Image description
 

খেলাপি ঋণ বিশ্বের প্রায় সব দেশেই কম-বেশি হয়। বাংলাদেশেও খেলাপি ঋণ কম-বেশি থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তা যদি মাত্রার বাইরে চলে যায়, তা হলে পুরো ব্যাংকিং খাতই হুমকির মুখে পড়ে। পতিত ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত টানা দেড় দশকের শাসনামলে সেটাই ঘটেছে।২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে সরকারি অফিস-আদালত, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ধ্বংস করার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে অসৎ ও দুর্নীতিবাজদের বসিয়ে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, পেশিশক্তির ব্যবহার, স্বজনপ্রীতিসহ বহুমাত্রিক অনিয়মের মাধ্যমে ব্যক্তিকেন্দ্রিক নিয়মকানুন প্রতিষ্ঠা করে।গণঅভ্যুত্থানে পতিত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে দেশের অর্থনীতি ও ব্যাংক খাত লুটপাট করে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। ভবিষ্যতে এই প্রবণতা বন্ধে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো এখানেও মৃত্যুদণ্ডের মতো কঠোর শাস্তির বিধান করা প্রয়োজন বলে মনে করেন ব্যাংক ও আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞরা।

 

২০০৯ সালের ১৯ এপ্রিল শিল্প খাতের খেলাপি ঋণ ডাউন পেমেন্ট ছাড়া নবায়নের সুযোগ দেওয়া হয়। ফলে ঋণখেলাপিরা এর সুযোগ নেন। ওই সময় খেলাপি ঋণ নবায়ন করতে ১৫ থেকে ৩০ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিতে হতো। এতেও ক্ষান্ত হননি ঋণখেলাপিরা। তারা আরো ছাড় নিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর চাপ প্রয়োগ করেন। ফলে ২০১২ সালের ১৪ জুন খেলাপি ঋণের নীতিমালা শিথিল করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।ফলে খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত থাকে। ২০১৩ সালের ১৯ মে খেলাপি ঋণ নবায়নের মেয়াদ বাড়ানো হয়। সেখানে বলা হয়, প্রথম দফায় দুই বছর, দ্বিতীয় দফায় এক বছর এবং তৃতীয় দফায় ছয় মাসের জন্য নবায়ন করা যাবে। এভাবেই আওয়ামী সরকারের আমলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ লোপাট চরমে পৌঁছে।২০০৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাতীয় পার্টির এমপি শেখ আবদুল হাই বাচ্চু বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান হওয়ার পর থেকে ২০১৩ সালের মার্চ পর্যন্ত বেসিক ব্যাংক ছয় হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা ঋণ দেন। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকাই দেওয়া হয় নিয়ম ভেঙে। শেখ আবদুল হাই ২০০৯ সালে যোগ দেওয়ার সময় ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল পাঁচ শতাংশ আর ২০১৪ সাল শেষে তা দাঁড়ায় ৬৮ শতাংশ। ২০১০ সালের শুরুতে হলমার্ক গ্রুপ সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। আর এনন টেক্স লোপাট করে পাঁচ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা এবং বিসমিল্লাহ গ্রুপ প্রায় ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছে।

 

২০১৫ সালের ১৫ জানুয়ারি ঋণখেলাপিদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইতিহাসে নজিরবিহীন ছাড় দেওয়া হয়। এতে ৫০০ কোটি টাকা এবং এর বেশি মেয়াদি ঋণ ১২ বছর ও চলমান ঋণ ছয় বছর মেয়াদে নবায়ন করার সুযোগ দেওয়া হয়। কিস্তির এক থেকে দুই শতাংশ অর্থ জমা দিয়েই এ সুযোগ দেওয়া হয়। ব্যাংকের কস্ট অব ফান্ডের সঙ্গে এক শতাংশ সুদ যোগ করে সুদ নির্ধারণের কথা বলা হয়। এ নীতিমালার ফলে বেক্সিমকো গ্রুপসহ সরকারের ঘনিষ্ঠ শিল্পগ্রুপগুলো দফায় দফায় খেলাপি ঋণ দীর্ঘ মেয়াদে নবায়ন করে।২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমসের নিউইয়র্ক শাখায় রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হয়। এর মধ্যে এখনো ৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার ফেরত আনা সম্ভব হয়নি। এ ঘটনার মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থ চুরি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। তবে জনমনে এখনো প্রশ্নটি ঘুরপাক খাচ্ছে, ঘটনাটি কি নিছক চুরি, নাকি সরকারের ছত্রছায়ায় লোপাটকারীদের কারসাজি।২০১৬ সালের ২০ মার্চ থেকে ২০২২ সালের ৩ জুলাই পর্যন্ত গভর্নর ছিলেন ফজলে কবির। ২০১৬ সালে ঋণখেলাপিদের আরো বড় ছাড় দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই বছরের ১৬ মে জারি করা সার্কুলারে দুই শতাংশ ডাউন পেমেন্টে খেলাপি ঋণ ১০ বছর মেয়াদে নবায়নের সুযোগ দেওয়া হয়। এ ছাড়া দুই শতাংশ ডাউন পেমেন্টে এককালীন এক্সিট সুবিধাও দেওয়া হয়।

