Image description
 

নয়াদিল্লিতে গত ১৭, ১৮ ও ১৯ ফেব্রুয়ারি বিজিবি ও বিএসএফের মধ্যে অনুষ্ঠিত বার্ষিক বৈঠকে কী বিষয়ে আলোচনা এবং কী সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা বিশদভাবে সংবাদমাধ্যমে আসেনি। তবে বৈঠক-পরবর্তী যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশে হিন্দুবিরোধী কোনো দাঙ্গা না হলেও ভারত সীমান্ত বৈঠকে বিষয়টি উত্থাপন করে এবং ভারতের সাংবাদিকরা বিজিবিপ্রধান মেজর জেনারেল আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকীকে এ সম্পর্কে নানা প্রশ্ন করেছেন।

অথচ তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে বছরে এমন কোনো দিন যায় না, যেদিন দেশটির কোনো না কোনো অঞ্চলে মুসলমানরা অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার না হন; মসজিদ, মাদরাসা ও মুসলমানদের দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা-ভাঙচুর না হয়। মুসলিমবিরোধী দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও হত্যাকাণ্ড ঘটে প্রায় প্রতিদিনই। কিন্তু মুসলমানদের বিরুদ্ধে অব্যাহতভাবে করা এসব কর্মকাণ্ডকে ভারত তার অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে দাবি করে। অথচ বাংলাদেশে দাঙ্গা না হলেও এ বিষয়টি নিয়ে শেখ হাসিনার পতনের পর থেকেই প্রায় সাত মাস ধরে অপপ্রচার চালিয়ে আসছে ভারত।

ভারতে সংখ্যালঘুরা বিশেষত মুসলমানরা কেমন অসহায় ও বিপন্ন অবস্থায় রয়েছেন, তা ভারতীয় সংবাদমাধ্যম বহুলাংশে চেপে গেলেও বিশ্বব্যাপী প্রচারমাধ্যম ভারতের নগ্ন চেহারা তুলে ধরতে সাহসী ভূমিকা রাখছে। আরএসএস অনুসারী মোদি দাগি দাঙ্গাবাজ, তার জঘন্য অভিপ্রায় উন্মোচন করে ওয়াশিংটন-ভিত্তিক গবেষক জনাই রাইট ‘স্বাধীন ভারতের মুসলমানদের ওপর হিংস্রতা’ শীর্ষক গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেছেন, ‘২০২৩ সালের দ্বিতীয়ার্ধে ভারতজুড়ে মুসলিমবিরোধী ঘৃণাশ্রিত বক্তৃতা ৬২ শতাংশ বেড়েছে। তিনি জানান, ৬৪ শতাংশ হিন্দু বিশ্বাস করে, হিন্দু পরিচয়ে পরিচিত হওয়া ভারতের জন্য জরুরি। বিজেপি ভারতকে পুরোপুরি হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়। উল্লেখ্য, ভারতে সাধারণ নির্বাচন ঘনিয়ে এলেই মুসলিমবিরোধী প্রচারণা ও দাঙ্গা বেড়ে যায়।’

মোদি মূলত কট্টর মুসলিমবিদ্বেষী হিন্দু রাজনীতিক ও তাত্ত্বিক ভিডি সাভারকারের শিষ্য। সাভারকার ১৯২৩ সালে তার রচিত ‘হিন্দুত্ব: হিন্দু কে?’ শীর্ষক বইতে শুধু হিন্দুদেরই তথাকথিত পবিত্রভূমি ভারতের ভূমিপুত্র হিসেবে অভিহিত করেছেন। তার মতে, মুসলমান ও খ্রিষ্টানরা হলো ‘বহিরাগত’।

ভূমিপুত্র-সংক্রান্ত সাভারকারের দাবি বাস্তবসম্মত নয়। সাভারকার ও তার শিষ্য মোদিরা যে অর্থে ভারতের ভূমিপুত্র, মুসলমানরাও একই অর্থে ভারতের ভূমিপুত্র। ভারতে বসবাসকারী মুসলমানরা নবাগত নন। তাদের আগমন ৭১১ সালে নয়, প্রায় দেড় হাজার বছর আগে। আরবীয় ইতিহাস প্রমাণ করে, ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মাধ্যমে আরবে (বর্তমান সৌদি আরবে) ইসলামের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে তা আরব বণিকদের উপমহাদেশসহ সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলোয় ছড়িয়ে পড়ে। সুতরাং দেড় হাজার বছর আগেই উপমহাদেশে ইসলাম এসেছে। যারা একটি অঞ্চলে স্থায়ীভাবে দেড় হাজার বছর ধরে বসবাস করছে, তাদের বহিরাগত কেবল নরেন্দ্র মোদির মতো উগ্র হিন্দুত্ববাদীরাই বলতে পারেন।

