Image description
কাকন রেজাকাকন রেজা
 

গত দেড় দশকে দেশের প্রয়োজনীয় সকল প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে গেছে। সিভিল প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, সেনা প্রশাসন, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন- সকল প্রতিষ্ঠান গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। না, ৫ আগস্টের পর মানুষের বিক্ষোভে ভৌত কাঠামো নয়, পুরো কাঠামোই শেষ করে দেওয়া হয়েছিল গত দেড় দশকে। ভৌত কাঠামো গড়া যায়, মাঠে বসেও কাজ চালিয়ে নেওয়া যায়। আমাদের দেশে শামিয়ানা টানিয়েও পরীক্ষা নেওয়ার ইতিহাস রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠন না করে, অন্তত কাজ চালানোর মতন অবস্থায় না এনে অন্য যেকোনো চিন্তা আত্মঘাতী। 

কীভাবে আত্মঘাতী, বলি। নির্বাচন কমিশন বদলে গেছে, কিন্তু সারাদেশের খোলনলচে কি বদলানো সম্ভব হয়েছে? হয়নি। গত ৪টি নির্বাচন যারা যাচ্ছেতাই ভাবে করেছে, তারাই তো রয়ে গেছে। অনেকে এখানে বলবেন, কর্তায় ইচ্ছায় কর্ম। কর্তা যেভাবে নির্দেশ দিয়েছে সেভাবেই করেছে তারা। অসম্ভব রকম ভুল একটা অজুহাত। তাহলে এখন যে কর্তা হবে তার ইচ্ছারই প্রতিফলন ঘটাবে সেই নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সে অর্থে কর্তা চাইলে নতুন দলকেও ক্ষমতায় বসাতে পারবে। তাহলে? নিজেকে প্রশ্ন করে দেখুন বদলটা হলো কী। অর্ধ শতকের বেশি স্বাধীনতার বয়স। এতদিনে একটা স্বাধীন নির্বাচন কমিশন দাঁড় করানো যায়নি। পারেননি আমাদের রাজনীতিকেরা। এই ব্যর্থতা স্বীকার করতে হবে। অস্বীকার করার কিংবা শিবের গীত গেয়ে পাশ কাটানোর উপায় নেই। এই প্রজন্ম বোঝে কোনটা ভুল, কোনটা শুদ্ধ। 

সিভিল প্রশাসনের কী অবস্থা তা আমরা জানি। সিভিল প্রশাসনে উন্নতির একমাত্র উপায় ছিল দলীয় আনুগত্য। সবচেয়ে অযোগ্য লোকটাও সর্বোচ্চ জায়গায় পশ্চাদ্দেশ প্রতিস্থাপন করেছে শুধু দলীয় সিলমোহর আর তোষামুদির আধিক্যে। আমলাতন্ত্র পুরোটাই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল গত দেড় দশকের দলীয়তন্ত্রে। ওপরের দিকে কিছুটা রিপেয়ার হয়তো করা গেছে, কিন্তু নিচের দিকে? পুলিশ প্রশাসনেরও একই অবস্থা। ওপরের দিক হয়তো কিছুটা ঠিক হয়েছে, কিছু যোগ্য লোককে বসানো হয়েছে, নিচের দিকের অবস্থা তথৈবচ। 

আসি সেনা প্রশাসনের কথায়। আমাদের গর্বের জায়গা ছিল এবং এখনো আছে এই বাহিনীটাই। ৫ আগস্ট বিপ্লবের সাফল্যের পেছনে সেনা সদস্যদের অবদান চির স্মরণীয়। কিন্তু এই সেনা প্রশাসনেও ছিল নগ্ন হস্তক্ষেপ। তবে অন্যান্য প্রশাসনের সাথে সেনা প্রশাসন বা বাহিনীর পার্থক্য হলো, অন্যগুলোর নিচ দিক ঠিক করা যায়নি, আর সেনা প্রশাসন বা বাহিনীর নিচের দিকটাই ঠিক ছিল। কিছু গন্ডগোল ছিল ওপরের দিকে। যার অনেকটাই হয়তো রিপেয়ার করা গেছে। কিন্তু এত দ্রুত কি সব ঠিকঠাক করা সম্ভব? 

