Image description
আলফাজ আনাম
 
বাংলাদেশের স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতিকে ভারত দেখছে রেডলাইন অতিক্রম হিসেবে। শেখ হাসিনার দেড় দশকের শাসনামলে বাংলাদেশের কার্যত কোনো পররাষ্ট্রনীতি ছিল না। এ সময় বাংলাদেশের অবস্থান শুধু ভারতের পক্ষপুটে ছিল না, দিল্লির পররাষ্ট্রনীতি পুরোপুরি অনুসরণ করেছে ঢাকা। আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশ ছিল অনেকটা ভারতের প্রক্সি দেশ। নেপাল ও ভুটানের মতো দেশ যতটা আত্মমর্যাদার সঙ্গে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছে, বাংলাদেশের পক্ষে সেই সম্পর্ক রক্ষা করে চলা সম্ভব ছিল না।
হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশের মানুষের সবচেয়ে বড় অর্জন সম্ভবত পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শিরদাড়া সোজা রেখে চলার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশের স্বাধীন অবস্থান কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না দেশটি। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের চীন সফর এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সঙ্গে জাতিসংঘে একটি বৈঠকের পর থেকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রচারযুদ্ধ শুরু করেছে ভারত। ভারতের গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে, এর মাধ্যমে বাংলাদেশ নাকি ভারতের তথাকথিত লক্ষণরেখা অতিক্রম করে ফেলেছে। এরপর আমরা দেখছি, বাংলাদেশের ওপর নানাভাবে চাপ প্রয়োগের নীতি গ্রহণ করেছে ভারত। বাংলাদেশের রপ্তানি-বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত করার জন্য বাতিল করেছে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা। কিন্তু ভারতের এসব চাপের কাছে বাংলাদেশ যে মাথানত করবে না, তা খুবই স্পষ্ট। এর মধ্যে পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখতে দুদেশ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এর অংশ হিসেবে ১৫ বছরের বেশি সময় পর দুদেশের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠক হয়েছে।
পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের এই বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পাকিস্তানের কাছে অবিভাজিত সম্পদের হিস্যা চাওয়া হয়েছে। পাকিস্তান এ নিয়ে আলোচনায় সম্মতি জানিয়েছে বলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব জানিয়েছেন। যদিও এই পাওনা কীভাবে আদায় হবে, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। কিন্তু পাকিস্তানের কাছে এই পাওনা দাবির সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের সম্পদ ভারতে লুট করে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি আবার সামনে এসেছে।
মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, গোলাবারুদ, সামরিক-বেসামরিক যানবাহন ও অর্থ লুট করে নিয়ে যায় ভারতের সেনাবাহিনী। এগুলো ছিল পুরোপুরি বাংলাদেশের সম্পদ। টাকার অঙ্কে লুটপাট হওয়া এই সম্পদের পরিমাণ কয়েক বিলিয়ন ডলার। মুক্তিযোদ্ধাদের চোখের সামনে এসব লুটপাট হয়েছে। কিন্তু তারা কিছুই করতে পারেনি। কারণ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দায়িত্ব তখনো তাদের হাতে আসেনি। ভারতীয়রা তখন ঢাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রেখেছিলেন মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী বীরবিক্রম। ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে তিনি একটি বই লিখেছেনÑ ‘এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য’। এই বইতে তিনি ঢাকায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর লুটপাটের বিবরণ তুলে ধরেছেন।
