
সায়ন্থ সাখাওয়াৎ
‘পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ?’—নবকুমারের উদ্দেশে বলা কপালকুণ্ডলার এই উক্তি শোনেননি, এমন শিক্ষিত বাঙালি নেই। এর বহুবিধ ব্যবহার আমাদের কাছে অতিপরিচিত। জুলাই অভ্যুত্থানের ফসল নবগঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কাজ-কারবার দেখেও সেই পুরোনো প্রশ্নই মনে জাগে।
রাজনীতিতে পক্ষ-প্রতিপক্ষ চেনা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এনসিপির কথা, আচরণ ও কাজ দেখে মনে হচ্ছে, তারা পক্ষ-প্রতিপক্ষ চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে বড় ধরনের সমস্যায় পড়েছে।
এ কথা অনস্বীকার্য, বাংলাদেশে ১৬ বছর ধরে সিন্দাবাদের ভূতের মতো চেপে বসা ফ্যাসিবাদের দৈত্যটাকে তাড়িয়ে দেশছাড়া করতে যে জুলাই অভ্যুত্থান হয়েছে, তা ছাত্রদের নেতৃত্বেই হয়েছে। কিন্তু এ কথাও সত্য, ছাত্রদের নেতৃত্বে অভ্যুত্থান হলেও তাতে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও জামায়াতে ইসলামী। ডান-বাম আরো অনেকগুলো রাজনৈতিক শক্তিও সাধ্যমতো ভূমিকা রেখেছে ওই আন্দোলনে। ফলে ছাত্রদের নেতৃত্বে অভ্যুত্থান হয়েছে বলেই তারা পটপরিবর্তনের প্রধান শক্তি আর অন্যরা অপ্রধান, এমনটা ভাবার কারণ নেই। বিশেষ কৌশলগত কারণে অভ্যুত্থানের সময় বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী তাদের দলীয় ব্যানারে আন্দোলনের সম্মুখ সারিতে থাকেনি। তার থেকেও বড় কথা, এ গণঅভ্যুত্থানের ক্ষেত্র হঠাৎ করে ২০২৪ সালের জুলাইতেই রচিত হয়নি। দেশে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীরা দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে বহুমুখী নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করে ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রাম জারি রেখেছিলেন। তাদের বহু নেতাকর্মী গুম, খুন, হত্যা, হামলা ও মামলার শিকার হয়েও আন্দোলনের মাঠে ছিলেন। হেফাজতে ইসলামসহ ইসলামপন্থি কিছু দল ও কয়েকটি বামপন্থি দলেরও নেতাকর্মীরাও ফ্যাসিবাদবিরোধী ভূমিকা নিয়ে নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। তাই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদের পতনের কৃতিত্ব কারও একক নয়।
৫ আগস্ট-পরবর্তী বাংলাদেশে স্পষ্টত পক্ষ দুটো। একটি পরাজিত পলাতক ফ্যাসিবাদ পক্ষ, আরেকটি ফ্যাসিবাদবিরোধী পক্ষ, যারা গণতন্ত্র ও সুশাসনের জন্য লড়াই করেছে।
গণঅভ্যুত্থানের পরে ধীরে ধীরে ফ্যাসিবাদবিরোধী পক্ষের শক্তিগুলো আবার নিজেদের মধ্যে পক্ষ-বিপক্ষ তৈরি করেছে যার যার রাজনৈতিক স্বার্থে। এখানে তিনটি রাজনৈতিক পক্ষ বেশি আলোচনায় এসেছে। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের নবগঠিত দল এনসিপি গণঅভ্যুত্থানের কৃতিত্ব, সংস্কার ও নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নিজেদের মতানৈক্য এমনভাবে সামনে আনছে যে, মাঝে মাঝে তাদের প্রতিযোগিতা-প্রতিদ্বন্দ্বিতা শত্রুতার আভাস দিচ্ছে। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সংগ্রামের সঙ্গী বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীদের বক্তৃতা ও ভার্চুয়াল বাহাস বেশ তিক্ত হতে গিয়েও তা কিছুটা স্তিমিত হয়ে আসছে বলে মনে হচ্ছে। বিশেষ করে লন্ডনে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, যাকে বর্তমান বাংলাদেশে জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান ও নায়েবে আমির ডা. আবদুল্লাহ তাহেরের মিটিংয়ের পরে দুটি দলের একে অপরের দিকে কাদা ছোড়াছুড়ি কিছুটা কমেছে বলে মনে হচ্ছে। তবে এটা কতটা সাময়িক নাকি দীর্ঘমেয়াদি, তা এখনো বলার সময় আসেনি।
কিন্তু এনসিপির নেতাদের বক্তব্যের মধ্যে বিএনপি বিরোধিতা যেন একটা নিয়মিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এই দলটির নেতারা শুরু থেকেই বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বকেও তাদের সমালোচনার তীর বিদ্ধ করতে কোনো রকম দ্বিধা করেনি। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে নিয়ে কটূক্তি করার মতো ধৃষ্টতা দেখিয়ে সমালোচিত হয়েছেন এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসির উদ্দীন পাটোয়ারী, যদিও তোপের মুখে ফেসবুক পোস্টটি ডিলিট করেছিলেন তিনি।
সম্প্রতি মার্কিন কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক শেষে জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক অন্তর্বর্তী সরকারের সদ্য সাবেক উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বিএনপিকে নিয়ে একটি বক্তব্য দিয়ে হৈচৈ ফেলে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, প্রশাসন অনেক জায়গায় বিএনপির পক্ষে কাজ করছে, এ ধরনের প্রশাসনের অধীনে নির্বাচন করা সম্ভব নয়।
এখানেই থেমে থাকেননি নাহিদ ইসলাম। তিনি মার্কিন কূটনীতিকদের সঙ্গে দেখা করে কী বলেছেন—এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছেন, বর্তমান সময়ে যে মাঠপ্রশাসন রয়েছে, সেই মাঠপ্রশাসন মনে হচ্ছে নিরপেক্ষ আচরণ করছে না। বিভিন্ন জায়গায় জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চলছে এবং সেসব জায়গায় প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করছে। আমরা দেখছি, প্রশাসন বিএনপির পক্ষ অবলম্বন করছে অনেক জায়গায়। মাঠপর্যায়ে যেসব জায়গায় চাঁদাবাজি চলছে, সেই জায়গায়ও প্রশাসন আসলে নীরব ভূমিকা পালন করছে। এ ধরনের প্রশাসন যদি থাকে, তা হলে এর অধীনে নির্বাচন করাটা সম্ভব নয়। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের জন্য নিরপেক্ষ প্রশাসন, আমলাতন্ত্র ও পুলিশ নিশ্চিত করতে হবে।
নাহিদ ইসলামের অভিযোগ যে একবারেই মিথ্যা, সেটা হয়তো নয়; কিন্তু প্রশ্ন অন্য জায়গায়। সেটা হলো বিএনপি যে এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চাচ্ছে, তার বিরোধিতা করতে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো অংশের হয়ে বিএনপির বিরুদ্ধে খেলতে এনসিপি মাঠে নেমেছে কি না। যেখানে লন্ডন মিট-এর পরে জামায়াতে ইসলামীও রোজার আগে, মানে মধ্য ফেব্রুয়ারির আগে জাতীয় নির্বাচন চাচ্ছে, সেখানে এনসিপি সরাসরি বিএনপির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে কী বার্তা দিল? প্রশাসন বিএনপির পক্ষে কাজ করার অভিযোগ তোলার দুদিন পরেই নাহিদ ইসলাম জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে আবার বলেছেন, একটি দলকে সরিয়ে আরেকটি দলকে ক্ষমতায় আনতে জুলাই অভ্যুত্থান হয়নি। কেবল নাহিদ ইসলাম নয়, নাগরিক পার্টির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিনও বলেছেন, শুধু প্রশাসন নয়, পুরো সরকারটাই বিএনপির হয়ে কাজ করছে। নাহিদ ইসলামের কথাকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে সামান্তা বলেছেন, শুধু প্রশাসন বিএনপির পক্ষে তা নয়, আমি যদি নাহিদ ইসলামের কথা আরেকটু ব্যাখ্যা করে বলতে চাই, পুরো সরকারই আসলে বিএনপির হয়ে কাজ করছে। এখন আমরা দেখছি, প্রশাসনের সব জায়গায় বিএনপি ও জামায়াতের মানুষদের বসানো হয়েছে। সব কাজে তারা চূড়ান্ত পরিমাণে অসহযোগিতা করছে। এমনকি আগের রেজিমের মতো আমাদের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা হচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে পুরো সরকারটা বিএনপির সরকার হয়ে উঠেছে। আমাদের সকলের মিলে যে সরকার হওয়ার কথা ছিল, সেটা আর নেই। যেহেতু বিএনপির মাঠের পাওয়ার বেশি, প্রশাসনিক কাঠামোতে তার বিচরণ বেশি, এ কারণে পুরোটাই বিএনপির সরকার হয়ে গেছে।
যেখানে খোদ প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ছাত্ররাই তার সরকারের প্রাথমিক নিয়োগদাতা এবং যে সরকারে তিন ছাত্র প্রতিনিধি উপদেষ্টা হিসেবে শুরু থেকেই ছিলেন, তারা কেন প্রশাসনের সব জায়গায় বিএনপি ও জামায়াতের মানুষদের বসালেন—সে প্রশ্ন তো এনসিপির উচিত আগে তাদের বসানো উপদেষ্টাদের করা।
অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর এনসিপির প্রভাব সবচেয়ে বেশি হওয়া সত্ত্বেও সেই সরকারকে প্রশ্ন না করে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে গণতন্ত্র ও নির্বাচন প্রশ্নে যৌক্তিক ঐক্য না করে অপ্রয়োজনীয় বিরোধিতার মাধ্যমে নবগঠিত দলটিকে কেউ ভুল পথে পরিচালিত করছে কি না, সেটা ভেবে দেখা দরকার।
লেখক : কবি, কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক