Image description

মাত্র সাত বছরে দেশে থ্যালাসেমিয়ার রোগীর সংখ্যা তিনগুণ বেড়েছে। আর্থিকভাবে সচ্ছল রোগীরা চিকিৎসা নিয়ে বেঁচে থাকলেও সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র দরিদ্র রোগীদের বেলায়। রক্ত সংগ্রহ ও উচ্চমুখী চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে পথে বসেছেন গরিব রোগীরা। রোগী বৃদ্ধির বড় কারণ হিসেবে বিয়ের আগে বর-কনের রক্ত পরীক্ষা না করাকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।

তারা বলছেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিয়ের আগে বর-কনের রক্ত পরীক্ষা বাধ্যতামূলক না হলে অবস্থা আরো ভয়াবহ রূপ নেবে। বাবা-মা দুজনই যদি বাহক হন, তাহলে তাদের সন্তানের থ্যালাসেমিয়া রোগী হয়ে জন্ম নেওয়ার সম্ভাবনা থাকে ২৫ শতাংশ। অথচ একজন বাহক ও একজন সুস্থ ব্যক্তির মধ্যে সন্তান জন্মালে এই রোগ হয় না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের সংশ্লিষ্টদের প্রতি বিষয়টির ওপর বারবার তাগাদা দিলেও ঊর্ধ্বতনদের কাছে গুরুত্ব পায়নি। এমনকি সাত বছর আগে এ সংক্রান্ত একটি রিট আবেদন হলেও এখনো শুনানির জন্য ঝুলে রয়েছে আদালতে। থ্যালাসেমিয়া নির্মূল করতে হলে সরকারের উদ্যোগের বিকল্প নেই বলে মনে করেন তারা।

এমন প্রেক্ষাপটে আজ বৃহস্পতিবার বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য,‘থ্যালাসেমিয়ার জন্য সামাজিক ঐক্য গড়ি, রোগীদের অধিকার নিশ্চিত করি।’

দিবসটি উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

রংপুরের জহিরুল ইসলাম-রাশিদা আক্তার দম্পতির একমাত্র মেয়ে ফাতিমা। ১৪ বছরের শিশুটির তিন বছর বয়সে থ্যালাসেমিয়া শনাক্ত হয়। পরে পরীক্ষায় স্বামী-স্ত্রীর থ্যালাসেমিয়ার বাহকের বিষয়ে নিশ্চিত হন চিকিৎসক।

দীর্ঘদিন ধরে রাজধানীর মালিবাগের থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশন হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে ফাতিমার। শিশুটির মা রাশিদা জানান, ‘১৪ বছর ধরে মেয়েকে নিয়ে চরমভাবে ভুগছি। ফাতিমার তিন বছর বয়সে জ্বর হওয়ার পাশাপাশি শরীর ফ্যাকাসে হলে ডাক্তারের কাছে নেই। পরীক্ষা করে জানানো হয় ফাতিমা থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত, আমরা বাহক। আরো সন্তান নিলে সেও নাকি একই রোগে আক্রান্ত হবে। তাই, আর কোনো সন্তান নেওয়া হয়নি। বিয়ের আগে যদি আমরা এটা জানতে পারতাম, তাহলে হয়তো এমনটা হতো না।’

শুধু এই দম্পতি নয়, থ্যালাসেমিয়া সম্পর্কে জানা নেই দেশের অধিকাংশ নারী-পুরুষের। সন্তান আক্রান্ত হওয়ার পর জানতে পারছেন অভিভাবকরা। এজন্য বিয়ের আগেই বর-কনের রক্ত পরীক্ষাই এই ব্যাধি থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় বলছেন চিকিৎসকরা। এজন্য সচেতনতার পাশাপাশি বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করার ওপর জোর দিয়েছেন তারা।

তিনগুণ বেড়ে রোগী দুই কোটি

গত সোমবার মালিবাগে থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশন হাসপাতালে আয়োজিত এক কর্মশালায় মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ও রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস জানান, ২০১৮ সালে নতুন থ্যালাসেমিয়া রোগীর সংখ্যা ছিল দুই হাজার ৭২৫ জন। ২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৫১১ জনে। সাত বছরের ব্যবধানে শুধু নিবন্ধিত রোগীই তিনগুণ বেড়েছে। বাস্তব সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশের প্রায় ১১ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ থ্যালাসেমিয়ার বাহক, যা সংখ্যায় প্রায় ১ কোটি ৮২ লাখ। প্রতি বছর দেশে ৬ হাজার থেকে ৮ হাজার শিশু থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্মগ্রহণ করছে।

