আলফাজ আনাম
জনতার প্রতিরোধে নিপীড়ক স্বৈরশাসকদের পরাভূত হওয়ার ইতিহাস নতুন নয়। স্বৈরশাসকদের শেষ পরিণতি হয় নির্মম ও করুণ। মধ্যপ্রাচ্যে আরব বসন্তের পর গত এক দশকে আমরা একের পর এক বহু স্বৈরশাসকের পরিণতি দেখেছি। যার শুরু হয়েছিল তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট বেন আলির পলায়নের মধ্য দিয়ে। এরপর ইরাকের সাদ্দাম হোসেন, লিবিয়ায় মুয়াম্মার গাদ্দাফি ও ইয়েমেন আলি আবদুল্লাহ সালেহের নির্মম মৃত্যু যেন হয়ে উঠেছে তাদের নিপীড়নমূলক শাসনের প্রতিফল। যদিও এদের মধ্যে অনেকে ছিলেন জাতীয়তাবাদী রাজনীতির প্রতিভূ। কিন্তু এদের অত্যাচারমূলক শাসনের কারণে দেশের মানুষের ক্ষোভকে অনেক ক্ষেত্রে বিদেশি শক্তি প্রভাব বিস্তারের সুযোগ হিসেবে কাজে লাগিয়েছে। এমনকি নিপীড়ন থেকে রক্ষা পেতে অনেক দেশের জনগণ বিদেশি শক্তিকে স্বাগত জানিয়েছে। বিদায়ী বছরে দুজন স্বৈরশাসক দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। একজন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, অন্যজন সিরিয়ার বাশার আল-আসাদ। এই দুটি পলায়নের ঘটনা ছিল আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাগুলোর একটি।
স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভের জের ধরে মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র এখন পরিবর্তন হতে যাচ্ছে। সর্বশেষ এমন পরিণতি আমরা দেখছি সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পতনের মধ্য দিয়ে। বাশার আল-আসাদ রাশিয়ায় পালিয়ে গেছেন। তার বাবা হাফিজ আল-আসাদও ছিলেন একজন স্বৈরশাসক। ৫৩ বছর ধরে সিরিয়া শাসন করেছেন হাফিজ আল-আসাদ ও বাশার আল-আসাদ। স্বৈরশাসকদের পরিণতি যেমন একই রকম হয়, তেমনি তাদের উত্তরাধিকার নির্বাচন ও রাষ্ট্রপরিচালনার কৌশল প্রায় একই রকম।
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার কথা ছিল না। হাফিজ আল-আসাদ প্রথমে তার আদরের একমাত্র মেয়ে বুশরাকে উত্তরাধিকার মনোনীত করতে চেয়েছিলেন। মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ সরকারপ্রধান হিসেবে একজন নারীকে মেনে নেবে কি না, তা নিয়ে হাফিজ আল-আসাদের মনে সংশয় তৈরি হয়। শেষ পর্যন্ত তিনি সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন। এরপর প্রেসিডেন্ট পদের জন্য প্রস্তুত করেন তার ছেলে বাসেল আল-আসাদকে। কিন্তু ৩১ বছর বয়সে ১৯৯৪ সালে বাসেল আল-আসাদ এক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। তখন বাশার আল-আসাদ লন্ডনে চিকিৎসাশাস্ত্রে লেখাপড়া করছিলেন। অন্তর্মুখী ও লাজুক প্রকৃতির বাশার চোখের ডাক্তার হিসেবে ইন্টার্নি করছিলেন।
ভাইয়ের মৃত্যুর পর দেশে ফেরার ডাক পড়ে বাশার আল-আসাদের। তিনি এসে সিরিয়ায় মিলিটারির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। একই সঙ্গে দেশ শাসনের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। ২০০০ সালের জুন মাসে হাফিজ আল-আসাদের মৃত্যুর পর বাশার আল-আসাদ প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এরপর ২৪ বছর তিনি সিরিয়া শাসন করেছেন। ধর্মীয় পরিচয়ের দিক থেকে বাশার আল-আসাদ ছিলেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি। ইতিহাসে সংখ্যালঘুর শাসন সবচেয়ে নিপীড়নমূলক হয়ে থাকে। বাশার আল-আসাদ তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। তিনি