
ব্রি জে. রোকন উদ্দিন (অব)
২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত এক দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ সরকার চট্টগ্রামের মিরসরাই এলাকায় ৯০০ একর জমি ভারতের জন্য বরাদ্দ দেয়, যেখানে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (Special Economic Zone Ñ SEZ) স্থাপনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। এই প্রকল্পটি শেখ মুজিব শিল্পনগরের অংশ, যার লক্ষ্য ছিল ভারতীয় বিনিয়োগ আকর্ষণ ও শিল্পায়নের গতি বাড়ানো।
ভারত এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশকে ১১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি সফট লোন প্রদান করে, যা অত্যন্ত নমনীয় শর্তে অনুমোদিত হয়। যদিও এই প্রকল্পটি দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার নিদর্শন হিসেবে উপস্থাপিত হয়, বাস্তবে এর বাস্তবায়নে একাধিক নীতিগত জটিলতা, ভারতপ্রীতি, নির্ভরতা ও অর্থনৈতিক পক্ষপাত লক্ষ করা গেছে।
প্রকল্প বাস্তবায়নের সমস্যা
প্রকল্প বাস্তবায়নে যেসব জটিলতা ও সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে, তা শুধু প্রশাসনিক বা প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতায় নয়, বরং এর গভীরে রয়েছে নীতিগত পক্ষপাত, আঞ্চলিক কৌশলগত ঝুঁকি এবং জাতীয় স্বার্থ উপেক্ষার এক গভীর সংকট।
প্রথমত, এই প্রকল্পে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ কার্যত সীমিত রাখা হয়েছে। মূল নিয়ন্ত্রণ ও বাস্তবায়নের ক্ষমতা একতরফাভাবে ভারতীয় বিনিয়োগকারী ও প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে। এমনকি চুক্তির শর্তাবলিতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, বেশিরভাগ কনট্রাক্ট, যন্ত্রপাতি ও উপকরণ ভারত থেকেই আনতে হবে। ফলে বাংলাদেশের স্থানীয় ঠিকাদাররা, প্রযুক্তিবিদরা, কিংবা নির্মাণ খাতে জড়িত সংস্থাগুলো কোনো বাস্তব অংশীদারত্ব গড়ে তুলতে পারেনি। এতে একদিকে যেমন স্থানীয় সক্ষমতা ও মানবসম্পদের অবমূল্যায়ন ঘটছে, অন্যদিকে এ অঞ্চলে একটি একচেটিয়া প্রভাব প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হচ্ছে, যা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য সুদূরপ্রসারী হুমকি হয়ে উঠতে পারে।
দ্বিতীয়ত, প্রকল্পটির বাস্তবায়ন দীর্ঘসূত্রতার এক ক্ল্যাসিক উদাহরণ হয়ে উঠেছে। প্রায় আট বছর পেরিয়ে গেলেও দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। এখনো জমির একটি বড় অংশ পড়ে আছে অনাবাদি ও অব্যবহৃত অবস্থায়। স্থানীয় জনগণ, যারা প্রথম দিকে এই প্রকল্পকে কেন্দ্র করে কর্মসংস্থান, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও ব্যবসার সুযোগের স্বপ্ন দেখেছিল, তারা এখন হতাশ। তাদের আশা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চরম অনিশ্চয়তায় রূপ নিয়েছে। এর ফলে কেবল স্থানীয় অর্থনীতিই স্থবির হয়ে পড়েনি, বরং প্রকল্প-সম্পৃক্ত এলাকায় সামাজিক উত্তেজনাও তৈরি হয়েছে।
সবচেয়ে গুরুতর বিষয় হলো নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক ভারসাম্যের প্রশ্ন। একটি বিদেশি রাষ্ট্রকে, তাও একটি কৌশলগত অঞ্চলে—চট্টগ্রামের মতো বন্দরের নিকটবর্তী এলাকায় এত বিস্তৃত জমি দীর্ঘ মেয়াদে বরাদ্দ দেওয়া জাতীয় নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত স্পর্শকাতর। এই জমিতে ভবিষ্যতে কী ধরনের স্থাপনা গড়ে উঠবে, সেখানে কারা কাজ করবে, কী ধরনের প্রযুক্তি বা নজরদারি ব্যবস্থা থাকবে—এসব প্রশ্ন এখনো অস্পষ্ট। নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, এই অঞ্চলটি ভবিষ্যতে গোপন গোয়েন্দা তৎপরতা, রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার, এমনকি অর্থনৈতিক উপনিবেশায়নের হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে।
পরিবর্তিত ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