মইনুল হোসেন চৌধুরী দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৮০০ সৈন্য নিয়ে ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া, আশুগঞ্জ, নরসিংদী হয়ে ঢাকা পৌঁছান। এরপর তার সৈন্যদের নিয়ে ঢাকা স্টেডিয়ামে অবস্থান নেন। ১৭ ডিসেম্বর তিনি ঢাকা সেনানিবাসে যান। সেখানে গিয়ে তিনি কী দেখেছিলেনÑ আসুন আমরা তার বই থেকে দেখে নিই।
দুপুরের পর আমি ঢাকা সেনানিবাসে গেলাম। আমার সঙ্গে কয়েকজন সৈন্য ছিল। আমরা সেখানে ঘণ্টাখানেক ঘোরাফেরা করি। সেনানিবাসে সর্বত্রই তখন ভারতীয় বাহিনীর উপস্থিতি। আমাকে দেখে বরং তারা অবাকই হলো। কয়েকটি ব্যারাকে গিয়ে দেখি সেখানে বন্দি পাকিস্তানি সৈনিক। জেনারেল রাও ফরমান আলীসহ অন্য কিছু সেনা-অফিসারকে তৎকালীন স্কুল রোডের (বর্তমানে স্বাধীনতা সরণি) এক বাড়িতে দেখলাম। পরে আমি সেন্ট্রাল অর্ডন্যান্স ডিপোতে (আর্মির কেন্দ্রীয় গোলাবারুদ ও রসদপত্রের স্টোর) গেলাম। আমাকে ডিপোতে প্রবেশ করতে বেশ বেগ পেতে হলো। পরিচয় প্রদানের পর কর্মরত ভারতীয় মেজর আমাকে ডিপোতে প্রবেশ করতে দিলেন। সেখানে প্রচুর রসদপত্র ও আনুষঙ্গিক স্টক থাকার কথা থাকলেও তা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ছিল না। আমি কিছু তাঁবুর ব্যবস্থা করলাম আমার সৈনিকদের জন্য। সন্ধ্যার দিকে আমি সেনানিবাস ত্যাগ করি।
এরপর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী তার বইয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর লুটপাটের চিত্র তুলে ধরেছেন।
এরপর আরো কয়েক দিন আমি ঘনঘন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে যাই। অর্ডন্যান্স ডিপোও পরিদর্শন করি। লক্ষ করি, সেখানকার রসদসামগ্রী ও অন্যান্য স্টক ক্রমাগত কমছে। আমি আগে থেকেই ব্যবস্থাকৃত কিছু তাঁবু নিয়ে চলে আসি। উল্লেখ্য, ১৯৭৭ সালের জুলাই মাসে ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশিত আইডিএস বুলেটিনের (ভলিউম ৯, নং-১) ১২ পৃষ্ঠায় প্রদত্ত রেফারেন্স থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানের অন্তত চারটি ডিভিশনের অস্ত্রশস্ত্র, ভারী কামান, গোলাবারুদ এবং অন্য সাজসরঞ্জাম ও যানবাহন ভারতে নিয়ে যায়। পরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রতিবাদ করলে টোকেন হিসেবে কিছু পুরোনো অস্ত্র ফেরত দেওয়া হয়।
এখানে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করতে হয়। ১৯৭২ সালের মাঝামাঝি সময়ে ব্রিগেডিয়ার মিশ্রর, .. সামরিক বাহিনীতে কোর্ট মার্শাল হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে ফিজ, আসবাবপত্র, ক্রোকারিজ ইত্যাদি সামরিক-বেসামরিক সামগ্রী ট্রাকে করে ভারতে পাচার করেছিলেন। ১৯৭২ সালের প্রথম দিকে ঢাকা সেনানিবাসের গেটে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দুজন সদস্য একটি মালভর্তি ট্রাক আটক করেন, যা ভারতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল বলে অভিযোগ ওঠে। পরে পাচারের জন্য ব্রিগেডিয়ার মিশ্রর নেওয়া ওইসব মূল্যবান জিনিসপত্রের একটি লিস্ট ঢাকা থেকে ভারত সরকারের গোচরে আনা হয়। ওই অভিযোগে আসামের কাছাড় জেলার শিলচর সেনানিবাসে তার ‘ফিল্ড জেনারেল কোর্ট মার্শাল’ হয়।
ওই কোর্ট মার্শালে জিনিসপত্র পাচারের পক্ষে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তৎকালীন মেজর (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব) শাহেদ সেলিম, তৎকালীন ক্যাপ্টেন শফিক ও অন্য দুজন সৈনিককে ভারতে পাঠানো হয়। তারা পাচারের ঘটনাটি সত্য বলে সাক্ষ্য দেন। তবে ওই কোর্ট মার্শালের রায় কী হয়েছিল তা আমার জানা নেই। উল্লেখ্য, ওই জিনিসপত্র বেসামরিক ট্রাকে থাকায় তা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নজরে এসেছিল। কিন্তু স্বাভাবিক কারণেই ভারতীয় সামরিক যানগুলো চেক করার কোনো সুযোগ আমাদের ছিল না।
নরসিংদী থেকে ঢাকায় পৌঁছার পর ব্রিগেডিয়ার মিশ্র কখনো আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। তিনি ঢাকা সেনানিবাসের বর্তমান ‘সিজিএস’-এর বাড়িতে উঠেছিলেন এবং ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে তার ব্রিগেডের হেডকোয়ার্টার স্থাপন করেন।
স্বাধীনতার পরপর একটা প্রবণতা বেশ লক্ষণীয় ছিল, যা ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে বেশ চমকপ্রদ বলে মনে হতো। সে সময় ঢাকার বিত্তশালী কিছু কিছু পরিবারের সঙ্গে ভারতীয় আর্মি অফিসারদের হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। এসব লোকজনের অধিকাংশই স্বাধীনতাবিরোধী ছিল এবং মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস পাকিস্তানি সেনা-অফিসারদের সঙ্গেও তাদের একই রকম হৃদ্যতা ছিল। এরা বিভিন্ন সময় পার্টি দিয়ে ইন্ডিয়ান আর্মি অফিসার ও রাজনৈতিক নেতাদের আপ্যায়ন ইত্যাদি করতেন। অনেক বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধা যুবক আমাদের কাছে এসে ওইসব ঘটনা বলতেন এবং ক্ষোভ প্রকাশ করতেন। পাকিস্তানি মেজর সালিকের উইটনেস টু সারেন্ডার বইটিতেও মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি অফিসারদের সঙ্গে ওইসব বাঙালি পরিবারের সম্পর্কের কিছু আভাস পাওয়া যায়।
বাংলাদেশ এখন কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় ভারতের কাছে এসব লুট হওয়া সম্পদের ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারে কি না, তা আমরা জানি না। তবে নতুন প্রজন্মের এই ইতিহাস জানা দরকার যে, মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতার বিনিময়ে বাংলাদেশ সব সময় ভারতকে লুটে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। ২০০৮ সালে রহস্যময় এক নির্বাচনের মাধ্যমে তারা বাংলাদেশে অনুগত সরকার প্রতিষ্ঠা করেনি, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এমন সব ব্যক্তিকে বসানো হয়েছিল, যারা সম্পূর্ণভাবে ছিল মানসিকভাবে দিল্লির দাস। শেখ হাসিনার পতনের আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন এ কে আব্দুল মোমেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি ভারতে গিয়ে বলেছি, শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখতে হবে। তাকে টিকিয়ে রাখার জন্য যা যা করা দরকার, আমি ভারতবর্ষের সরকারকে সেটা করতে অনুরোধ করেছি।’ তিনি নিজেকে গর্বের সঙ্গে ভারতের দালাল হিসেবে পরিচয় দিয়ে বলেন, ‘অনেকেই আমাকে ভারতের দালাল বলেন। কারণ অনেক কিছু হয়, আমি স্ট্রং স্ট্যাটমেন্ট দিই না। কিন্তু আমারও তো একটি কনস্টিটিউশন আছে। সেটাকে তো আমি ইগনোর করতে পারি না। আমি ভারতবর্ষকে বলেছি, আমরা এমনভাবে কাজ করব, যাতে আমাদের কোনো কারণে কোনো উসকানিমূলক কর্মকাণ্ডকে কখনো প্রশ্রয় দেব না। এটা যদি আমরা করতে পারি, ভারত এবং বাংলাদেশ উভয়ের মঙ্গল।’
এ কে আব্দুল মোমেন আরো বলেছিলেন, ‘শেখ হাসিনা আছেন বলে ভারতের যথেষ্ট মঙ্গল হচ্ছে। এই বর্ডারে অতিরিক্ত খরচ করতে হয় না। আর আমাদের উন্নতি হচ্ছে বলে ভারতে লোক যায়। ২৮ লাখ লোক আমাদের দেশ থেকে প্রতিবছর ভারতে বেড়াতে যায়। ভারতের কয়েক লাখ লোক আমাদের দেশে কাজ করে। এটি সম্ভব হয়েছে আমাদের সোনালি অধ্যায়ের ফলে। সুতরাং আমরা কোনো ধরনের উসকানিমূলক কাজ করব না।’
শেখ হাসিনার পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে শুধু ভারতের প্রতি অনুগত ছিলেন তা নয়, খোদ হাসিনা নিজেই বলেছিলেন, ‘আমি ভারতকে যা দিয়েছি, তা চিরদিন মনে রাখবে। দিল্লির দাসী হিসেবে তিনি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ভারতের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশকে একটি ভেসেল স্টেটে পরিণত করেছিলেন। ভারত অবশ্যই হাসিনাকে চিরদিন মনে রাখবে। এ কারণে তাকে আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু তার পতনের যন্ত্রণা ভারত ভুলতে পারছে না।