তার বাবার মতো আজীবন প্রেসিডেন্ট থাকতে চেয়েছিলেন। এ জন্য বিরোধী মত দমনের সব ধরনের পথ তিনি বেছে নিয়েছিলেন। অবশেষে জনরোষ আর সশস্ত্র প্রতিরোধের মুখে বিমানের সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে কাউকে না জানিয়ে দেশ ছাড়েন বাশার আল-আসাদ। তার পলায়নের পর মাটির নিচে গোপন কারাগারের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। অনেক স্থানে পাওয়া যাচ্ছে গণকবর। নির্বাসনে থাকা সিরিয়ার মানুষ আবার দেশে ফিরতে শুরু করেছে। আসাদ পালিয়ে গেছেন কিন্তু সিরিয়া তছনছ হয়ে গেছে। ২০১০ সালে শুরু হওয়া বাশারবিরোধী গণআন্দোলন রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র আন্দোলনে রূপ নেয়। গৃহযুদ্ধে দেশটিতে মারা গেছে পাঁচ লাখের বেশি মানুষ।
বাশার আল-আসাদের পলায়নের মাত্র পাঁচ মাস আগে একইভাবে বাংলাদেশের নির্মম স্বৈরশাসক হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। হাসিনার উত্থানও অনেকটা বাশার আল-আসাদের মতোই। শেখ মুজিবুর রহমান তার রাজনৈতিক উত্তরাধিকার হিসেবে হাসিনা নয়, তার ভাই শেখ কামালকে প্রস্তুত করেছিলেন। কিন্তু ভাগ্যক্রমে রাজনীতিতে চলে আসেন শেখ হাসিনা।
হাফিজ আল-আসাদের মতো শেখ মুজিব সত্তরের দশকে রাজনীতিতে উজ্জ্বল তারকা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন হাফিজ আল-আসাদের মতো একদলীয় শাসনে বিশ্বাসী এক রাজনীতিক। পাকিস্তানি আমলে রাজনীতিতে তার উত্থান মার্কিনপন্থি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর হাত ধরে হলেও স্বাধীন বাংলাদেশে ক্ষমতায় এসে তিনি ভারতের পরামর্শে সোভিয়েত বলয়ের দিকে ঝুঁকে পড়েন।
একদলীয় শাসন কায়েমের মাধ্যমে নিপীড়ন ও রাষ্ট্রপরিচালনায় চরম ব্যর্থতার কারণে সেনা অভ্যুত্থানে শেখ মুজিব তার পরিবারের সদস্যসহ নিহত হন। তার উত্তরাধিকার ও রাষ্ট্রপরিচালনার জন্য প্রস্তুত হতে থাকা শেখ কামালও নিহত হন। হাফিজ আল-আসাদের শাসনে একাধিক সেনা অভ্যুত্থান হয়েছে কিন্তু তিনি বেঁচে গেছেন। কিন্তু মুজিব মৃত্যুবরণ করেন। তিনি বেঁচে থাকলেও হয়তো হাফিজ আল-আসাদের মতো আমৃত্যু বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট থাকতেন। বাশার আল-আসাদের মতো তার ছেলে শেখ কামাল দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিতেন।
শেখ মুজিবের মৃত্যু তার মেয়ে শেখ হাসিনার রাজনীতিতে আসার পথ খুলে দেয়। বাবার মৃত্যুর সবচেয়ে বড় বেনিফিশিয়ারি হয়ে ওঠেন শেখ হাসিনা। তিনি বাবার মতো একদলীয় শাসনের পথে হাঁটতে থাকেন। ১৯৯৬ সালে প্রথমবার ক্ষমতা গ্রহণের পর কিছুটা সংযত আচরণ করলেও ২০০৮ সালে প্রতিবেশী ভারত ও সেনাসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসেন শেখ হাসিনা। এরপর বাবার রাজনীতি বাস্তবায়নের জন্য নিষ্ঠুরতার পথ বেছে নেন।
সিরিয়ার মতো শেখ হাসিনাও বাংলাদেশকে একটি পরিবারতান্ত্রিক মাফিয়া রাষ্ট্রে পরিণত করেছিলেন। বিরোধী মতের মানুষকে হত্যা, গুম ও কারাগারে অবরুদ্ধ করে রাখেন। জনরোষের মুখে তিনি বিমান যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে তার প্রধান সমর্থক প্রতিবেশী দেশে পালিয়ে যান। বাশার আল-আসাদের পরিবারের সদস্যরা যেমন কেউ আর সিরিয়ায় নেই, তেমনি হাসিনার পরিবারের সদস্যরাও দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। বাশারের মতো হাসিনাও তার দলের নেতাকর্মীদের না জানিয়ে পালিয়ে যান।