 

বিভিন্ন খাতের খেলাপি ঋণ নবায়নে ২০১৯ সালের ১৬ মে বিশেষ নীতিমালা জারি করা হয়। এতে এক বছর গ্রেস পিরিয়ডসহ ১০ বছরের জন্য নবায়নের সুযোগ দেওয়া হয়। এ ছাড়া ২০২০ সালের এপ্রিলে ঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ বেঁধে দেওয়া হয়। এসব সুবিধার ফলে অর্থ লোপাটকারীরা আরো উৎসাহিত হয়।২০১৭ সালে ব্যাংকই দখল করা শুরু করা হয়। এ বছর ফজলে কবির গভর্নরের দায়িত্ব নেয়ার পর তার মধ্যস্থতায় ইসলামী ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংক লোপাটকারীদের হতে তুলে দেওয়া হয়। এ সময় হোটেলে বসে সিআরআর কমানোর সিদ্ধান্ত, আমানতে ছয় শতাংশ এবং ঋণে ৯ শতাংশ সুদহারের সীমা নির্ধারণ, নিয়ম ভেঙে ব্যাংকের সিএসআর তহবিলের বড় অংশই প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে দেওয়াসহ নানা বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে এস আলম গ্রুপ ইসলামী ব্যাংকের মালিকানা দখল করে। গভর্নর ফজলে কবির ও অন্য কর্মকর্তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রাত ৩টা পর্যন্ত বসে থেকে মালিকানা বদলের অনুমোদন দেন বলে অভিযোগ আছে।দখলের পর থেকেই সীমাহীন দুর্নীতির উন্মুক্ত মাঠে পরিণত হলো ইসলামী ব্যাংক। নামে-বেনামে হাজার হাজার কোটি টাকা সরিয়ে নেওয়া হয়। এমনকি বাসার কাজের বুয়া থেকে শুরু করে নানা নামে-বেনামে ঋণ বের করে নেওয়া হয়। কোনো বাছবিচার ছাড়া এমনকি ন্যূনতম নিয়ম না মেনে ব্যাংকে হাজার হাজার কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়। এস আলম গ্রুপ বহুমাত্রিক উপায়ে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা লোপাট করে ইসলামী ব্যাংক থেকে। শুধু এস আলমই নয়, বেক্সিমকো, নাসা গ্রুপসহ কয়েকটি বড় কোম্পানি সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলো থেকে ঋণের নামে ব্যাপক লুটপাট করে।২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে তখন মোট খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। বর্তমানে খেলাপি ঋণ বেড়ে আকাশ ছুঁয়েছে। জামানত না থাকায় কিছু ঋণ সরাসরি কু-ঋণে পরিণত হচ্ছে। এতেই লাফিয়ে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকায়, যা বিতরণ করা মোট ঋণের ২০ দশমিক ২০ শতাংশ।

 

প্রকৃত হিসাবে খেলাপির পরিমাণ আরো বেশি। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রকৃত খেলাপি ঋণ সাত লাখ কোটি টাকার কম হবে না। খেলাপি ঋণ যে হারে বাড়ছে, তাতে আগামী দুই বছরে খেলাপি ঋণ বেড়ে মোট ঋণের ৬০-৭০ শতাংশে দাঁড়াতে বলে আশঙ্কা ব্যাংকিং খাত-সংশ্লিষ্টদের। তা ছাড়া ১০-১৫টি ব্যাংক শতভাগ খেলাপি ঋণে জর্জর হওয়ার আশঙ্কাও আছে। প্রশ্ন হচ্ছে, খেলাপির এ বিশাল পর্বতের অর্থ আর কখনোই কি আদায় করা সম্ভব হবে?জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর থেকেই আর্থিক খাতের লোপাটকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি নিশ্চিতের মাধ্যমে শৃঙ্খলা ফেরানোর একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এই সুযোগ কাজে লাগাতে বাংলাদেশ ব্যাংককে শক্তিশালী করতে হবে। একই সঙ্গে দ্বৈত শাসন রোধে অর্থ মন্ত্রণলায়ের আর্থিক বিভাগ বন্ধ করে দিতে হবে। বেসরকারি ব্যাংকের কর্মী নিয়োগে বোর্ডের ক্ষমতা রদ করতে এবং এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্পষ্ট নির্দেশনা থাকতে হবে।বিভিন্ন দেশ অর্থ আত্মসাৎ, ঋণখেলাপি ও লুটপাটে সহায়তাকারীদের কঠোর শাস্তি দিয়ে থাকে। চীন, মঙ্গোলিয়া, ভিয়েতনাম, হংকংসহ বিভিন্ন দেশে ও ভূখণ্ডে ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতের জন্য মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার উদাহরণ রয়েছে। বাংলাদেশেও এ ধরনের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া না হলে ব্যাংক খাতে লুটপাট বন্ধ করা যাবে না।

লেখক : এমএ মাসুম