
দেশ ও জাতির সেবায় আত্মনিয়োগ করা অনেক তরুণের স্বপ্ন। বিশেষ করে যারা বিদেশে থাকে কিন্তু সেটা অনেক ক্ষেত্রে দুঃস্বপ্নে পরিণত হয় কারোর জন্যে। বাংলাদেশে নতুন করে ভালো কিছু করা অঘোষিত অপরাধ বলে গণ্য হয়। কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে টেনে নিচে নামাতে আমাদের জুড়ি মেলা ভার! আজ জীবনের কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা শেয়ার করবো, যদি ভাল কোন পরিবর্তন আসে।
বাংলাদেশের পাবলিক, প্রাইভেট ও ইন্টারন্যাশনাল সব ধরনের ইউনিভার্সিটিতে আমি কাজ করেছি। ২০০০-২০১৮ সাল পর্যন্ত গাজীপুরের ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে (আইইউটি) ছাত্র ও শিক্ষক হিসাবে কাটিয়েছি। আইইউটির বাইরের পরিবেশ সম্পর্কে আমার তেমন ধারণা ছিল না। আমাদের শিক্ষকরা ছিল অন্য ধাঁচের, অসাধারণ এক কথায়। ২০১৮ সালের মার্চে অস্ট্রেলিয়ায় আসলেও দেশমাতৃকার টানে আবার ফিরলাম ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে।
দেশের ১ম বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় 'বঙ্গবন্ধু ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি' গাজীপুরের কালিয়াকৈরে যোগ দিলাম প্রতিষ্ঠাকালীন বিভাগীয় প্রধান ও চুক্তিভিত্তিক অধ্যাপক হিসেবে। আমার পিএইচডি ও পোস্ট ডকের বিষয় ছিল ব্লেন্ডেড, অনলাইন ও ডিজিটাল এডুকেশন। বেতন সর্বসাকুল্যে ৮০ হাজার টাকার মতো। অস্ট্রেলিয়া থেকে আসা যাওয়ায় টাকা শেষ, অনেক ইউনিভার্সিটি থেকে ক্লাস নেওয়ার কথা বললেও যায়নি। কারণ শিক্ষার্থীদের পেছনে সময় দেওয়াটাকে আমার শ্রেয় মনে হতো।
অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতা ছিল, বহুবার মনে হয়েছে চাকরি ছেড়ে দেবো কিন্তু শিক্ষার্থীদের মায়ায় যাইনি। সিনিয়র শিক্ষক নেই, কয়েকজন শুধু লেকচারার আছে, এ অবস্থায় ফেলে রেখে কীভাবে যায়? এক সময় আর নিতে পারছিলাম না, তাই ডিজিটাল ছেড়ে আসলাম ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটিতে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে। ওরা চমৎকারভাবে আমাকে গ্রহণ করেছিল, কয়েকটা নিউজ পেপারে যোগদানের খবর প্রকাশিত হয়, ফুল দিয়ে বরণ করে নেয়, আমার অফিসটাও অসাধারণ ছিল।
ড্যাফোডিলে ন্যাশনাল ব্লেন্ডেড শিক্ষার মহাসমাবেশ, ইন্টারন্যাশনাল ডিজিটাল এডুকেশন সামিট, কমনওয়েলথ অব লার্নিং কানাডার এডভান্সড আইসিটি প্রজেক্টসহ বেশকিছু ভালো প্রোগ্রাম সফলতার সাথে সম্পন্ন করি। দেশজুড়ে পরিচিতি পায়, সাথে আমার শিক্ষা সংক্রান্ত ২০০+ আর্টিকেল ইংরেজি ও বাংলা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। আসলে ড্যাফোডিল ছিল আমার ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট-যা চেয়েছি তা সফলভাবে সম্পন্ন করতে সব ধরনের সহযোগিতা পেয়েছি, কলিগ-স্টাফ সবাই ছিল অসাধারণ।
সমস্যা শুরু হয় ২০২২ সালের মাঝামাঝিতে আমেরিকান স্টেট ডিপার্টমেন্টের ফেলোশিপে যাবার প্রাক্কালে। হঠাৎ ৬-৭টি সংবাদপত্রে আমার নামে হুলিয়া জারি হয়, ডিজিটাল ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইটে সেটা দেয়া হয়, চারিদিকে সাংবাদিকদের ফোন আসতে শুরু করে। বলা হলো আমি ডিজিটাল ইউনিভার্সিটির মিথ্যা নাম ও পদবি ব্যবহার করছি, সবাইকে সতর্ক করা হলো। দেড় বছর হয়ে গেছে ওখান থেকে চাকরি ছেড়ে এসেছি, এতো দিন সমস্যা হয়নি, হাজারো অফিসিয়াল ডকুমেন্ট আছে অথচ এমন মিথ্যা, অসৎ ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সংবাদ ছড়িয়ে পড়লো চারিদিকে।