বাশার আল-আসাদের শাসন টিকিয়ে রাখতে বহু দূরের দেশ রাশিয়া সেনা ও নৌঘাঁটি স্থাপন করেছিল। বাশারবিরোধীদের দমনে বিমান হামলা চালিয়েছে। অন্যদিকে ইরানের শিয়া মিলিশিয়ারা বাশারের পক্ষে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। নারী ও শিশুদের ওপর তাদের নিষ্ঠুরতা ছিল ভয়াবহ।
এদিকে বাংলাদেশের স্বৈরশাসক হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে রাষ্ট্রপরিচালনায় পুরো নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছিল ভারত। বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের গুম ও খুনের সঙ্গে ভারত সরাসরি জড়িয়ে পড়েছিল। এমনকি ভিন্নমতাবলম্বীদের গুম করে ভারতের কারাগারে আটক রাখার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
শেখ হাসিনার পিতা শেখ মুজিবের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে এ দেশের মানুষ ও সেনাবাহিনীর একটি অংশ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। ফলে শেখ মুজিব তার শাসন দীর্ঘায়িত করতে পারেননি। তার পতনের পর বাংলাদেশ একদলীয় শাসন থেকে গণতান্ত্রিক শাসনের পথে যাত্রা শুরু করে। একই সময় সিরিয়ায় হাফিজ আল-আসাদ পুরোপুরি একদলীয় শাসন কায়েম করেন।
বাংলাদেশে শেখ হাসিনার শাসন দেড় দশক টিকে থাকলেও মাত্র ৩৬ দিনের আন্দোলনে তার পতন ঘটে। এক হাজারের বেশি মানুষ মারা যায়। আহত হয় ১৫ হাজারের মতো। অন্যদিকে বাশার আল-আসাদের ২৪ বছরের শাসনের পতন ঘটে পাঁচ লাখ মানুষের রক্তের বিনিময়ে।
আমাদের তরুণ প্রজন্মের মনে রাখতে হবে, যদি মুজিবের শাসনের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠিত হতো, তাহলে এ দেশের পরিণতি হতো সিরিয়ার মতো। পাঁচ লাখ নয়, আমাদের হয়তো আরও বেশি রক্তের প্রয়োজন হতো। বাশার আল-আসাদের পতনের পর সিরিয়া এখনো কোনো দেশ দখল করেনি। ভারত সমর্থিত একনায়কতান্ত্রিক স্বৈরশাসকের প্রতিরোধ যুদ্ধে হয়তো বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ত। এ দেশের মানুষের প্রবল গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার কারণে ভারত হয়তো সশস্ত্র আগ্রাসনের পথে এগোনোর সাহস পায়নি।
২০২৪ সালে বাংলাদেশের মানুষ বহু রক্তের বিনিময়ে আধিপত্যবাদী শক্তির সমর্থনপুষ্ট একনায়কত্ববাদী সরকারকে হটাতে পেরেছে। আধিপত্যবাদী দেশগুলো সব সময় তাদের অনুগত সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের ওপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে। আপাত স্বৈরশাসককে হটানো সম্ভব হলেও রাজনৈতিক ভুলের কারণে আবারও বিদেশি শক্তির সমর্থনপুষ্ট শক্তি নতুন রূপে ফিরে আসতে পারে। এমন পরিস্থিতি যেন সৃষ্টি না হয়, সে জন্য দরকার জাতীয় ঐক্য। ক্ষমতার মোহ ও বিভাজনের রাজনীতি দেশকে অতল গহ্বরে ঠেলে দিতে পারে।
গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে স্বৈরশাসকের পলায়নের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো আধিপত্যবাদী শক্তির প্রভাব ঠেকাতে কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখে, সেটা এখন দেখার বিষয়। নতুন বছরে আমাদের প্রত্যাশা হবে বিভাজনের রাজনীতির যেন অবসান ঘটে। আধিপত্যবাদী শক্তিকে পরাভূত করে সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে উত্তরণ ঘটে।