প্রিয় তুনাবী
কেমন আছো?
এতদিন পরে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছো যে তোমার মতো শেখ হাসিনা কখনও প্রেমিক ছিল না! প্রেমিক হলে প্রেমের ময়দান থেকে কেউ পালাতে পারে না। শেখ হাসিনা যেমন বলতেন– ‘শেখ হাসিনা পালায় না, পালাবে না!’ তবু লক্ষ-কোটি সমর্থকদের বিপদে ফেলে তিনি পালাতে পেরেছেন।
তুনাবী, তোমার পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা শুধু আমি জানতাম। শেখ হাসিনার পলায়নের ঘটনা পৃথিবীর সবাই জানে! ভোগবাদী শাসকদের কেউ কেউ দেশের মাটি আঁকড়ে থাকার শেষ চেষ্টা করেন। হোক সেটা ইরাকের সাদ্দাম হোসেন কিংবা লিবিয়ার মুয়াম্মার গাদ্দাফি। কিন্তু সিরিয়ার বাশার আল আসাদ কিংবা শেখ হাসিনাকে শেষমেশ পালিয়ে বাঁচতে হয়। মাটির ভেতর পলাতক বৃক্ষের কোনও শেকড় থাকে না। বাশার এবং হাসিনার কারণে তাদের পিতা, দেশের জন্য যাদের মনে রাখার মতো অবদান ছিল, তারাও মরণোত্তর নিগ্রহের সম্মুখীন হয়েছেন। গণ-অভ্যুত্থান শুধু বুকেই টানে না, কাউকে কাউকে মাটিতেও ছুড়ে ফেলে দেয়।
অথচ তুনাবী, ড. ইউনূসের কথাই ভাবো। ২০২৪ শুরু হয়েছিল তার দণ্ড দিয়ে। জানুয়ারিতে শ্রম আদালত তাকে ছয় মাসের দণ্ড দিয়েছিল। সেই তিনি এখন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। আর্থিক দণ্ড কিংবা মামলাও নেই এখন আর। ক্ষমতায় থাকলে মামলা থাকে না, মামলা দানব হয়ে আসে পতনের পর। পতিত শেখ হাসিনার নামে কতগুলো মামলা হয়েছে সেই হিসাব কষতে ক্যালকুলেটর লাগবে।
তুনাবী, আমি তোমার ডামি প্রেমিক ছিলাম কিনা জানি না, ২০২৪-এর জানুয়ারিতে আওয়ামী সরকার এক মহা তামাশার ‘ডামি’ নির্বাচনের আয়োজন করেছিল, যেখানে জিতলেও আওয়ামী লীগ, হারলেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতো। ২৮০ আসনে জেতার পরেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। মন্ত্রী, নেতা, এমপি, চেয়ারম্যান, মেম্বার, মেয়র, ডিসি, পুলিশের আইজি, ডিআইজি, এসপি, সাংবাদিক এমনকি মসজিদের ইমামরাও পালিয়েছেন। সারা পৃথিবীতে পলায়নের এমন রেকর্ড আর নাই!
তুনাবী, আনন্দ আর বেদনার ঘটনা হাত ধরে হেঁটেছে ২০২৪ সালে। বাংলার মেয়েরা অনূর্ধ্ব ১৬ সাফ ফুটবলের শিরোপা জিতেছে ভারতকে হারিয়ে। ক্রিকেটে যেমন ভারত ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে হেরেছে বাংলাদেশ, তেমনি জিতেছে টেস্টে পাকিস্তান ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে টি টোয়েন্টি ম্যাচে। কিন্তু ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে বেইলি রোডের একটি ভবনে আগুন লেগে মারা যায় ৪৬ জন। রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়ে অঙ্গার হয়ে ফেরেন তারা। তুনাবী, আমাকে তুমি জিম্মি করে রাখলেও তোমাকে কিছু সময়ের জন্য দেখতে পেতাম। যেমন করে সোমালিয়ার জলদস্যুরা জিম্মি করে রেখেছিল বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহকে।
২০২৪-এর মার্চ থেকে শুরু করে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত ২৩ জন নাবিকের জীবনে একরকম দোজখ নেমে এসেছিল। শেষমেশ মুক্তিপণের বিনিময়েই মুক্তি পান তারা। নাবিকদের কোনও ক্ষতি না হলেও এই দুঃসহ স্মৃতি বয়ে বেড়াতে হবে বহুদিন।
তুনাবী, ঘৃণার সর্বোচ্চ প্রয়োগ কি খুন? খুন করার পর কি খুনির মন প্রশমিত হয়? ডামি ভোটে নির্বাচিত ঝিনাইদহ-৪ আসনের এমপি আনোয়ারুল আজিম ভারতে গিয়েছিলেন চিকিৎসা নিতে। আটদিন পর জানা যায় তিনি খুন হয়েছেন, খুনিদের ভাড়া করা কসাই তার দেহ টুকরো টুকরো করে লুকোনোর চেষ্টা করেছিল! তুনাবী, প্রেমের মতো খুনও চাপা থাকে না, বেরিয়ে আসে চাঁদ বা সূর্যের মতো।
পুলিশের গুলিতে মরে যাওয়া সবাই অবশ্য চাঁদ বা সূর্যের মতো দেদীপ্যমান হন না, কেউ কেউ হন। ১৯৮৭ সালে যেমন হয়েছিলেন নূর হোসেন, তেমনি ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই বুক চিতিয়ে দাঁড়ানোর পর পুলিশের গুলিতে নিহত আবু সাঈদ হয়েছেন আত্মত্যাগের আইকন। আবু সাঈদের মৃত্যু পরিস্থিতি বদলে দেয়। বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো মানুষ নেমে আসতে থাকে খোলা রাজপথে। সে এক অসাধারণ অভূতপূর্ব মানুষের সম্মিলন। মানুষ জাগলে পাহাড়ও ভেঙে পড়ে। শেখ হাসিনার ক্ষমতার চেয়ারও উল্টে যায়। জুলাই অভ্যুত্থানে সারা দেশে ৮৫৮ জন নিহত হন, আহত হন কয়েক হাজার। ১৯৭১-এর পর মানুষের এমন স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ আর দেখা যায়নি। পতনের আগে শেখ হাসিনা প্রজ্ঞাপন জারি করে জামায়াত শিবিরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। নিয়তি এই যে ড. ইউনূসের সরকার একই স্টাইলে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করেছে।
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হবে কিনা সময়ই বলে দেবে। যদিও নিষিদ্ধ করে কোনও লাভ হয় না, যার ফেরার কথা সে ফিরবেই, মানুষ চাইলে আওয়ামী লীগও একদিন পুনর্বাসিত হবে। না চাইলে কোনও একদিন মুসলিম লীগের পরিণতি ভোগ করতে হবে। তাই ৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান কিংবা ৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধের গর্বিত অংশীদার আওয়ামী লীগ এখন পলাতক!
তুনাবী, শেখ হাসিনা তাও পালাতে পেরেছেন, শেয়ার বাজারের অগণিত বিনিয়োগকারী পালাতেও পারেননি, অনেকে পাওনাদারের টাকা বা বাসা ভাড়া দিতে না পারায় নিজেদের আড়াল রেখেছেন। আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতায় আসে শেয়ার বাজারে ক্রমাগত ধস নামে। শেয়ার বাজারে কারসাজির জন্য বহুদিন ধরে হাসিনা সরকারের শিল্প উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানকে দায়ী করা হচ্ছিল।
২০২৪ সালে ক্রিকেটার কাম এমপি সাকিব আল হাসানের নামেও অভিযোগ উঠেছে। হাসিনা নেই তবু শেয়ার বাজার এখনও উঠে দাঁড়াতে পারেনি।
উঠে দাঁড়াতে পারেনি জুলাই বিপ্লবে নিহত এবং আহতদের পরিবার। তারা রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছিলেন। একাত্তরের শহীদদের মতো হয়তো স্বজন হারানো বেদনাই তাদের আজীবনের সম্বল হবে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। এখনও বোঝা যাচ্ছে না পুলিশ কবে আবার আগের মতো সক্রিয় হতে পারবে। রাজারবাগ পুলিশ লাইনের বিদ্রোহ দিয়ে যে পুলিশের শুরু সেই পুলিশ ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের এমন পেটোয়া বাহিনীতে রূপান্তরিত কী করে হলো?
তুনাবী, প্রেম আর ক্ষমতার একটা জিনিস হয়তো এক। দুটোকেই ধরে রাখতে হয়। তোমাকে আমি যেমন ধরে রাখতে পারিনি, তেমনি পুলিশ ধরে রাখতে পারেনি তার ইমেজ।
তুনাবী, এই চিঠি তুমি পড়বে কিনা জানি না, তোমাকে লেখা অভিমানের কোনও অভিযোগ হচ্ছে কিনা জানি না, মনে হচ্ছে ড. ইউনূসের সরকারও তার ইমেজ ধরে রাখতে পারছেন না!
