জুলাই বিপ্লবে উৎখাত হয়ে দিল্লির আশ্রয়ে থেকে দেশবিরোধী নানা অপতৎপরতায় লিপ্ত শেখ হাসিনা। কখনও দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে তা রেকর্ড করে ফাঁস করছেন। আবার কখনও-বা দলীয় কোনো জমায়েতে ভার্চুয়ালি যোগ দিয়ে নানা ধরনের উসকানিমূলক মিথ্যা ও ভিত্তিহীন বক্তব্য দিয়ে বাংলাদেশে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির অপচেষ্টা চালাচ্ছেন।যে কোনো মুহূর্তে তিনি দেশে ফিরে আসবেন, তিনি পদত্যাগ করেননি, তিনি এখনও প্রধানমন্ত্রী, দেশে গণহত্যার জন্য ড. ইউনূস দায়ী, ড. ইউনূস ও তার সঙ্গীদের খুনের দায়ে বিচার হবে, যেহেতু আমার বিরুদ্ধে ২২৭টি খুনের মামলা হয়েছে, তাই ২২৭টি খুন তো করাই যায়, যারা আমাদের ঘরবাড়িতে হামলা করছে, তাদের কাউকে ছাড়া হবে না, তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিতে হবে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের হত্যা করছে ইউনূস সরকারÑ এ ধরনের উসকানিমূলক বক্তব্য ও বিবৃতি দিয়েই চলেছেন শেখ হাসিনা।
সর্বশেষ শেখ হাসিনা সেনাবাহিনীতে উত্তেজনা সৃষ্টির অপচেষ্টা চালিয়ে বলেছেন, ইউনূস সরকারের কারণে ভবিষ্যতে শান্তি মিশনে যেতে পারবে না সেনাবাহিনী। ভারতের সবুজ সংকেত পেয়েই এ ধরনের অপতৎপরতায় লিপ্ত হয়েছেন শেখ হাসিনা। কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের প্রশ্রয় পেয়ে শেখ হাসিনা যা করছেন, তা আন্তর্জাতিক রীতিনীতি ও কূটনৈতিক শিষ্টাচারের চরম পরিপন্থী।বিশিষ্ট কূটনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক এম শহীদুজ্জামান বলছেন, শেখ হাসিনার এ অপতৎপরতা দিনশেষে ভারতের জন্যই সবচেয়ে বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেছেন, দিল্লিতে বসে শেখ হাসিনা যা করছেন, তা দুই দেশের সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ভারতের অবশ্যই উচিত শেখ হাসিনাকে থামানো। এদিকে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি বিষয়টির ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, দিল্লিতে শেখ হাসিনার উপস্থিতি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াবে না।
উল্লেখ্য, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার বিপ্লবে উৎখাত হন শেখ হাসিনা। প্রাণ বাঁচাতে তিনি পালিয়ে যান ভারতে। কঠোর নিরাপত্তাবেষ্টনীতে দিল্লির এক সেফ হাউসে ঠাঁই হয়েছে তার। শেখ হাসিনার উৎখাতে প্রাণ গেছে প্রায় ২ হাজার মানুষের। ছাত্র, সাধারণ মানুষ, রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে শিশুরাও রয়েছে এ তালিকায়। আর পঙ্গুত্ববরণ করেছেন কতশত মানুষ তার প্রকৃত হিসাব আজও অজানা।৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালানোর পর এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আচমকা এক বিবৃতি দিয়ে রীতিমতো উত্তেজনা ছড়ানোর চেষ্টা করেন।১৩ আগস্টের এ বিবৃতিতে শেখ হাসিনা জুলাই বিপ্লবে অংশগ্রহণকারীদের সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে তাদের বিচার দাবি করেন। তিনি বলেন, আন্দোলনের নামে যারা মানুষ খুন করেছে, সরকারি প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর করে আগুন দিয়েছে, তদন্তের মাধ্যমে তাদের শাস্তি দিতে হবে। শেখ হাসিনা তার ওই বিবৃতিতে দলের নেতাকর্মীদের ১৫ আগস্ট রাজপথে নেমে আসার আহ্বান জানান। শেখ হাসিনার ওই বিবৃতি রীতিমতো বিস্ময়ের জন্ম দেয় সবার মধ্যে। এত রক্ত ঝরানোর পরও কোনো ধরনের অনুশোচনা নেই তার।