আমি একজন সাধারণ শিক্ষক, এ ধরনের পরিস্থিতিতে মোটেও অভ্যস্ত নয়। মূল ইস্যু হলো, তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ওই ইউনিভার্সিটির ভিসি সাহেবের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড, ১০ হাজার কোটি টাকার উচ্চাভিলাসী ডিপিপি, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃশ্যমান কোন উন্নতি না হওয়ায় উনাকে রিনিউ না করার সিদ্ধান্ত নেয়। তখন গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিটাল ইউনিভার্সিটিতে যোগ্য কেউ আছে কি না খুঁজতে থাকে। ইউনিভার্সিটিতে গেলে উনারা বলে দেয় এখানে সিনিয়র শিক্ষক কেউ নেই। আমি ঐ ইউনিভার্সিটিতে থাকাকালীন একবার শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে সরব হলে ওই গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন আমার সাথে কথা বলেছিল। তাই উনারা বলেন এখানে তো একজন ছিল, উনি কোথায় গেছেন? তারপর গোয়েন্দারা খুঁজে বের করে আমি ড্যাফোডিলে আছি। একদিন তারা আমার অফিসে এসে কাগজপত্র নিয়ে যায়, এটাই আমার অপরাধ।
হয়তো ব্লেন্ডেড ও অনলাইন শিক্ষায় আমার অবদানকে স্মরণ করে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী এমনটা চেয়েছিলেন। আমি কখনো রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলাম না এবং আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, শিক্ষকদের রাজনীতি থেকে দূরে থাকা উচিত। এরমধ্যে গোয়েন্দা সংস্থা আমাদের যশোরে বাড়িতে খোঁজ খবর নিয়ে পজিটিভ রিপোর্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। এটা জানতে পেরে তৎকালীন ডিজিটাল ইউনিভার্সিটির ভিসি মরিয়া হয়ে ওঠেন, ১০ হাজার কোটি টাকার প্রজেক্ট হাতছাড়া হয়ে যাবে এটার লোভ সামলানো কঠিন। জীবনে একটা কথা মনেপ্রাণে ধারণ করি, তা হলো শিক্ষকতায় এসেছি, মাথাটা যেন সবসময় উঁচু থাকে। জনগণের বা শিক্ষার্থীদের এক টাকা আত্মসাতের চেয়ে ঘাস খেয়ে থাকা কে আমি শ্রেয় মনে করি। যে দেশ আমাকে এতো কিছু দিয়েছে, তার সম্মান সবসময় সমুন্নত রাখার চেষ্টা করেছি।
২০২২ সালের মে আমি আমেরিকান স্টেট ডিপার্টমেন্টের ফেলোশিপে চলে গেলাম। সীমাহীন অপপ্রচার আর ড্যাফোডিল, ইউজিসি, গোয়েন্দা সংস্থায় চিঠি দিয়ে এমন একটা অবস্থা তৈরি হলো যে আমি বিরাট বড় দাগি আসামি। ড্যাফোডিল থেকে চাকরিচ্যুত করতে প্রতিনিয়ত হুমকি দিয়ে যাচ্ছিলেন, শেষে সবুর খান সাহেব নিউইয়র্কে দেখা হলে বিস্তারিত বললে আমি বলেছিলাম, আমার কারণে আপনাদের কোন অসুবিধা হবে না, দেশে ফিরেই চাকরি ছেড়ে দেবো। দেশকে ভালোবাসি তাই এসেছিলাম কিছু দিতে।
হঠাৎ চারিদিকে অন্ধকার দেখতে শুরু করলাম, পরিবারকে হুমকি দেয়া শুরু হলো, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রফেসর পদে আবেদন করেছিলাম, সেটাও হতে দেয়নি ঐ একই স্বার্থান্বেষী মহল। পরিস্থিতি এমন হলো, কোথাও চাকরিতে নিবে না, ভিসির লিস্ট থেকে নাম অনেক আগেই প্রত্যাহার করা হয়েছে। দেশ ছাড়া না পর্যন্ত তাদের প্রতিহিংসা মিটেনি। অনেকে বলেছিলেন মামলা করতে। যে ইউনিভার্সিটির একাডেমিক সমস্ত কার্যক্রম আমার হাতেই শুরু হয়েছে, তার বিরুদ্ধে মামলা করি কীভাবে? জীবনে কোনোদিন থানা-পুলিশ, আইন-আদালতে যায়নি। তিন মাস বেকার থাকলাম, ছেলের স্কুল শেষ হলে ২০২২ সালের ৬ ডিসেম্বর অস্ট্রেলিয়ায় আবার ফিরতে হলো। আসার সময় বাংলাদেশ বিমানে উঠার আগে আকাশের দিকে তাকিয়ে কি যেন বলার চেষ্টা করেছিলাম, চোখে পানি চলে আসলো। বিদায় বাংলাদেশ - এটা আমার প্রাপ্য নয়, এটা ন্যায়বিচার নয়, এটা এ দেশকে ভালোবাসার প্রতিদান।
লেখক: ফুলব্রাইট ইউএসএ ও আইপিআরএস স্কলার অষ্ট্রেলিয়া এবং শিক্ষাক্রম, ডিজিটাল শিক্ষা ও সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ, দি ইউনিভার্সিটি অব মেলবোর্ন ও অস্ট্রেলিয়ান গভর্নমেন্ট, সাবেক ফ্যাকাল্টি মেম্বার আইইউটি, ড্যাফোডিল এবং ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ।