
সম্প্রতি ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের পেহেলগামে সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামলায় ২৬ জন নিহত হয়েছে। ভারত এই ঘটনার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করেছে এবং বেশকিছু পদক্ষেপও গ্রহণ করেছে । এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য সিন্ধু পানিবণ্টন চুক্তি স্থগিত, ভিসা বাতিল, কুটনৈতিক সম্পর্ক অবনতি। পাকিস্তানও পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে ভারতের সাথে সীমান্ত ও আকাশ পথ বন্ধ এবং বাণিজ্য স্থগিত করা। সেইসাথে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হচ্ছে দ্বিপক্ষীয় সব চুক্তি, বিশেষ করে ১৯৭২ সালের সিমলা চুক্তি থেকে সরে আসার হুমকি। যদিও পাক প্রধানমন্ত্রী ভারতের করা অভিযোগ অস্বীকার করেছে এবং এর সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেছে। এই অঞ্চলে পাক-ভারত দ্বন্দ্ব নতুন কিছু নয়। ঔপনিবেশিক শাসন অবসানের পর এদের মাঝে বেশ কয়েকটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। পরস্পর দ্বন্দ্ব-সংঘাত-যুদ্ধ দেশ দুটিকে পারমাণবিক শক্তিশালী রাষ্ট্র বানিয়েছে। পরস্পর হুমকি এবং আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণের ঘোষণা দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে বাংলাদেশ সবসময় গুরুত্বপূর্ণ । এই অঞ্চলে বাংলাদেশের ভৌগোলিক কৌশলগত অবস্থানের কারণে এর গুরুত্ব অনেক বেশি। প্রথমত, বঙ্গোপসাগরের সমুদ্রসীমা যার সাথে ভারত মহাসাগরের সংযুক্তি রয়েছে। এটি বর্তমানে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক হটস্পট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এছাড়া বঙ্গোপসাগরে খনিজ ও জ্বালানি সম্পদের উপস্থিতি, বাণিজ্য ও পরিবহনের সুবিধার কারণে বৈশ্বিক এবং আঞ্চলিক শক্তিগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছে। দ্বিতীয়ত, ভারত-বাংলাদেশের দীর্ঘ রাষ্ট্রীয় সীমানা ও চিকেন নেকের অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের সাথে ভারতের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব বৃদ্ধি করেছে। তাই বাংলাদেশ ভূ-কৌশলগত অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে জাতীয় স্বার্থ রক্ষা ও ত্বরান্বিত করতে পারে। পাশাপাশি আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কে দরকষাকষির ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে পারে।
৫ই আগস্টের পর বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে আন্তর্জাতিক নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তে প্রভুত্বপ্রীতি সংস্কৃতির অবসান ঘটেছে। বাংলাদেশ আজ একটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র। রাষ্ট্রীয় সংকট মোকাবেলায় বাংলাদেশের মানুষ এখন ঐক্যবদ্ধ। আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের আলোচনায় বাংলাদেশ অপর রাষ্ট্রের সাথে আত্মমর্যাদার সাথে বলিষ্ঠভাবে কথা বলবে, এটাই মানুষ কামনা করে। মানুষের এই আকাঙ্ক্ষা প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে উঠে এসেছে। তিনি বলেছেন, “বাংলাদেশের মানুষ শান্তিকামী, তাঁরা যুদ্ধ চায় না। কিন্তু চারদিকে যুদ্ধের জন্য হইহই রব উঠেছে। এজন্য আমাদেরও প্রস্তুত থাকতে হবে। কেননা এই পরিস্থিতিতে অপ্রস্তুত থাকার সিদ্ধান্ত হবে সম্পূর্ণ আত্মঘাতী।”
জার্মান ভূতাত্ত্বিক কার্ল হাউজহফার বলেন, “সামরিক শক্তি অর্জনের জন্য একটি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া প্রয়োজন”। বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত বৈদেশিক রেমিট্যান্স ও তৈরি পোশাক শিল্পের উপর নির্ভরশীল। এছাড়া কৃষিদ্রব্য, ঔষধ শিল্প রপ্তানি করে বাংলাদেশ বৈদেশিক আয় করে থাকে। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য রপ্তানি বহুমুখী নীতি গ্রহণ করতে হবে। মেধাবী ও সম্ভাবনাময় তরুণদের মাধ্যমে রপ্তানির নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। উদ্ভাবনের মাধ্যমে প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশের সামরিক শক্তি বাড়ানোর ক্ষেত্রে তুরষ্ক, চীন ও রাশিয়ার সহযোগিতা নিতে হবে। বিশেষ করে বিমানবাহিনীর সক্ষমতা আরও বৃদ্ধি করার দিকে দৃষ্টিপাত করতে হবে।
ভারত-পাকিস্তানের এই উত্তেজনা দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ভারত এই অঞ্চলে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলশ্রুতিতে পাকিস্তান বৈশ্বিক শক্তি চীনের সাথে বলয় তৈরি করতে বাধ্য হয়েছে। ইতোমধ্যে চীন পাকিস্তানের সাথে নিরাপত্তা, কৌশলগত সহযোগিতা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করার কথা পুনর্ব্যক্ত করেছে। তুরস্কও দাড়িযেছে পাকিস্তানের পাশে যা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার প্রভাব পরবর্তীতে অন্য রাষ্ট্রে ছড়িয়ে পরবে কি না সেটির জন্য প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। ইতোমধ্যে হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারতে সংখ্যালঘু মুসলিমদের বাংলাদেশী হিসেবে আখ্যা দিয়ে নির্যাতনের নতুন মাত্রা যোগ করা হয়েছে। ২০১৯ সালে এনআরসি ও সিএএ আইন তৈরি করে আসামে বসবাসরত মুসলিমদের নাগরিকত্বকে অস্বীকার করা হয়েছে। মিয়াঁ সম্প্রদায়ভুক্ত এই জনগোষ্ঠীকে বহিরাগত অথবা বাংলাদেশী হিসেবে আখ্যা দিয়ে বিভিন্ন ধরণের বয়ান তৈরি করা হচ্ছে। ভারত বরাবরই অসত্য ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মিডিয়া ট্রায়ালের মাধ্যমে এসব ন্যারেটিভ তৈরি করছে। বস্তুত, ভারতের এসব কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের জন্য চাপ সৃষ্টি এবং নতজানু করে রাখার পরিকল্পনার অংশ।
বর্তমানেও বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্ক স্বস্তিকর নয়। ভারতে শেখ হাসিনার আশ্রয়, সীমান্ত উত্তেজনা, ভিসা জটিলতা, করিডর ব্যবহারে বিধিনিষেধ ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে দুই দেশের সম্পর্কের সংকট ঘনীভূত হয়েছে। বিমসটেক সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টা ড.ইউনূস ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই বৈঠকের মাধ্যমে বাংলাদেশ ভারতের সাথে সমপর্ক স্বাভাবিক করার আগ্রহ দেখালেও ভারত তাতে সায় দেয়নি।
সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার চীন সফরের মাধ্যমে বেশ কিছু অর্জন নজর কেড়েছে। তিস্তা বাঁধ প্রকল্প, এক হাজার শয্যা বিশিষ্ট তিনটি হাসপাতাল নির্মাণ ইত্যাদি প্রকল্প বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রাখবে। এছাড়া পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কের উন্নতি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। দুইদেশের সচিব পর্যায়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ১৯৭১ সালের পূর্বের সম্পদ উদ্ধার ও গণহত্যার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষমা প্রার্থনার কথা বলা হচ্ছে।
এভাবে বাংলাদেশ সব রাষ্ট্রের সাথে জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করে বৈদেশিক নীতি গ্রহণ করছে। ভারত-পাকিস্তানের অনাগ্রহের জন্য দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সংস্থা ‘সার্ক’ এখন অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্রগুলোর মাঝে এখন কোনো কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী নেই। রাষ্ট্রগুলো বাস্তববাদ পদ্ধতি গ্রহণ করার মাধ্যমে অপর রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব কিংবা বৈরিতা তৈরি করছে। বাংলাদেশকেও এই পথ অনুসরণ করে নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। ভারতের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে হলে নায্যতা ও সমতার ভিত্তিতে করতে হবে। শক্তিসাম্য তত্ত্ব অনুযায়ী, শান্তি স্থাপন হচ্ছে রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত সম্পর্ক এবং এটা হতে হবে রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে শক্তির সাম্যব্যবস্থা বজায় রেখে। তাই চীনের সাথে অর্থনৈতিক, বানিজ্যিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক বাড়াতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্বার্থে এবং ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের কৌশলগত সম্পর্কের উন্নয়ন করা প্রয়োজন। এছাড়া নেপাল, ভূটান ও শ্রীলংকার সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ত্বরান্বিত করতে হবে।
এবার থাইল্যান্ড সফরে প্রধান উপদেষ্টা দক্ষিণ-পূর্ব আঞ্চলিক সংস্থা-আসিয়ানে যোগদানের ব্যাপারে বাংলাদেশের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। আসিয়ানভুক্ত দেশ হওয়ার সুযোগ বাংলাদেশের জন্য হবে যুগান্তকারী সফলতা। মুক্তবাণিজ্য সুবিধা এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির জন্য বহুপাক্ষিক সহযোগিতা বৃদ্ধির ব্যাপারে আসিয়ান সর্বোত্তম প্লাটফর্ম হয়ে উঠবে। পাশাপাশি রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের অগ্রগতির জন্য আসিয়ান সদস্যদের সহযোগিতা একান্ত কাম্য।
লেখক : শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়