দিল্লির আশ্রয়ে শেখ হাসিনার এ উসকানিমূলক বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে কড়া প্রতিক্রিয়া দেখান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গত ৫ সেপ্টেম্বর ভারতীয় সংবাদ সংস্থা পিটিআইয়ের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, শেখ হাসিনাকে অবশ্যই তার মুখ বন্ধ রাখতে হবে।তিনি বলেন, বাংলাদেশে প্রত্যর্পণ না করা পর্যন্ত ভারত যদি শেখ হাসিনাকে রাখতে চায়, তবে প্রথম শর্ত হলো, তাকে চুপ থাকতে হবে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে বসে যে রাজনৈতিক বক্তব্য দিচ্ছেন তা অবন্ধুসুলভ আচরণ। দুই দেশের অস্বস্তিকর পরিস্থিতি এড়াতে ভারতকে অবশ্যই শেখ হাসিনাকে চুপ রাখতে হবে। তিনি বলেন, ভারতে শেখ হাসিনার অবস্থানের কারণে কেউ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে না। কারণ আমরা তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করতে চাই।
শেখ হাসিনার দিল্লিতে অবস্থান নিয়ে ড. ইউনূসের এ প্রতিক্রিয়াকে ভালোভাবে নেয়নি ভারত সরকার। ড. ইউনূসের বক্তব্যের পর একের পর এক ফাঁস হতে থাকে শেখ হাসিনার ফোনালাপ। গত ১২ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী তানভীর নামের এক আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে শেখ হাসিনার কথোপকথনের একটি অডিও রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ওই ফোনালাপে তানভীর শেখ হাসিনাকে বলেন- আপা, আপনাকে নাকি গজিয়াবাদ থেকে হেলিকপ্টারে করে দিল্লিতে ট্রান্সফার করা হয়েছে। এর জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘কী সব আজগুবি কথা বলে ওরা।
আমি দেশের খুব কাছাকাছি আছি। অতদূরে নাই। আমি খুব কাছাকাছিই আছি, যাতে যে কোনো সময় চট করে দেশের মধ্যে ঢুকে পড়তে পারি।’ শেখ হাসিনা ওই ফোনালাপে তানভীরকে নির্দেশনা দিয়ে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে একের পর এক হত্যা মামলা দেওয়া হচ্ছে। এগুলো কীভাবে জাতিসংঘে তোলা যায় সেই চেষ্টা কর। এছাড়া মার্কিন নির্বাচনের ক্যাম্পেইনে নিজেদের যুক্ত রাখো এবং আমাদের বিষয়গুলো তাদের জানিয়ে রাখো।এটা ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। এরপর গত ৪ অক্টোবর শেখ হাসিনার আরেকটি ফোনালাপ ফাঁস করা হয়। ওই ফোনালাপে শেখ হাসিনা তার বিরুদ্ধে যারা হত্যা মামলা করছে, তাদের হত্যার হুমকির পাশাপাশি আওয়ামী লীগ বিরোধীদের ঘরবাড়িতে আগুন দিতে নির্দেশ দেন। গোপালগঞ্জ সদর থানা ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক সায়েম খানের সঙ্গে ফোনালাপে শেখ হাসিনা বলেন, দেখো এ সরকার কয়দিন থাকে। ডিসেম্বর পর্যন্ত হয়তো টিকবে না।
আমি আবার ক্ষমতায় ফিরে আসছি। এবার সবকিছুর প্রতিশোধ নেওয়া হবে। পুলিশ, সরকারি কর্মকর্তা এবং যারাই আওয়ামী লীগের বিপক্ষে কাজ করছে, তাদের তালিকা তৈরির নির্দেশ দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, এক মাঘে শীত যায় না, গুনে গুনে হিসাব নেওয়া হবে। আমি গত ১৫ বছর ধরে পুলিশের বেতন বাড়িয়েছি। আর্মিদেরও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করে দিয়েছি। আর এখন যারা সুদখোর ইউনূসের কথায় লাফাচ্ছে তাদের কাউকে ছাড়া হবে না।শেখ হাসিনা ওই ছাত্রলীগ নেতাকে উদ্দেশ করে বলেন, যারা আমাদের ঘরবাড়িতে আগুন দিচ্ছে, তাদের কি ঘরবাড়ি নেই? সবকিছু কি মুখে বলতে হবে? আমাদের ঘরবাড়ি না থাকলে তাদেরও থাকবে না।শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে ২২৭টি হত্যা মামলা হয়েছে। এখন তো ২২৭টি খুন করাই যায়। এক খুনের যে শাস্তি, ২২৭ খুনেরও সেই শাস্তি। তিনি বলেন, ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে আমি কাউকে কিছু বলিনি।