খরচ চালাতে না পেরে বিপাকে গরিবরা

তবে রোগী বাড়লেও বাড়ছে না চিকিৎসার পরিধি। বেসরকারি পর্যায়ে পাঁচটি সংস্থা কাজ করার পাশাপাশি বিভাগীয় মেডিকেলে হেমাটোলজি বিভাগ রয়েছে। তবে সেখানে কতসংখ্যক রোগী শনাক্ত হচ্ছে, চিকিৎসার আওতায় আসছে সেই হিসাব নেই সংশ্লিষ্টদের কাছে। তবে রাজধানীর শিশু হাসপাতাল ও বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএমইউ) হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে পারছে আক্রান্তরা। চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা রাজধানামুখী হওয়ায় খরচ বাড়ছে রোগীদের। এতে করে হিমশিম খেতে হচ্ছে দরিদ্র রোগীদের।

দেড় বছরের শিশু রীনাকে নিয়ে মেহেরপুর থেকে থ্যালাসেমিয়া হাসপাতালে এসেছেন মা আবিদা আক্তার। তিনি জানান, ‘আমার দুই মেয়ে, দুজনই থ্যালাসেমিয়ায় ভুগছে। বড় জনের সাত মাস বয়সে শনাক্ত হয়, আর ছোটজনের তিন মাস বয়স থেকে। জেলা হাসপাতালে সঞ্চালন মেশিন নেই, ওষুধও পাওয়া যায় না। তাই প্রতি মাসে আসতে হয়। ওষুধ বিনামূল্যে পাওয়া গেলেও রক্ত কিনতে হয়। দুই সন্তানের জন্য প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়। অনেক সময় খাওয়ার টাকা থাকে না।’

বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশনের মহাসচিব ডা. মোহাম্মদ আব্দুর রহিম বলেন, ‘দেশের থ্যালাসেমিয়া রোগীদের বড় অংশই নিম্ন ও মধ্য আয়ের। তাদের পক্ষে প্রতি মাসে রক্তের পাশাপাশি ওষুধের পেছনে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা খরচ করা সম্ভব নয়। আবার স্থানীয় পর্যায়ে বিশেষ করে উপজেলা ও জেলা হাসপাতালে না থাকায় রোগীদের চরম দুর্ভোগে পড়তে হয়। বিভাগীয় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সেন্টার থাকলেও সেখানে একদিনে ওষুধ ও রক্ত দিতে না পারায় রোগীরা নানাভাবে হয়রানির শিকার হন। আবার ওষুধও ঠিকমত পান না। এতে করে রোগীরা বিপাকে পড়েন। এজন্য রোগ যাতে না হয় সে ব্যাপারে জোর দিতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘থ্যালাসেমিয়া কীভাবে হয়, বাহক কী, হলে করণীয়-এসব বিষয়ে সবার জানা উচিত। নির্মূল করতে হলে বিয়ের আগে নারী-পুরুষের রক্ত পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে। কোনোভাবে পরীক্ষা ছাড়া বিয়ে হলেও গর্ভধারণের আগে ভ্রূণ পরীক্ষা করতে হবে। বিয়ের আগে করা গেলে প্রকোপ একেবারে শূন্যের কাছাকাছি আনা সম্ভব।’

ডা. আব্দুল রহিম বলেন, ‘সরকারকে আমরা বহুবার আনুষ্ঠানিকভাবে বলেছি। মন্ত্রণালয়ও এ ব্যাপারে জানে। কিন্তু আইন নিয়ে কতটা এগিয়েছে সেটা তারাই জানেন।’

হাইকোর্টে বিচারাধীন এ সংক্রান্ত রিট

২০১৮ সালে বিয়ের আগে বর-কনের রক্তে থ্যালাসেমিয়া ও মাদকের অস্তিত্ব আছে কিনা তা পরীক্ষা করে মেডিকেল সনদ দাখিল করা বাধ্যতামূলক চেয়ে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী সৈয়দা শাহিন আরা লাইলীর পক্ষে হাইকোর্টে রিট করেন অ্যাডভোকেট একলাছ উদ্দিন ভূঁইয়া। তবে প্রায় ছয় বছর হলেও এখনো শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে রিটটি।

অ্যাডভোকেট একলাছ উদ্দিন আমার দেশকে বলেন, ‘রিটটি এখনো শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। কাছাকাছি সময় এলে বেঞ্চ ভেঙে যায়। এভাবেই দেরি হচ্ছে।’