স্পষ্ট করে বলতে গেলে, ভারতে মুসলমানরা বহিরাগত হলে হিন্দুরাও বহিরাগত। হিন্দুরাও মধ্য এশিয়া থেকে উপমহাদেশে এসেছেন। তারা ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। মুসলমানরা আরব থেকে ভারতে আশ্রয় পাওয়ার জন্য আসেননি। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই আরবরা ব্যবসা করতে উপমহাদেশে আসতেন। সেই ধারাবাহিকতায় উপমহাদেশে এসেছে ইসলাম। মুসলিম ব্যবসায়ীদের সততা, মানবতাবাদী আচরণ ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ছাড়াও অন্যসব ক্ষেত্রে রাজা-প্রজা, ধনী-গরিবের সমতা ও সমানাধিকার প্রভৃতি গুণাবলিতে মুগ্ধ হয়ে এবং হিন্দুদের বর্ণভেদগত অত্যাচারের কারণে অতিষ্ঠ স্থানীয় হিন্দুরা দলে দলে স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেছেন।

এমনকি অনেক হিন্দু রাজা মুসলমানদের ভারত দখলের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। মুসলিম শাসকরা হিন্দুদের ধর্মীয় ও সামাজিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করেননি। এ কারণে হিন্দু ও মুসলমানরা শত শত বছর ধরে ভারতে শান্তিপূর্ণভাবে পাশাপাশি বসবাস করেছেন। কিন্তু উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের উত্থানের পর থেকে ভারতে মুসলমানদের ওপর হামলা ও নির্যাতন-নিপীড়ন শতভাগ বেড়ে গেছে। মোদি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় ২০০২ সালে গুজরাটে মুসলমানদের ওপর যে গণহত্যা, বাড়িঘর-ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ ও নারীদের ধর্ষণ করা হয়েছে, তার রেশ এখনো শেষ হয়নি। এই দাঙ্গার সময় রাজ্য পুলিশ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ দাঙ্গায় প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেয়। আলজাজিরা, নিউ ইয়র্ক টাইমস, গার্ডিয়ান, বিবিসিসহ আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমে গুজরাটে মুসলিম হত্যার করুণ কাহিনি তুলে ধরা হয়। এর বিপরীতে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা ছিল নিন্দনীয়। ভারতের তৎকালীন কংগ্রেস সরকার গুজরাটের দাঙ্গা বন্ধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। এমনকি গুজরাটের কংগ্রেস-দলীয় এমপি এহসান জাফরী হিন্দু দাঙ্গাবাজদের হাতে ২৮ ফেব্রুয়ারি নিহত হন।

মোদি ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ভারতে মুসলমানদের নির্যাতনের নতুন নতুন পন্থা বের করেছেন। তিনি ২০১৭ সালে ভারতে গরু জবাই বন্ধ করার জন্য গরু বেচাকেনা নিষিদ্ধ করেন। সুপ্রিম কোর্ট এই আইন স্থগিত করলেও মুসলমানদের বিপদ কাটেনি। মুসলিম বাড়িতে গরু জবাই করা হয়েছে, কিংবা কোনো মুসলিম পরিবারের ফ্রিজে গরুর মাংস আছে, এমন অজুহাতে মুসলমানদের মারধর, এমনকি হত্যা করা হয়। তাদের বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এ ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করতে গেলেও থানা তা গ্রহণ করে না, বরং অভিযোগকারীকে হেনস্তা করার জন্য মিথ্যা মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়।

নিউ ইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন ‘হিউম্যান রাইট্স ওয়াচ’-এর ২০১৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, গরু বিক্রি এবং গরুর মাংস খাওয়ার অভিযোগে বিজেপির সমর্থক পাহারাদাররা ২০১৫ সালের মে থেকে ২০১৮ সনের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪৪ জনকে হত্যা করে। তাদের মধ্যে ৩৬ ছিলেন মুসলিম।