এবার ছাড়া হবে না। যারা আমাদের গায়ে হাত দিয়েছে, আমি তাদের প্রত্যেককে একটা শিক্ষা দিয়েই ছাড়ব। আমি যা বলি, আমি তা করি। শেখ হাসিনার এ চরম উসকানিমূলক ফোনালাপে ছাত্রলীগের ওই নেতাকে বলতে শোনা যায়, নেত্রী, আপনি আপনার মাথাটা একটু ঠান্ডা রাখেন। অর্থাৎ একজন স্থানীয় পর্যায়ের নেতাও জানে তার নেত্রীর মাথার অবস্থা কী।এবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ী হওয়ার পর গত ৮ নভেম্বর শেখ হাসিনার একটি চাঞ্চল্যকর ফোনালাপ ফাঁস হয়। ওই ফোনালাপে শেখ হাসিনা এক আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে শহীদ নূর হোসেন দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগের কর্মসূচি নিয়ে কথা বলেন। শেখ হাসিনা নূর হোসেন দিবসে দলীয় নেতাকর্মীদের ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছবি হাতে নিয়ে মিছিল করার নির্দেশ দেন।
তিনি বলেন, মিছিলের সময়ে প্ল্যাকার্ডে আমার কোনো ছবি থাকবে না। ছবি থাকবে ট্রাম্পের। তখন ওই মিছিলে কেউ যদি বাধা দেয় বা হামলা করে, তাহলে সেটা ট্রাম্পের ছবিতে হামলা হবে। সেই ছবি তোলার জন্য আলাদা লোক থাকবে। কোনোভাবেই যেন ছবি মিস না হয়। সে হামলার ছবি আমি ট্রাম্পের কাছে পাঠাব। ট্রাম্পের সঙ্গে আমার ভালো যোগাযোগ আছে। শেখ হাসিনা আরও বলেন, বাধা দেওয়ার ছবি ট্রাম্পকে পাঠিয়ে বলা যাবে দেখো ইউনূস সরকার কী করছে। সবচেয়ে বড় স্বৈরাচার তো ইউনূস।গত ১৮ নভেম্বর এক অডিও বক্তৃতায় শেখ হাসিনা ডেনমার্ক আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে ড. ইউনূস সরকারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিকভাবে জনমত গঠনের নির্দেশনা দিয়ে বলেন, তোমরা যে দেশে আছ, সেখানে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্টে বাংলাদেশ পরিস্থিতি তুলে ধরে আন্তর্জাতিক জনমত গড়ে তোল।
ড. ইউনূস জঙ্গিদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। খুনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি সন্ত্রাসী রাষ্ট্রে পরিণত করেছে ড. ইউনূস। ১৫ জুলাইয়ের পর থেকে যত হত্যাকাণ্ড হয়েছে তা পরিকল্পিতভাবে ড. ইউনূসই ঘটিয়েছে। তোমরা এগুলো তুলে ধর। শেখ হাসিনা ড. ইউনূসের বিচারের হুমকি দিয়ে বলেন, দেশটাকে এখন লুটে খাচ্ছে ওরা। ড. ইউনূস তার সমস্ত চ্যালাচামুণ্ডা এবং ছাত্র-সমন্বয়ক সবারই বিচার করা হবে। ২১ নভেম্বর অস্ট্রিয়া আওয়ামী লীগ নেতাদের উদ্দেশে দেওয়া শেখ হাসিনার আরও একটি অডিও বক্তৃতা ফাঁস হয়।প্রায় ১৫ মিনিটের ওই বক্তৃতার পুরোটাই ছিল হুমকি আর মিথ্যাচারে পরিপূর্ণ। শেখ হাসিনা তার বক্তৃতায় আয়নাঘরের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, এখন আয়নাঘরের কথা বলা হচ্ছে। কোথায় আয়নাঘর, পারলে দেখাক। গুম খুন তো ইউনূস ও তার সহযোগীরা করছে। কয়েক হাজার পুলিশ হত্যা করেছে। আমাদের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে খুন করা হয়েছে। শত শত সংখ্যালঘু সদস্যদের হত্যা করা হয়েছে। মন্দির, গির্জা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।বিচারপতিদের অপমান করে বের করে দেওয়া হয়েছে। তিনি হুমকি দিয়ে বলেন, ড. ইউনূস রক্তের ওপর দিয়ে ক্ষমতা দখল করে আমাদের বিচারের কথা বলছে। আমরাই তার বিচার করব। রাজনৈতিক সংঘাত এবং উত্তেজনা তৈরির চেষ্টার পাশাপাশি শেখ হাসিনা সাম্প্রদায়িকতা উসকে দেওয়ারও চেষ্টা করেছেন।
রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় আটক সাবেক ইসকন নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের মুক্তির দাবিতে বিবৃতি দেন তিনি। গত ২৮ নভেম্বর দেওয়া বিবৃতিতে শেখ হাসিনা বলেন, সনাতন ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায়ের একজন শীর্ষনেতাকে অন্যায়ভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অবিলম্বে তাকে মুক্তি দিতে হবে। চট্টগ্রামে মন্দির পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বলে বিবৃতিতে দাবি করেন বিতাড়িত শেখ হাসিনা।একের পর এক ফোনালাপ রেকর্ড করে তা পরে ফাঁস করার পর অবশেষে প্রকাশ্যে আসেন দিল্লির আশ্রয়ে থাকা শেখ হাসিনা। গত ৪ ডিসেম্বর নিউইয়র্কে আওয়ামী লীগ আয়োজিত বিজয় দিবসের এক অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন তিনি। শেখ হাসিনা ড. ইউনূসকে গণহত্যাকারী আখ্যা দিয়ে বলেন, দেশে যে গণহত্যা হয়েছে তার মূল হোতা ড. ইউনূস।
শেখ হাসিনা তার নিজের অপরাধের দায় ড. ইউনূসের ওপর চাপিয়ে বলেন, আমার বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে মামলা হয়েছে। ড. ইউনূস এবং ছাত্র সমন্বয়করাই গণহত্যার মূল পরিকল্পনাকারী। ভারতীয় মিডিয়ায় বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে যে মিথ্যা প্রপাগান্ডা চালানো হচ্ছে, তারই প্রতিধ্বনি করে শেখ হাসিনা বলেন, ড. ইউনূস সরকার সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালাচ্ছে। তিনি বলেন, হিন্দুদের অপরাধটা কী যে তাদের গণহত্যার শিকার হতে হবে? তাকে এবং তার বোন শেখ রেহানাকে তাদের বাবার মতো হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল বলে দাবি করেন শেখ হাসিনা।
শেখ হাসিনা গত ৮ ডিসেম্বর লন্ডনে আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক সমাবেশে নিউইয়র্কে দেওয়া বক্তব্যের পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে জঘন্য মিথ্যাচার করেন। তিনি দাবি করেন, জনবিক্ষোভের সময় তিনি কোনো শক্তিপ্রয়োগ করেননি। তিনি তা করলে বহু মানুষের প্রাণ যেত। শেখ হাসিনা ড. ইউনূসকে মাস্টারমাইন্ড, খুনি, ফ্যাসিবাদী এবং স্বৈরাচারী বলে আখ্যা দেন। তিনি বলেন, আবু সাঈদের হত্যার জন্য এই মাস্টারমাইন্ডরাই দায়ী। সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে তিনি বলেন, সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর নির্বিচারে হামলা হচ্ছে। সংখ্যালঘুরা কোনো ধরনের আইনি সহায়তা পাচ্ছে না। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে এখন এক অরাজকতা চলছে।
গত ১৬ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক সভায় শেখ হাসিনা ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে পুলিশ, প্রশাসন এবং সেনাবাহিনীকে সরাসরি উসকানি দেন। তিনি বলেন, ইউনূস সরকার প্রতিনিয়ত পুলিশ ও প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের অপমান করছে। তাদের চাকরি থেকে বের করে দেওয়া হচ্ছে। অনেক সচিবকে গ্রেপ্তার করে জেলে রাখা হয়েছে। সবাইকে অপমান করছে। বিচারপতিদের অপমান করে বের করে দেওয়া হয়েছে। এর বিরুদ্ধে সবাইকে প্রতিরোধ করতে হবে।
সেনাবাহিনীকে উসকানি দিয়ে তিনি বলেন, এখন জঙ্গিরা দেশ চালাচ্ছে। সব জঙ্গিকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আমি এখন সেনা কর্মকর্তাদের বলতে চাই- তোমরা যদি এ জঙ্গি সরকারকে সহযোগিতা কর, তাহলে ভবিষ্যতে তোমরা শান্তিরক্ষী মিশনে যেতে পারবা কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে।আবু সাঈদের হত্যার দায় ইউনূস সরকারের ওপর চাপিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ইউনূসের কিলিং এজেন্টরা আবু সাঈদকে হত্যা করেছে। ইউনূস ক্ষমতা দখলের জন্য এ লাশ ফেলেছে। পরে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে ভুয়া ভিডিও বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। তিনি তার নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, তারা আমাকে এবং রেহানাকে খুন করতে চেয়েছিল। আর ২০-২৫ মিনিট দেরি হলে আমরা বাঁচতে পারতাম না।
দিল্লিতে বসে শেখ হাসিনার বাংলাদেশবিরোধী এ অপতৎপরতার ব্যাপারে ভারতকে কড়া বার্তা দিয়েছে বাংলাদেশ। গত ৯ ডিসেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-ভারত পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকে স্পষ্টভাবে জানানো হয়েছে, শেখ হাসিনার বক্তব্য-বিবৃতি দুই দেশের সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলছে। বৈঠক শেষে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিন জানান, আমি আমার ভারতীয় প্রতিপক্ষ বিক্রম মিশ্রিকে সাফ জানিয়ে দিয়েছি, শেখ হাসিনা দিল্লিতে বসে যা করছেন, তা বাংলাদেশের সরকার এবং জনগণ কোনোভাবেই পছন্দ করছে না।
দিল্লিতে ফিরে আপনি শেখ হাসিনাকে এ বার্তাটি পৌঁছে দেবেন। এ ব্যাপারে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি তার দেশের অবস্থান ব্যাখ্যা করে বলেছেন, দিল্লিতে শেখ হাসিনার উপস্থিতি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না। কোনো একটি ইস্যুর কারণে দু্ই দেশের সম্পর্ক আটকে থাকবে না। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকবে, সে সরকারের সঙ্গেই কাজ করে যাবে ভারত।দ্বিপক্ষীয় বৈঠক ছাড়াও ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনূস এবং পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। এই সৌজন্য সাক্ষাতেও শেখ হাসিনার তৎপরতা নিয়ে বাংলাদেশের অসন্তোষের কথা জোরালোভাবে জানানো হয়েছে।শেখ হাসিনার বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতার ব্যাপারে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন আমার দেশ-এর সঙ্গে আলাপে বলেন, ভারতের অবশ্যই উচিত শেখ হাসিনাকে থামানো। শেখ হাসিনা দিল্লিতে বসে নানা ধরনের উসকানির মাধ্যমে বাংলাদেশে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির অপচেষ্টা চালাচ্ছেন।
এটা দুই দেশের সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলছে। তিনি বলেন, শেখ হাসিনার তৎপরতা যেমন বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর, তেমনি ভারতের জন্যও ক্ষতিকর। তাই আমি বলব, দুই দেশের সুসম্পর্কের কথা বিবেচনা করে ভারতের উচিত শেখ হাসিনাকে এখন থামানো। বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতায় লিপ্ত শেখ হাসিনাকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে ভারত জাতিসংঘ সনদ বা আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক ও কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞ প্রফেসর এম শহীদুজ্জামান আমার দেশকে বলেন, ভারতের প্রশ্রয়ে শেখ হাসিনা যা করছেন, তা আন্তর্জাতিক আইনের সরাসরি লঙ্ঘন না হলেও আন্তর্জাতিক রীতিনীতি ও কূটনৈতিক শিষ্টাচারের চরম লঙ্ঘন।
শেখ হাসিনা ইস্যুতে ভারতের অবস্থানের কড়া সমালোচনা করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও দিল্লিতে বসে শেখ হাসিনা যে ধরনের বক্তব্য-বিবৃতি দিচ্ছেন, তা ভারতের প্রশ্রয়ে দিচ্ছেন বলে মনে হয়। একজন বিতাড়িত ব্যক্তিকে এভাবে প্রশ্রয় দেওয়া দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে অত্যন্ত নেতিবাচক পদক্ষেপ। যেখানে পৃথিবীর কোনো দেশই তাকে আশ্রয় দিল না, সেখানে ভারত তাকে আশ্রয় দিয়ে বড় ধরনের ভুল করেছে। ভারতের এ সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতে তাদের স্বার্থের বিপক্ষেই যাবে।
এদিকে শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করতে উদ্যোগী হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। গত ২৩ ডিসেম্বর শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে কূটনৈতিক চ্যানেলে ভারতে বার্তা পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। বাংলাদেশ এখন ভারতের উত্তরের অপেক্ষায় রয়েছে। ভারত সরকার ইতিমধ্যে শেখ হাসিনাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়ে ভারতে তার দীর্ঘ অবস্থানের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো বলছে, শেখ হাসিনাকে ফেরত চেয়ে ঢাকার পক্ষ থেকে দেওয়া চিঠির কোনো উত্তর দেবে না দিল্লি।