Image description

আলফাজ আনাম

আওয়ামী লীগের রাজনীতির ইতিহাস হচ্ছে সংঘাত, সহিংসতা ও জোরপূর্বক ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার ইতিহাস। দলটির ডিএনএতে আছে ফ্যাসিস্ট রাজনীতির সব উপাদান। বাংলাদেশের গণমাধ্যমের ওপর আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী বামপন্থি দলগুলোর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ থাকার কারণে ফ্যাসিস্ট দলটিকে এ দেশের মানুষের কাছে হাজির করা হয়েছে, প্রগতিশীল, ধর্মনিরপেক্ষ ও সংস্কৃতিমনস্ক একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে। দলটির ফ্যাসিস্ট চরিত্র সব সময় আড়াল করা হয়েছে। এমনকি আওয়ামী লীগকে একটি মধ্যবামপন্থি উদার রাজনৈতিক দল হিসেবে বিদেশিদের কাছে তুলে ধরা হতো। এ দেশের লুটেরা অভিজাতশ্রেণি ও সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের পছন্দের দল ছিল আওয়ামী লীগ। কারণ এই দলটি যখন ক্ষমতায় এসেছে, তখনই এই বিশেষ শ্রেণিকে অবাধ লুটপাটের সুযোগ দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে এ দেশকে গড়ে তোলার সুযোগ ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক কৌশল ও সিপিবির অব্যাহত প্ররোচনায় শেখ মুজিব একনায়কত্ববাদী শাসন কায়েম করেন। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর করে বাকশাল মডেল হাজির করেন। বাংলাদেশে নির্বাচনব্যবস্থা প্রথম ধ্বংস করেন শেখ মুজিব। এখনকার তরুণরা যেমন ২০১৪ সালের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচন, ২০১৮ সালে রাতের নির্বাচন কিংবা ২০২৪-এর ডামি নির্বাচন নিয়ে হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। ১৯৭৩ সালেও বাংলাদেশের তরুণদের অবস্থা একই ধরনের ছিল।

১৯৭৩ সালে স্বাধীনতার পর প্রথম নির্বাচনে ১৪টি রাজনৈতিক দলের ১০৯১ জন প্রার্থী থাকলেও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগের ১১ জন আগেই নির্বাচিত হন। বাকি ২৮৯ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১ কোটি ৯৩ লাখ প্রদত্ত ভোটের মধ্যে ১ কোটি ৩৮ লাখ ভোট আওয়ামী লীগ পেয়েছে বলে দেখানো হয়। এর মধ্যে ২৮২ আসনে বিজয়ী দেখানো হয়। ছাত্রলীগ ভেঙে তৈরি হওয়া সিরাজুল আলম খানের জাসদ ২৩৭ আসলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সোয়া ১২ লাখ ভোট পেয়ে আসন পায় ১টি। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতা খোন্দকার মোশতাক আহমদকে জেতানোর জন্য মুজিবের নির্দেশে হেলিকপ্টারে করে ব্যালট পেপার গণভবনে এনে তাকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়।

১৯৭৩ সালের নির্বাচনে শেখ মুজিব বিরোধী দলবিহীন একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠেন। প্রশাসন পরিচালনার ন্যূনতম শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার দিকে তার মনোযোগ ছিল না। হাসিনার শাসনের মতো সে সময়ও শেখ পরিবার বাংলাদেশের অধিকর্তা হয়ে ওঠেন। দুর্নীতি, লুটপাট ও অব্যবস্থাপনার ফল হিসেবে নির্বাচনের এক বছরের কম সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে মানুষ ভয়ংকর এক দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হয়। যে দুর্ভিক্ষে মারা যায় কয়েক লাখ মানুষ। বিখ্যাত সাংবাদিক জন পিলজার ডেইলি মেইলে সেই দুর্ভিক্ষের সময় এক বিকালের চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে লিখেছেন, ‘সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে এবং আমার গাড়ি ইসলামিক মানবকল্যাণ সমিতি আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের লরির পেছনে পেছনে চলছে। এই সমিতি রোজ ঢাকার রাস্তা থেকে দুর্ভিক্ষের শেষ শিকারটিকে কুড়িয়ে তুলে নেয়। সমিতির ডাইরেক্টর ডা. আব্দুল ওয়াহিদ জানালেন, স্বাভাবিক সময়ে আমরা হয়তো কয়েক ডজন ভিখারির মৃতদেহ কুড়িয়ে থাকি কিন্তু এখন মাসে অন্তত ৬০০ লাশ কুড়াচ্ছিÑ সবই অনাহারজনিত মৃত্যু। লরিটা যখন গোরস্তানে গিয়ে পৌঁছাল, ততক্ষণে সাতটি লাশ কুড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে চারটি শিশুর। সবকটি বেওয়ারিশ।’ অমর্ত্য সেন তার পোভার্টি অ্যান্ড ফেমিনস বইয়ে এই দুর্ভিক্ষের জন্য রাজনীতিবিদদের দুর্নীতিকে দায়ী করেছেন।

 

hasina palaina

 

বাংলাদেশের গণমাধ্যম শেখ মুজিবের দুঃশাসনের ইতিহাস মুছে দিয়েছিল। শেখ মুজিবের ব্যর্থতা ঢাকতে হাসিনা সব সময় মুজিবকে দেবতার আসনে বসানোর চেষ্টা করে গেছেন। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, এ দেশের নতুন প্রজন্ম হাসিনার বানানো ইতিহাস প্রত্যাখ্যান করেছে। হাসিনা শুধু মুজিবের সন্তান হিসেবে উত্তরাধিকার বহন করেননি, তার ফ্যাসিস্ট রাজনীতি তিনি বহন করছেন।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হাসিনার পতন ও পলায়নের পর আওয়ামী লীগ নেতাদের নিরাপদ আশ্রয় এখন কলকাতা। সেখানে তারা লুটের টাকায় বিলাসী জীবনযাপন করছেন। অন্যদিকে দিল্লিতে বসে হাসিনা অডিও বার্তায় হুংকার ছাড়ছেন, তিনি বসে নেই। নেতাকর্মীদের রাস্তায় নামার জন্য নানাভাবে উসকানি দিচ্ছেন। এমনকি পাল্টা আঘাত হানার ডাক দিয়েছেন। দেখা না দিলেও তার কথা বলা বন্ধ হয়নি।

নিজেকে আড়াল করে হাসিনার দেওয়া অডিও বার্তাগুলো বেশ রহস্যময়। বর্তমান সময়ে সবকিছু হয়ে উঠেছে ভিজ্যুয়াল। দুনিয়াজুড়ে রেডিওর শ্রোতা কমে গেছে। কিন্তু হাসিনা ভিডিও বার্তা দিচ্ছেন না। তিনি চেহারা দেখাতে রাজি নন। তার পলায়নের পর শিক্ষার্থীরা গান গেয়েছিল ‘দেখা না দিলে আপা, কথা কইও না’। তবে হাসিনা কথা বন্ধ করার মানুষ নন। দেড় দশকের শাসনে গুম, খুন ও নিপীড়নমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তার লাগামহীন মুখের কথা এ দেশের মানুষের ক্ষোভের অন্যতম কারণ ছিল।

এখন পর্যন্ত সোশ্যাল মিডিয়ায় অডিও বার্তায় তার যেসব কথা শোনা যাচ্ছে, তাতে দুই হাজার মানুষের মৃত্যু ও প্রায় ২০ হাজার মানুষের পঙ্গু করা নিয়ে হাসিনার মধ্যে নেই কোনো অনুশোচনা। নিজ দলের নেতাকর্মীদের রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে বিপদে ফেলে তিনি পালিয়ে গিয়েছেন। এ নিয়ে তার মধ্যে আত্মসমালোচনা নেই। পালানোর ৭২ ঘণ্টা আগে নিজেই বলেছিলেন, শেখ হাসিনা পালায় না। মজার ব্যাপার হলো, তিনি যখন ছাত্রদের হত্যার নির্দেশ দিয়ে টেলিভিশনের সামনে বাগাড়ম্বর করছেন, তখন শেখ পরিবারের সব সদস্য দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। শেখ হাসিনার নির্দেশ ছাড়া তার পরিবার ও আত্মীয়স্বজন যে পালিয়ে যাননি, তা নিয়ে সন্দেহ করার কোনো কারণ নেই। এখন পর্যন্ত শেখ হাসিনার পরিবার বা আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ একজনও গ্রেপ্তার হননি। এদের সবাই বিদেশে চলে গিয়েছেন। লুটের বিপুল অর্থের অধিকারী তার স্বজনরা এখন বিদেশে বেশ সুখী জীবনযাপন করছেন। সন্তান বিদেশে লেখাপড়া করছে।

নেতাকর্মীদের অসহায় রেখে হাসিনা দলবল নিয়ে যেভাবে পালিয়ে গিয়েছেন, তাতে দলের নেতাকর্মীদের কাছে তার ক্ষমা চাওয়ার কথা। তা না করে তিনি তাদের আরো বেশি বিপদের মুখে ফেলে দিতে চাইছেন। সাধারণ মানুষের মুখোমুখি দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন। আসলে ক্ষমতার মদমত্ততার কারণে শেখ হাসিনা ছিলেন মানসিক বিকারগ্রস্ত। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, প্রথম দফায় প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় দেশের উচ্চ আদালত শেখ হাসিনাকে রঙহেডেড বলে সতর্ক করেছিল।

দিল্লিতে ভারত সরকার শেখ হাসিনাকে অনেকটাই গৃহবন্দি অবস্থায় রেখেছে। সেখানে বসে তার এখন একটাই কাজ, নতুন করে প্রতিশোধ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা। সেই পরিকল্পনা কীভাবে-কতটা বাস্তবায়ন হবে, তা নিয়ে হয়তো তিনি ভাবছেন না। দাঁত কিড়মিড় করা ভূতের মতো তিনি প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে তার বক্তব্য রাখছেন এবং প্রচার করছেন।

তার প্রতিশোধপরায়ণতা কোনো মাত্রায় ছিল পলায়নের আগে গণভবনের ঘটনাপ্রবাহ থেকে এ দেশের মানুষ জানতে পেরেছে। সেনাবাহিনী থেকে যখন বার্তা দেওয়া হয়, তারা সাধারণ মানুষের ওপর গুলি চালাতে রাজি নন, তখন তার বিদায়ঘণ্টা বেজে ওঠে। এরপরও তিনি পুলিশকে আরো বেশি গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন।

পলাতক হাসিনা এখন ভারতের সমর্থন নিয়ে প্রতিশোধস্পৃহা থেকে আবার সক্রিয় হয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন। তার দলের পলাতক নেতারা দেশকে অস্থির করতে বিপুল অর্থ হয়তো খরচ করছেন। কিন্তু গণধিক্কৃত একটি দলের পক্ষ হয়ে নেতাকর্মীরা নতুন করে কতটা ঝুঁকি নেবেন, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। আওয়ামী লীগ নেতারা দলের বিপর্যয়ে সব সময় নিজেকে আড়াল করে রাখেন। মুজিবের পতনের পর বিপ্লবী সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেতারা। এরপর আওয়ামী লীগ তিন ভাগে বিভক্ত হয়েছিলÑ আওয়ামী লীগ (হাসিনা), আওয়ামী লীগ (রাজ্জাক) ও আওয়ামী লীগ (মিজান) সংক্ষেপে হা-রা-মি।

মুজিবের পতনের সময়ের চেয়েও এবার আওয়ামী লীগের পরিস্থিতি আরো খারাপ। মুজিবের পতনের পর আওয়ামী লীগ নেতারা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাননি। কিন্তু হাসিনা শুধু নিজে পালাননি। পুরো মন্ত্রিসভা ও সব এমপি পালিয়ে গেছেন। পলাতক এই দলের পুনর্গঠনের দায়িত্ব কেউ নেবেন না। কারণ, যারাই দলের দায়িত্ব নিক না কেন, হাসিনা অতীতের মতো তাদের সন্দেহের চোখে দেখবেন। হাসিনার একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তি ও তার ছেলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু মোহাম্মদ এ আরাফাত বলেছেন, দলের নেতৃত্বে শেখ হাসিনার বিকল্প কেউ নেই। তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব নিয়ে পুনর্গঠনের কোনো সুযোগ নেই। ডয়চে ভেলের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, বর্তমান সরকারের অধীনে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নেবে না। এ থেকে বোঝা যায় শেখ হাসিনা তার স্বভাবসুলভ বিকারগ্রস্ততা থেকে উসকানির মাধ্যমে দলের নেতাকর্মীদের মাঠে নামানোর চেষ্টা করে যাবেন। দল পুনর্গঠন নিয়ে তার কোনো পরিকল্পনা নেই। দেশের মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি তার একমাত্র লক্ষ্য। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা হাসিনার ফাঁদে পা দিলে তারা আরো বেশি মাত্রায় বিক্ষুব্ধ মানুষের রোষানলে পড়বেন।