সম্প্রতি সেনাবাহিনী নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। ভুল বললাম, পুরো সেনাবাহিনী নয়, ব্যক্তি বিশেষ নিয়ে। বিশেষ করে সেনা প্রধানকে নিয়ে যথেষ্ট কথা হয়েছে এবং হচ্ছে। জুলাই বিপ্লবের অন্যতম নায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ পেন্ডোরার বাক্স খুলে দিয়েছেন। সেই বাক্স উন্মুক্ত হতে সহায়তা করেছেন আরেক বিপ্লবী সার্জিস আলম। এখন কথা হচ্ছে, বাহাস হচ্ছে। কিন্তু এই বাহাসের কতগুলো কথা বিপজ্জনক।

যেমন কেউ হাসনাতের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে ক্যান্টনমেন্টকে উহ্য রেখে যে, সেখান থেকে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে। অপরপক্ষে বলা হচ্ছে, ক্যান্টনমেন্টে হাসনাত, সার্জিস গিয়েছিলেন দর কষাকষির জন্য। না হলে এগারো দিন পর এ আলাপ কেন। মুশকিল হলো, এ দুটো কথাতেই ক্যান্টনমেন্টকে জড়ানো হয়েছে। অথচ ক্যান্টনমেন্টকে জড়ানোর কথা নয়। কথা হচ্ছে ব্যক্তি নিয়ে, একজন সেনা কর্মকর্তা নিয়ে, সেখানে পুরো ক্যান্টনমেন্টকে জড়ানো বিপজ্জনক। 

জেনারেল আজিজ যা করে গেছেন, তার দায়ভার আজিজের, ক্যান্টনমেন্টের নয়। হাতেগোনা কয়েকজন বিট্রেয়ারের কারণে পুরো ক্যান্টনমেন্ট বিতর্কিত হতে পারে না। মনে রাখা উচিত, বাংলাদেশ স্বাধীন করতে প্রথম রিভোল্ট করেছিল ক্যান্টনমেন্টই। সাত নভেম্বর এই ক্যান্টনমেন্টই আধিপত্যবাদের হাত থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করেছিলো। 

জুলাই বিপ্লবেও ছাত্র-জনতার সাথে এক হয়ে গিয়েছিল ক্যান্টনমেন্ট। সুতরাং আমাদের আস্থার জায়গাটাকে বিতর্কিত না করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। সাথে আরেকটু বলে রাখি, রাজনীতিক হাসনাতের বিরোধিতা করতে গিয়ে যখন বলি, হাসনাত ক্যান্টনমেন্টে গিয়েছিল নির্বাচন পেছাতে, তখন ক্যান্টনমেন্টকে রাজনীতির নিয়ামক হিসেবে আরও বেশি দৃশ্যমান করা হয়। একটা কথা পরিষ্কার, জুলাই বিপ্লবে ছাত্র-জনতার সাথে সেনাবাহিনী মিশে না গেলে বিজয়ের ব্যাপারটা অনিশ্চিত হয়ে উঠতো কিংবা দীর্ঘায়িত হতো। শহীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতো। সুতরাং ব্যক্তি-বিশেষ যে পুরো বাহিনী নয় এটা সকলেরই উপলব্ধি করা প্রয়োজন। আর বোঝা উচিত কোথায় থামাটা দরকার। 

মানুষের সর্বশেষ আশ্রয় হলো বিচারালয়। মজলুমরা প্রতিকার চাইতে যায় সেখানে। দেশের নীতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠানকে গত দেড় দশকে সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত করা হয়েছে। অসংখ্য অন্যায় করানো হয়েছে এই প্রতিষ্ঠানটিকে দিয়ে। বেগম খালেদা জিয়াকে দুই কোটি টাকা সদ্ব্যবহারে অনিয়মের অজুহাতে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। যা অসম্ভব রকম একটা ভুল ছিল। 

তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের মাধ্যমে ফ্যাসিজমের প্রতিষ্ঠা হয়েছে বিচার বিভাগের মাধ্যমেই। এখন সেই ফ্যাসিস্টরাই আবার তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা চাইছে। তারাও ইনক্লুসিভ ইলেকশনের কথা বলছে। ফ্যাসিজমের একটা পার্ট পপুলিজমও। ফ্যাসিস্টরা মানুষের মন জয় করার জন্য নানান কথা বলে, আবার ক্ষমতায় এলে করে তার উল্টোটা। বাংলাদেশের ফ্যাসিজমের ট্রেন্ডও তাই। যারা তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার জন্য আন্দোলন করেছিল, তাদের সেই আন্দোলন ছিল মূলত ক্ষমতায় যাবার জন্য। যেই ক্ষমতায় গেলো, তারাই সেই ব্যবস্থা বাতিল করলো। এখন আবার ক্ষমতাচ্যুত হয়ে সেই তত্ত্বাবধায়কের কথাই বলছে তারা। এটাই হলো ফ্যাসিজমের আজব সমীকরণ। বিগত দিনের আদালত এই ফ্যাসিজমকেই প্রশ্রয় দিয়েছিল।  