মোদির শাসনামলে ভারতীয় মুসলমানদের বিরুদ্ধে আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে উগ্রপন্থি হিন্দুরা। মুসলিম নারী-পুরুষের সঙ্গে হিন্দুদের স্বতঃস্ফূর্ত বিয়েকে ‘লাভ-জিহাদ’ নামে অভিহিত করা হয়। অভিযোগ করা হয়, মুসলিম যুবক-যুবতীরা হিন্দুদের ইসলামে ধর্মান্তরিত করার জন্য প্রেমের ফাঁদে ফেলে হিন্দুদের সংখ্যা হ্রাসের চক্রান্তে লিপ্ত।

২০২৪ সালের ১৮ মে নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতের কট্টরপন্থি জাতীয়তাবাদী হিন্দুরা মোদির চারপাশে সংঘবদ্ধ হয়েছে। নির্বাচনের সময় ভোটের রাজনীতি চাঙ্গা করতে মোদি নিজেই সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের উসকানি দেন। ভারতে মুসলিম নির্যাতন-নিপীড়ন এখন অঘোষিতভাবে আইনসম্মত। আদালতের অনেকগুলো রায় এই সত্যতাই প্রমাণ করে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম বিশেষত ধর্মান্ধ সামাজিক গণমাধ্যম এখন মুসলিমবিদ্বেষী প্রচারণার মুখ্য হাতিয়ার। পত্রিকাটি দিল্লির নয়ডা এলাকার এক মুসলিম পরিবারের কাহিনি বর্ণনা করে মন্তব্য করে, ভারতে মুসলিম পরিচয়ে টিকে থাকাই এখন কঠিন হয়ে পড়েছে।

এই ব্যাধি শিক্ষাঙ্গনেও ছড়িয়ে পড়েছে। ৯ বছর বয়সি এক মুসলিম শিক্ষার্থীকে উদ্ধৃত করে ২০২৪ সালের ২৮ এপ্রিল বিবিসি এক প্রতিবেদনে জানায়, ‘আমার সহপাঠীরা আমাকে পাকিস্তানি সন্ত্রাসী হিসেবে সম্বোধন করে। হিন্দু সহপাঠীরা পরস্পরের মধ্যে বলে, ‘তাকে হত্যা কর।’ অনেক সময় তাকে নর্দমার কীট বলে অপমান করে। পরে ওই শিক্ষার্থীকে বিদ্যালয় থেকে সরিয়ে আনে তার পরিবার।

ভারতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সবচেয়ে বিপদে রয়েছে মুসলিম মেয়ে শিক্ষার্থীরা। দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ২০২৩ সালের ১০ জানুয়ারি এক প্রতিবেদনে জানায়, বিদ্যালয়ে হিজাব বা বোরকা পরা নিষিদ্ধ করার কারণে কর্ণাটকে এক হাজারের বেশি মুসলিম ছাত্রী বিদ্যালয় ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। এর বিরুদ্ধে মামলা করলে কর্ণাটক হাইকোর্ট মামলা খারিজ করে দেয়। সাধারণভাবে সারা ভারতে হিজাব ও বোরকা ব্যবহারকারী মহিলারা হিন্দুত্ববাদীদের নানা ধরনের কটূক্তির শিকার হন। সব মিলিয়ে ভারতের মুসলমানরা চরম আতঙ্কের মধ্যে জীবন কাটাচ্ছেন।

প্রকৃত অর্থে ভারতীয় হিন্দুদের কেউই সাম্প্রদায়িকতর ঊর্ধ্বে নন। কংগ্রেস আমলেই ভারতে সবচেয়ে বেশি মুসলিমবিরোধী দাঙ্গা হয়েছে। কংগ্রেস আমলেই ভাঙা হয় বাবরি মসজিদ। কংগ্রেসই স্বাধীন কাশ্মীরিদের গলায় পরাধীনতার শিকল পরায়। কংগ্রেস ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য মুসলমানদের ভোটব্যাংক হিসেবে ব্যবহার করে। আর বিজেপি হিন্দুভোট পাওয়ার জন্যই মুসলিমবিরোধী যুদ্ধে লিপ্ত। অন্যদিকে কমিউনিস্টরা কেমন মুসলিম স্বার্থবিরোধী তা জ্যোতিবসুরা দেখিয়েছেন। বাস্তবে মুসলিমবিরোধিতায় সাভারকার, গান্ধী, নেহেরু, শ্যামা প্রসাদ মুখার্জি, জ্যোতিবসু, প্রণব মুখার্জি ও মোদি সমগোত্রীয়। তাদের সবাই ছিলেন মুসলিমবিরোধী এবং বাস্তবে সাম্প্রদায়িক।

লেখক: আমেরিকা প্রবাসী সাংবাদিক ও গবেষক

মোহাম্মদ জয়নাল আবেদীন