বর্তমান সময়ে দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ভারতের ভূমিকা ক্রমেই একপ্রকার আঞ্চলিক আধিপত্যবাদী প্রবণতার দিকে ধাবিত হচ্ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশসহ ছোট প্রতিবেশী দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ নীতি, কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত ও অর্থনৈতিক চুক্তিতে ভারতের অতিমাত্রায় সক্রিয় অংশগ্রহণ ও প্রভাব বিস্তারের প্রবণতা এখন আর গোপন নেই, বরং এটি দিনদিন আরো সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে।
ফেনী নদীর পানি চুক্তি এর একটি ক্লাসিক উদাহরণ। সীমান্তবর্তী একটি নদী হওয়া সত্ত্বেও এবং আন্তর্জাতিক পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার রীতি অনুসারে যৌথ সিদ্ধান্ত ও ন্যায্য হিস্যার দাবিদার হওয়া সত্ত্বেও এই চুক্তি এমনভাবে সম্পাদিত হয়েছে যে, এতে বাংলাদেশের স্বার্থ উপেক্ষিত হয়েছে। ভারতের পানি উত্তোলনের সুবিধা অনুমোদিত হলেও বাংলাদেশ তার প্রাপ্য অংশ নিশ্চিত করতে পারেনি। এতে কেবল জাতীয় সম্পদের ক্ষয়ই হয়নি, বরং একটি সাংবিধানিক ও কূটনৈতিক দুর্বলতাও প্রকাশ পেয়েছে।
একই রকম চিত্র দেখা যায় ট্রানজিট সুবিধা ও আন্তঃদেশীয় রেল-নৌ সংযোগ-সংক্রান্ত চুক্তিগুলোয়। ভারত এই সুবিধাগুলো ব্যবহার করে একদিকে যেমন উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে মূল ভূখণ্ডের সংযোগকে আরো মজবুত করছে, অন্যদিকে বাংলাদেশ তার ভূখণ্ড ব্যবহারের বিনিময়ে কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক বা কৌশলগত লাভ পাচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার দায়িত্বও বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, যা একতরফা সুবিধাদান ছাড়া কিছুই নয়।
এই প্রেক্ষাপটে মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রকল্পটি নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে—এটি কি নিছক একটি অর্থনৈতিক উদ্যোগ, নাকি এর আড়ালে দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত অবস্থান অর্জনের একটি সূক্ষ্ম পরিকল্পনা লুকিয়ে আছে?
বাংলাদেশের চট্টগ্রাম উপকূলীয় এলাকা শুধু অর্থনৈতিক গুরুত্বের জন্য নয়, সামরিক ও বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকেও একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। এমন একটি অঞ্চলে একটি বিদেশি রাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি উপস্থিতি এবং তার বিনিয়োগনির্ভর নিয়ন্ত্রণ—এই সমীকরণে কৌশলগত উদ্বেগ সৃষ্টি হওয়াটাই স্বাভাবিক। অনেক বিশ্লেষক আশঙ্কা করছেন, ভারত এই প্রকল্পের মাধ্যমে কেবল ব্যবসায়িক সুবিধা নয়, বরং সামরিক ও গোয়েন্দা তৎপরতার একটি নিঃশব্দ ঘাঁটি গড়ে তুলতে চায়।
বিশ্লেষকদের মতে, মিরসরাইয়ে ভারতীয় প্রভাব প্রতিষ্ঠিত হলে ভবিষ্যতে সেই এলাকা ভারতের আধা-নিয়ন্ত্রিত এক বিশেষ অঞ্চলে পরিণত হতে পারে, যেখানে বাংলাদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই সীমিত থাকবে। ইতিহাসে একাধিকবার দেখা গেছে, অর্থনৈতিক বিনিয়োগের মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিষ্ঠা এবং পরবর্তী সময়ে ‘ডিপ্লোম্যাটিক ডমিনেশন’ কায়েম করার কৌশল কতটা সফলভাবে প্রয়োগ করেছে কিছু শক্তিধর দেশ।
সব মিলিয়ে মিরসরাই প্রকল্পকে নিছক একটি বেসরকারি অর্থনৈতিক অংশীদারত্বের চেয়ে অনেক বেশি গভীরতায় দেখা প্রয়োজন। বর্তমান আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে যেখানে অর্থনৈতিক অনুপ্রবেশ কৌশলগত উপনিবেশায়নের অন্যতম হাতিয়ার, সেখানে আমাদের উচিত এসব চুক্তিকে স্বচ্ছভাবে বিশ্লেষণ করা, বিতর্কের সুযোগ সৃষ্টি করা এবং জনমতের আলোকে জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় জোরালো অবস্থান নেওয়া।
কারণ আজ যদি আমরা প্রশ্ন না করি, কাল সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়ার জন্য হয়তো আর অবশিষ্ট থাকবে না স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাও।
এখন করণীয়
এই মুহূর্তে মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে ভারতী-নিয়ন্ত্রিত প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রশ্নটি শুধু একটি অর্থনৈতিক উদ্যোগের সীমায় আবদ্ধ নয়—এটি একটি জাতীয় স্বার্থ, ভূরাজনৈতিক ভারসাম্য এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রশ্নে রূপ নিয়েছে। এই অবস্থায় প্রকল্পটির ভবিষ্যৎ নিয়ে দেশের ভেতরে নানা বিকল্প প্রস্তাব ও ভাবনা উঠে এসেছে, যা এখন বাস্তবায়নের পর্যায়ে বিবেচনা করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
একটি গুরুত্বপূর্ণ বিকল্প প্রস্তাব হলো—প্রকল্পটি বাতিল করে সংশ্লিষ্ট জমিটি দেশের নিজস্ব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে কাজে লাগানো। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে শিল্প ও অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের ক্ষেত্রে একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। তাই মিরসরাইয়ের মতো কৌশলগত ও ভৌগোলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ জমি একটি বিদেশি রাষ্ট্রকে প্রদান না করে বরং জাতীয় প্রতিরক্ষা শিল্পনগরী বা উচ্চপ্রযুক্তি শিল্প জোন হিসেবে গড়ে তোলা যেতে পারে।
বিশ্বের অনেক উন্নয়নশীল দেশ এরই মধ্যে সামরিক প্রযুক্তি ও প্রতিরক্ষা উৎপাদন শিল্পে বিনিয়োগ করে তাদের কৌশলগত সক্ষমতা বাড়িয়েছে। চট্টগ্রামের মতো বন্দর-নিকটবর্তী ও নিরাপত্তা-সংবেদনশীল এলাকায় এ ধরনের উদ্যোগ বাংলাদেশকেও কৌশলগত আত্মনির্ভরতা অর্জনে সহায়তা করতে পারে। এর ফলে যেমন দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা পাবে, তেমনি অর্থনৈতিকভাবে দেশে একটি নতুন শক্তিশালী শিল্প খাত গড়ে উঠবে, কর্মসংস্থান হবে এবং জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।
অন্যদিকে সম্পূর্ণভাবে বাতিলের পথে না গিয়ে আরেকটি যুক্তিসংগত ও কূটনৈতিকভাবে কার্যকর বিকল্প হলো—চুক্তির শর্তপত্র পুনর্গঠন।
বর্তমান চুক্তিতে বাংলাদেশের ভূমিকা ও নিয়ন্ত্রণের সীমাবদ্ধতা স্পষ্ট। চুক্তিতে এমন ধারা রয়েছে, যেখানে অধিকাংশ কনট্রাক্ট, যন্ত্রাংশ ও পরিষেবা ভারত থেকে নিতে হবে—এটি শুধু অর্থনৈতিক বৈষম্য নয়, বরং এটি একরকম একতরফা নির্ভরতার নিদর্শন। এই ধারা পরিবর্তন করে বাংলাদেশের সংস্থাগুলোর সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং যৌথ বিনিয়োগ কাঠামো গঠন করার উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
এ ছাড়া প্রকল্প এলাকায় নিরাপত্তা, প্রশাসন ও তদারকির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশ সরকারের অধীনে আনতে হবে। একটি স্বাধীন দেশের ভেতরে আরেক দেশের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলা অঞ্চল ভবিষ্যতে রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাজনিত জটিলতার উৎস হয়ে উঠতে পারে, যার নজির দক্ষিণ এশিয়াতেই একাধিকবার দেখা গেছে।
এই বিকল্প আলোচনার দাবি এখন কেবল বিশেষজ্ঞ বা সচেতন নাগরিকদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই—জাতীয় স্বার্থে একটি বিস্তৃত জনমত গড়ে উঠছে, যারা চাইছেন সরকারের পক্ষ থেকে একটি স্পষ্ট, দৃঢ় ও ন্যায্য অবস্থান গ্রহণ। দেশের ভেতরে এমন একটি প্রকল্প চলবে, যার কৌশলগত নিয়ন্ত্রণ দেশের হাতেই থাকবে—এটি স্বাভাবিক ও যৌক্তিক দাবি।
বাংলাদেশের কৌশলগত অঞ্চল মিরসরাইয়ে ভারতের জন্য ৯০০ একর জমি বরাদ্দ করে যে SEZ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে, তা জাতীয় স্বার্থ ও সার্বভৌম নিয়ন্ত্রণের পরিপন্থী হয়ে উঠেছে। প্রকল্পটির বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা, পক্ষপাতমূলক নীতি এবং নিরাপত্তা ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে চুক্তিটি বাতিল করা অথবা ন্যূনতম পুনর্মূল্যায়ন করা এখন সময়ের দাবি।
এমন একটি সময়, যখন আঞ্চলিক রাজনীতিতে ভারত একটি আধিপত্যবাদী অবস্থানে রয়েছে, তখন বাংলাদেশের উচিত হবে তার প্রতিটি কৌশলগত সম্পদ ও ভূখণ্ডে সর্বোচ্চ সতর্কতা ও কর্তৃত্ব বজায় রাখা। আর তা করতে হলে মিরসরাই চুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে এখনই সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে হবে।