তুনাবী, তবু শেষ ভরসা মানুষই। মানুষ জাগতে শিখেছে। ২০২৪ সালের আগস্টে যে ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল ফেনী, নোয়াখালী, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটের বিভিন্ন অঞ্চলে, সেখানে মানুষের অংশগ্রহণ ছিল চোখের পড়ার মতো। যদিও শেরপুর অঞ্চলের বন্যায় তেমনটা দেখা যায়নি, তবু দেশের প্রয়োজনে মানুষ নামবেই খোলা রাজপথে। হাসিনার পতনের পর বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া মুক্তি পেলেও তুনাবী তোমার কাছ থেকে আমার কোনও মুক্তি নেই।
যেমন করে এ বছর কারাগারে মারা গেছেন রাশিয়ার বিরোধীদলীয় নেতা অ্যালেক্সি নাভালনি, হয়তো তেমন করেই একদিন মরে পড়ে থাকবো নিজ ঘরে। তুমি জানতেও পারবে না।
তুনাবী, তুমি হয়তো জানো দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া বিচারপতিদের কেউ কেউ পদত্যাগ করেছেন, একইরকম বিবেচনায় বিচারপতিদের নতুন নিয়োগ হয়েছে, চরে ভিড়ে থাকা জাহাজের ভেতর সাত জন খুন হয়েছে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি কমানো যায়নি। নতুন স্বাধীনতার নামে একাত্তরের স্বাধীনতাকে অস্বীকারও করতে চাইছেন কেউ কেউ। তুনাবী আমার প্রেমকেও কি তুমি অস্বীকার করো?
তুনাবী, অস্বীকার করতে পারবে না যে সেক্রেটারিয়েটেও আগুন লাগতে পারে। যেখানে দিনের বেলাতেও মানুষ অনুমতি ছাড়া যেতে পারে না সেখানে কারা আগুন লাগায়? চট্টগ্রামে চিন্ময়কে গ্রেফতারের পর কীভাবে খুন হন আইনজীবী আলিফ?
তুনাবী, সব প্রশ্নের উত্তর সহসা পাওয়া যায় না। বারবার বেদনার সব কথা মানুষ বলে না। আগুন নিয়ে যে লাইনটা বারবার বলতে মনে আছে সেটা? আগুন আর কতটুকু পোড়ে? মানুষে পোড়ালে কিছুই রাখে না কিছুই থাকে না যিনি লিখেছিলেন, যিনি লিখেছিলেন এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাওয়ার তার শ্রেষ্ঠ সময়, সেই কবি হেলাল হাফিজ মারা গেছেন। মারা গেছেন যদি হিমালয় হয়ে দুঃখ আসে কিংবা সরলতার প্রতিমা খ্যাত গায়ক খালিদ।
খালিদ ভাইয়ের মৃত্যুর পরও তোমাকে মনে পড়েছে তুনাবী। খালিদ ভাইয়ের আরেক জনপ্রিয় গান- ‘কোনও কারণেই/ কোনও কারণেই ফেরানো গেল না তাকে’ বারবার শুনেছি। ভেবে নিতে বাধ্য হয়েছি যেকোনও আয়োজন দিয়েই তোমাকে আর ফেরানো যাবে না!
কিন্তু শেখ হাসিনাকে তাড়িয়ে যে বাংলাদেশকে ফেরাতে চেয়েছিল ছাত্র জনতা সেই বাংলাদেশ কি ফিরবে কখনও? পাওয়া যাবে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ, যেখানে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি থাকবে না, কেনাকাটা করে স্বাচ্ছন্দ্যে বেঁচে থাকতে পারবেন সাধারণ আয়ের মানুষ? তোমাকে পাবো না তুনাবী কিন্তু কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ কি পাবো কখনও?
শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য সারা দেশে ভারত বিরোধিতা এখন চোখে পড়ার মতো। ভারত বিরোধিতার ব্যানারে কেউ কেউ কি সাম্প্রদায়িকতার নামে ঘৃণার চাষ করেছেন? তুনাবী, তুমি স্পষ্টত প্রেমে বৈষম্য তৈরি করেছিলে। মনে রেখো একাত্তর কিংবা চব্বিশ আমাদের নিয়ে যাবে বৈষম্যহীন বাংলাদেশের দিকে। তোমাকে নিয়ে আমি নিরাশার সাগরে ডুবেছি তুনাবী। বাংলাদেশের নতুন স্বপ্নকে হারাতে পারবো না। ব্রিটিশ প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য ইকোনমিস্ট যেভাবে বাংলাদেশকে বর্ষসেরা দেশের মর্যাদা দিয়েছে সেই মর্যাদার আনন্দে আমি ভাসতে চাই। হেলাল হাফিজের ভাষায় তাই বলি-
আর না হলে যত্ন করে ভুলেই যেও
আপত্তি নেই।
গিয়ে থাকলে আমার গেছে কার কী তাতে?
তুনাবী, তোমার মতো ২৪-এর স্বপ্নের সঙ্গে যারা বেইমানি করবে তাদের পরিণতিও যেন শেখ হাসিনার মতো হয়।
মনে রেখো, একাত্তরকে অস্বীকার করে কিংবা ছোট করতে গিয়ে আর যাই হোক, দেশপ্রেম হয় না।
বাংলাদেশ ছাড়া আমার আর কোনও সম্বল নেই। তুনাবী, নতুন করে জেগে ওঠা আমার লাল টুকটুক স্বপ্নকে বেচতে পারবো না।
ভালো থেকো তুনাবী।
ইতি-
তোমার চালচুলোহীন মুনাদ।
লেখক: রম্যলেখক