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে একটি নির্ভরযোগ্য ঐকমত্য আবশ্যক। এই ঐকমত্যের ভিত্তিতে গড়ে উঠতে পারে এক “ঐতিহাসিক নয়া জামানার ইশতেহার”, যার রূপরেখা নিচে তুলে ধরা হলো।

১.⁠ ⁠সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় অখণ্ডতার প্রশ্নে আপসহীন ঐক্য: 
নতুন বাংলাদেশকে প্রথমেই দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করতে হবে যে—এটি কারো উপনিবেশ নয়, কারো প্রভাব-প্রত্যাশার ক্ষেত্র নয়। দেশের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা রক্ষায় রাজনৈতিক মতাদর্শের পার্থক্যকে পাশে রেখে একক কণ্ঠে কথা বলা জরুরি। দেশের অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্তে কোনো বিদেশী হস্তক্ষেপ কিংবা আধিপত্য গ্রহণযোগ্য হবে না—এমন জিরো টলারেন্স নীতি দলমত নির্বিশেষে গৃহীত হওয়া দরকার।

২.⁠ ⁠দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক আন্দোলন: 
দুর্নীতি শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়; এটি রাষ্ট্রের নৈতিক ভিত্তিকে ধ্বংস করে দেয়। ব্যক্তিগত, প্রাতিষ্ঠানিক ও রাজনৈতিক স্তরে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের নীতি অবলম্বন করতে হবে। দুর্নীতির অভিযোগ দ্রুত তদন্ত, বিচার এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এটাই হবে জনগণের আস্থা অর্জনের প্রথম ধাপ।

৩.⁠ ⁠স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সাংবিধানিক ব্যবস্থা: 
নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের অন্যতম ভিত্তি হতে হবে জবাবদিহিতা। প্রতিটি দলকে বছরে অন্তত একবার জনসম্মুখে আয়-ব্যয়ের হিসাব দিতে হবে। সরকারি সিদ্ধান্ত ও নীতিনির্ধারণে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। রাষ্ট্র চালাতে হলে জনগণের প্রতি জবাবদিহি থাকা অপরিহার্য।

৪.⁠ ⁠সহনশীল রাজনীতি ও মতপার্থক্যের মর্যাদা: 
নতুন বাংলাদেশে প্রতিপক্ষ থাকবে, কিন্তু শত্রু থাকবে না। রাজনৈতিক মতপার্থক্যকে অগ্রগামী শক্তি হিসেবে দেখা হবে, বিদ্বেষের হাতিয়ার নয়। গুম, খুন, হুমকি বা ক্রসফায়ার-নির্ভর রাজনীতি চিরতরে পরিত্যাগ করতে হবে। রাজনীতির ভাষা হবে যুক্তি, সমঝোতা ও জনসেবার।

৫.⁠ ⁠ধর্মীয় সহাবস্থান ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান: 
ধর্ম হবে নৈতিকতার শক্তি, বিভাজনের হাতিয়ার নয়। কোনো ধর্মের অনুভূতিতে আঘাত কিংবা ধর্মীয় উগ্রতার রাজনৈতিক ব্যবহার সর্বাত্মকভাবে নিষিদ্ধ হবে। একই সঙ্গে জঙ্গিবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষ ঘৃণাচর্চার বিরুদ্ধেও একইভাবে কড়া অবস্থান নিতে হবে।

৬.⁠ ⁠নতুন রাজনীতির চেতনা: সুবিচার ও সম্প্রীতির ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠন: 
"চেতনার রাজনীতি" নামক বিভাজনমূলক ডিসকোর্স পরিহার করে সামাজিক সুবিচার, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তিকরণকে নতুন রাষ্ট্রের চালিকাশক্তি করতে হবে। প্রতিযোগিতা হবে নীতির, সেবার ও আদর্শের—ঘৃণা, প্রতিহিংসা ও ষড়যন্ত্রের নয়।

৭.⁠ ⁠রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর "পলিটিকাল ওয়াচ" ও জনজবাবদিহিতা: 
স্বাধীন এবং বুদ্ধিজীবী নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় “পলিটিকাল ওয়াচ” কমিটি মাসিক ভিত্তিতে দলগুলোর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের অগ্রগতি মূল্যায়ন করবে। জনগণের অংশগ্রহণে এ কমিটি রাজনৈতিক অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করবে।

৮.⁠ ⁠অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন ও সামাজিক সুরক্ষা: 
উন্নয়ন হবে সার্বজনীন—গ্রামের, শহরের, গরিবের, সংখ্যালঘুর, নারীর। রাষ্ট্র শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, পরিবেশ, শিশু সুরক্ষা ও প্রবীণ সেবায় এক মানবিক নীতি গ্রহণ করবে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে মানুষের মর্যাদা-ভিত্তিক।

৯.⁠ ⁠তরুণ নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক নবায়নের অঙ্গীকার: 
নতুন প্রজন্ম শুধু ভোটার নয়, নেতৃত্বও। তরুণদের রাজনৈতিক শিক্ষা, সামাজিক উদ্যোগ, ও স্বেচ্ছাসেবার মাধ্যমে একটি উদ্ভাবনী, দায়বদ্ধ এবং গতিশীল নেতৃত্ব গড়ে তোলা হবে। নতুন বাংলাদেশে রাজনীতি হবে তাদের হাতেই এক প্রাণবন্ত প্রতিষ্ঠান।

নতুন রাজনৈতিক চুক্তির আহ্বান এই মুহূর্তে আমাদের প্রয়োজন একটি “নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত”, যা বিভেদ নয়, ঐক্যের ভিত্তিতে গড়ে উঠবে। একে কেন্দ্র করেই ভবিষ্যতের বাংলাদেশ হবে গণতান্ত্রিক, উন্নয়নমুখী, জবাবদিহিমূলক এবং মানবিক। এটি কোনো নির্দিষ্ট দলের নয়—এই বাংলাদেশ আমাদের সকলের। এই আহ্বান শুধু একটি রাজনৈতিক প্রস্তাব নয়, এটি একটি নৈতিক ও নাগরিক অঙ্গীকার—যেখানে প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি প্রতিষ্ঠান, প্রতিটি রাজনৈতিক দল দায়িত্ববান ভূমিকা পালন করবে। এভাবেই ইতিহাসে রচিত হবে একটি সত্যিকার অর্থে নতুন বাংলাদেশের রূপরেখা।

[এই নিবন্ধটি লেখকের ব্যক্তিগত মতামত এবং গবেষণার ভিত্তিতে রচিত।]