Image description

আদিতি করিম

জুলাই বিপ্লবের পর এ দেশের মানুষ আশা করেছিল একটা ‘নতুন বাংলাদেশের’। স্বপ্ন দেখেছিল বৈষম্যমুক্ত সমাজের। হানাহানি, মারামারি, লুণ্ঠন বন্ধ হবে, দেশ একটা সাম্যের, সৌভ্রাতৃত্বের দেশ হিসেবে আমরা নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ করব—এমন একটা প্রত্যাশা ছিল সবার। দুর্নীতি ও লুণ্ঠনের বিপরীতে এক সুশাসনের বাংলাদেশ দেখতে চেয়েছিল সবাই।

কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের ৯ মাস পেরোনোর পর সেই প্রত্যাশার ফানুস কেন যেন চুপসে যাচ্ছে ক্রমশ। একটি বিশেষ মহল যেন জুলাই বিপ্লবের স্বপ্ন ধ্বংসের চেষ্টা করছে অবিরত। তারা ছাত্রদের বিভ্রান্তির পথে উসকে দিচ্ছে। আবার বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের জন্য নির্বাচনকে অনিশ্চিত করার ষড়যন্ত্র এখন দৃশ্যমান।
সঙ্গে দেখা যাচ্ছে এক-এগারোর মতো অর্থনীতিবিনাশী তৎপরতা। মানুষ আস্তে আস্তে আশাহত হচ্ছে। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, আইন-শৃঙ্খলা কোথাও কোনো সুখবর নেই। বরং এক অনাগত অনিশ্চয়তাকে যেন আলিঙ্গন করে নিচ্ছে বাংলাদেশ প্রতিনিয়ত।

জুলাই বিপ্লবের নায়ক ছিলেন এ দেশের তরুণসমাজের শিক্ষার্থীরা। কিন্তু সেই জুলাই বিপ্লবের নায়কদেরও কেউ কেউ আজ যেন ভিন্ন পথে হাঁটতে শুরু করেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে তাঁদের বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ উঠেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলী ছাড়াও বেশ কিছু মন্ত্রণালয়ে বিভিন্ন পদে ছাত্র প্রতিনিধিদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) হিসেবে নিয়োগ পান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সংগঠক মোয়াজ্জেম হোসেন।

তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের মধ্যেই তাঁকে ওই পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তুহিন ফারাবীও ছিলেন গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী এক সক্রিয় যোদ্ধা। ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর তাঁকে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগমের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তাঁর বিরুদ্ধেও শতকোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। তাঁকেও দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এই দুই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধির বিরুদ্ধে তদবির বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্য, টেন্ডার বাণিজ্যের মাধ্যমে শতকোটি টাকা হাতিয়েছেন এমন অভিযোগের মধ্যেই তাঁদের অব্যাহতি দেওয়া হয়। ছাত্রনেতা থেকে ‘সরকারি কর্মকর্তা’ বনে যাওয়া এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে যে শতকোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে তার আশু তদন্ত দরকার। শুধু তাঁদের সরিয়ে দেওয়াই যথেষ্ট নয়। না হলে আমরা আবার সেই পুরনো সংস্কৃতিতে ফিরে যাব।

 

https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/04.April/28-04-2025/SHN/kalerkantho-ed-1a.jpgরেলওয়ে বিভাগকে লাভজনক ও জনকল্যাণকর করার কাজে ‘দায়িত্ব’ দেওয়া হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিন সক্রিয় কর্মীকে। এই ছাত্ররা ট্রেনের টিকিট কালোবাজারির সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সাবেক এক কর্মকর্তার এমন মন্তব্য এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। তিনি লিখেছেন, ‘রেল ভবনে এদের অবাধ বিচরণ। অবাধ বাণিজ্য। সারা দেশের কর্মচারী-কর্মকর্তাদের কাছে ত্রাস এরা তিনজন। মন্ত্রণালয়ের অনেক কর্মকর্তা এদের দেখলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে সমীহ করেন।...’ সাধারণ মানুষ এসব খবরে আশাহত, হতাশ, বিভ্রান্ত।

শুধু সরকারি দায়িত্বে থাকা ছাত্র প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধেই নয়, দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে নবগঠিত রাজনৈতিক দল এনসিপির কোনো কোনো নেতার বিরুদ্ধেও। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগে অবৈধভাবে হস্তক্ষেপ এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) পাঠ্যবই ছাপার কাগজে কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগ ছিল বহুল আলোচিত বিষয়। এ দুই অভিযোগে জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম সদস্যসচিব গাজী সালাউদ্দিন তানভীরকে দলের সব দায়িত্ব ও কার্যক্রম থেকে সাময়িক অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

দল থেকে কাউকে অব্যাহতি দেওয়া বা বহিষ্কার করা হলো সাংগঠনিক ব্যবস্থা। কিন্তু গাজী সালাউদ্দিন তানভীরের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো উঠেছে, সেগুলো প্রতিটি ফৌজদারি অপরাধ। তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে এখনো কেন আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না? সংস্কার যতটুকুই হোক আর যেভাবেই হোক, জনগণের দিক থেকে ন্যূনতম আকাঙ্ক্ষা বা প্রত্যাশা হলো রাষ্ট্রকে হতে হবে জবাবদিহিমূলক ও যথাসম্ভব দুর্নীতিমুক্ত। এ ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার এবং ‘সংস্কারপন্থী’ দল এনসিপি নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে—অনেকেরই এমন প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু তারা সেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারছে, নাকি পুরনো পথেই হাঁটছে, তা নিয়ে এরই মধ্যে জনমনে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ কি তাহলে পথ হারাচ্ছে? অনেকেই মনে করেন ছাত্রদের সরকারি কাজে নেওয়া কিংবা রাজনৈতিক দল করা একটি বিশেষ মহলের ষড়যন্ত্র। জুলাই বিপ্লবকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেই ছাত্রদের এপথে প্রলুব্ধ করেছে একটি সুশীল মহল। শিক্ষার্থীরা যদি জাতির কণ্ঠস্বর হয়ে অন্যায়, অনাচারের বিরুদ্ধে ‘ভ্যানগার্ড’ থাকতেন, তাহলে আমাদের পরিস্থিতি এমন হতো না। কেউ কেউ বিএনপিকে চাপে ফেলতে গিয়ে জুলাই বিপ্লবের নায়কদের বিতর্কিত করার পথে নিয়ে গেছে।

জুলাই বিপ্লব ছিল একটি গণ-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। জুলাই বিপ্লবের পর সবাই আশা করেছিল দ্রুত জনগণ তাদের ভোটের অধিকার ফিরে পাবে। নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। কিন্তু সংস্কার নিয়ে দীর্ঘসূত্রতা রাজনীতিতে সৃষ্টি করেছে অনিশ্চয়তা। দেশের রাজনীতিও যেন এখন গন্তব্যহীন। আবার বিরাজনীতিকরণের কুশীলবদের সরব উপস্থিতি লক্ষ করা যাচ্ছে সর্বত্র।

কোনো কোনো সুশীল মহলের দীর্ঘদিন ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার লোভ আজ ক্রমশ স্পষ্ট। নির্বাচন নিয়ে তৈরি হয়েছে এক অনিশ্চয়তা। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নির্বাচন প্রশ্নে অনৈক্য সৃষ্টি করা হচ্ছে সুকৌশলে। নতুন অশনিসংকেতের পূর্বাভাস দিচ্ছে রাজনীতিতে।