যাকগে, আসি মূলকথায়। যেখানে প্রতিটা প্রতিষ্ঠান ধ্বংসপ্রাপ্ত। সেই ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে তো দাঁড় করাতে হবে। ধরুন, এই প্রশাসন নিয়ে নির্বাচনে গেলেন, তারা গত চারটি নির্বাচনে যা করেছে, তা আবার করবে না, তার গ্যারান্টি দিতে পারবেন? গায়ের জোরে হয়তো বলবেন, পারবে না। গ্যারান্টিও দিয়ে বসবেন, কিন্তু আখেরে যে তা সম্ভব নয় আপনি নিজেও জানেন তা। এই প্রশাসন দিয়ে পুরোপুরি নিরপেক্ষ একটা নির্বাচন কি এই মুহূর্তে সম্ভব? এক কথায় না। ইউটোপিয়ান চিন্তা বাদ দিতে হবে। ইউটোপিয়ায় বসবাস কোনো কাজের কথা নয়। 

গত দেড় দশকে যেমন প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। তেমনি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নির্বাচন কেন্দ্রিক কাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। যার ফলে এখন নির্বাচন দিলে নিজ দলের মধ্যে হানাহানি শুরু হয়ে যাবে মনোনয়নকে কেন্দ্র করে। বিশেষ করে এই হানাহানিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে অন্যতম প্রধান দল বিএনপি। প্রতিটা আসনে বিএনপির দুজন থেকে চারজন করে নেতা রয়েছেন নির্বাচন করতে আগ্রহী কিংবা সক্ষম। তাদের মধ্যে একজনকে যদি মনোনয়ন দেয়া যায় অন্যরা যে বিট্রে করবে না তার নিশ্চয়তা কী? উল্টো হিতে বিপরীত হতে পারে। কেউ কেউ অন্যদল থেকে মনোনয়ন নিতে পারেন। এ নজির অসংখ্য রয়েছে এদেশে।

বিএনপির মনোনয়ন বিষয়ক ক্যাওজ থেকে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে নতুন দল এনসিপি, গণঅধিকার পরিষদের মতন দলগুলো। বিএনপির মনোনয়নবঞ্চিতরা তাদের প্রার্থী সংকট কাটাতে সহায়তা করবে। গত ছয় মাসে বিএনপির অন্তকোন্দলে মারা গেছেন বেশকিছু মানুষ। নির্বাচন নিয়ে মনোনয়ন বিষয়ক কোন্দলে এই সংখ্যা যে কয়েকগুণ হবে না তারই-বা নিশ্চয়তা কী? আর এসব মৃত্যু যে দলের জন্য নেতিবাচক হয়ে দাঁড়াবে না, তা কেউ কি অস্বীকার করতে পারবেন? প্রশ্নগুলো রাখলাম, আমাকে উত্তর দিতে হবে না, নিজের কাছে উত্তর দিন। 

গত সাত মাসে দুশো’র কাছাকাছি আন্দোলনের ধকল সইতে হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারকে। সরকারের শক্তি ছিল সদ্য ঘটে যাওয়া বিপ্লবের বিপ্লবীরা। আর এই বিপ্লবীদের সাথে ছিল ঐক্যবদ্ধ সাধারণ মানুষ। কিন্তু দলীয় সরকার যারা ক্ষমতায় থাকে তাদের ডাকে সাধারণ মানুষ পথে নামে না। নেতা-কর্মীদের অনেকেই আখের গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। যার ফলে তারাও পথে নামতে চায় না।

আসন্ন দলীয় সরকারকেও এরকম ধকল আরও বেশি সইতে হতে পারে। সাথে যোগ হতে পারে প্রশাসনের বৈরিতা। আর বৈরিতা আর আন্দোলন এ দুটো মিলে গেলে ক্ষমতার মসনদ যে কোনো সময় টলে উঠতে পারে। এর মাঝে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার ক্ষমতা বর্তমান দলগুলোর আছে কিনা সে চিন্তাটাও গুরুত্বপূর্ণ। লেখার শেষে বহুল চর্চিত কথাটা বলি, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করাটা কঠিন।