অর্থনীতিতেও কোনো সুখবর নেই। অর্থনীতির অবস্থা প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে। আইএমএফের ঋণ পাওয়া নিয়ে যেমন অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে, তেমনি আসন্ন বাজেট করতে হবে বিদেশি সহায়তার ওপর নির্ভর করে। বহুদিন বাংলাদেশ যে অবস্থান থেকে সরে এসেছিল সেই অবস্থানে আবার ফিরে এসেছে। বিশ্বব্যাংক প্রক্ষেপণ করেছে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে ৩.৩ এর আশপাশে। অর্থনীতি চাঙ্গা করার জন্য দরকার নতুন উদ্যোগ এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া বিদেশি বিনিয়োগ হবে না। এরই মধ্যে রপ্তানি বাণিজ্যে একটা টালমাটাল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ওপর নতুন শুল্ক আরোপ করেছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এই শুল্কারোপ সাময়িকভাবে স্থগিত করা হলেও সামনে পরিস্থিতি যে ভালো হবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। ভারত ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করেছে। ২০১৮ সাল থেকে যে সুবিধা বাংলাদেশকে দেওয়া হচ্ছিল, তার ফলে ৪৬ দেশে বাংলাদেশ সহজে রপ্তানি করার সুযোগ পাচ্ছিল। সেই সুযোগটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আমাদের নতুন হিসাব-নিকাশ করতে হচ্ছে। নতুন করে পাকিস্তান-ভারত উত্তেজনার ঢেউ আমাদের অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলবে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে দেশি বিনিয়োগকারীরা এখন পর্যন্ত নতুন বিনিয়োগে উৎসাহী নন। তাঁরা হাত-পা গুটিয়ে বসে আছেন। এক-এগারোর মতোই ব্যবসায়ীদের হয়রানি করার ষড়যন্ত্র করছে একটি মহল। গত ৯ মাসে পাঁচ লাখের বেশি মানুষ চাকরি হারিয়েছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, ৯ মাসে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ আবার অতিদরিদ্র হয়েছে। বেকারত্ব বাড়ছে, বাড়ছে অনিশ্চয়তা। ফলে সামনের দিনগুলোতে অর্থনীতিকে সচল রাখা একটি বড় চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। যখন বেকারত্ব বাড়ে, চাকরির সুযোগ কমে যায় তখন আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়াটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশে সেটিই  হচ্ছে। মব জাস্টিস, ছিনতাই, রাহাজানি, দস্যুতা, বিভিন্ন অফিস-আদালতে গিয়ে হুমকি, চাঁদাবাজি ইত্যাদি ঘটনা এখন পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি অন্তর্বর্তী সরকার। এগুলো কবে, কিভাবে নিয়ন্ত্রণ হবে সেটি নিয়েও নানা রকম শঙ্কা রয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির পাশাপাশি সামাজিক অসন্তোষ এবং বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে কথায় কথায় রাস্তা অবরোধ মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে। ছোট ছোট দাবিদাওয়া নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন পেশাজীবী গোষ্ঠী ঘোষণা দিয়ে আন্দোলন করছে, রাস্তা বন্ধ করে দিচ্ছে। ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের মধ্যে মারামারির ঘটনা এখন যেন একটি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। সব কিছু মিলিয়ে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে বিরাজ করছে চরম অস্থিরতা। আর এই অস্থিরতা যদি কাটিয়ে ওঠা না যায়, তাহলে সামনের দিনগুলোতে পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে।

অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস শান্তিতে নোবেলজয়ী। তিনি দায়িত্ব গ্রহণের পরই সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের কথা বলেছিলেন। কিন্তু যাঁরা এখন দায়িত্ব পালন করছেন তাঁরা যেন সেই উদ্দেশ্য থেকে ক্রমশ অন্যদিকে সরে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ যেন পথ হারিয়ে এলোমেলোভাবে ঘুরছে। সর্বনাশের কিনারে যাওয়ার আগেই তাই নির্বাচনের পথে যেতে হবে। যত দ্রুত নির্বাচন ততই মঙ্গল। যত দিন যাচ্ছে ততই জুলাই বিপ্লব নিয়ে মানুষের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। জুলাই বিপ্লবের অর্জনকে নস্যাৎ করতে একটি মহল সক্রিয়। এরাই এক-এগারোর ষড়যন্ত্রকারী। বিরাজনীতিকরণের কুশীলব। অস্থায়ী ভিত্তিতে একটা দেশ ঠিকঠাকমতো চলতে পারে না। এটা সম্ভব নয়। গত ৯ মাসে এটা প্রমাণিত হয়েছে। এ কারণেই জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। জনগণই প্রজাতন্ত্রের মালিক। কাজেই জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে পারে একমাত্র নির্বাচিত সরকার। শুধু লক্ষ রাখতে হবে বাংলাদেশে নির্বাচনের মাধ্যমে যেন নতুন কোনো ফ্যাসিবাদী বন্দোবস্ত কায়েম না হয়। নতুন সরকার যেন আবার নতুন করে স্বৈরাচার না হয়। নতুন সরকারকে যেন চাটুকার, সুবিধাভোগীরা ঘিরে না ফেলে। নতুন সরকার যেন জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়ে যায়। ক্ষমতার লোভের কারণে তারা যেন এমন কোনো আইন-কানুন পাস না করে, যাতে জনগণের হয়রানি হয়। চিরস্থায়ীভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তারা যেন নির্বাচনী ব্যবস্থাকে কলুষিত না করে সে জন্য তরুণসমাজের জাগ্রত ভূমিকা যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন জনগণের ঐক্য। আমাদের মনে রাখতে হবে, ঐক্যই হলো বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শক্তি। যখনই আমরা বিভক্ত হব তখনই আমরা পরাজিত হব।

 

 লেখক : নাট্যকার ও কলাম লেখক