Image description

তুরস্কে নির্বাসনে থাকা অবস্থায় আমার লেখালেখি ও বক্তব্যে একাধিকবার মন্তব্য করেছিলাম, ‘শেখ হাসিনার রাজনৈতিক মৃত্যুর আগে প্রাকৃতিক নিয়মে তার পৃথিবী থেকে বিদায় হোক- সেটি আমার কাম্য নয়।’ এ কথাটির একটি প্রেক্ষাপট ছিল। ২০১৭ সালের দিকে একটি গুজব প্রায়ই শুনতে পেতাম, শেখ হাসিনা নাকি কোনো এক প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত হয়েছেন।

শুনতাম তার লিভার ও কিডনি আক্রান্ত। গুজবের ডালপালা বাড়তে বাড়তে লিভার প্রতিস্থাপন পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। তিনি নাকি গোপনে লন্ডনে তার অজানা রোগের চিকিৎসাও নিতেন। আমি ওইসব গুজবে অবশ্য কোনোদিনই বিশ্বাস করিনি।

আমার ধারণা ছিল, দুই উদ্দেশ্য নিয়ে আওয়ামী গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনই হাসিনার বায়বীয় অসুখের গুজব ছড়িয়েছিল—১. শেখ হাসিনার প্রতি জনমনে এক ধরনের সহানুভূতি তৈরি করা এবং ২. বিরোধী দল যাতে মনে করে শেখ হাসিনা যেহেতু কিছুদিনের মধ্যেই মরে যাবেন, তাই খামোখা তার পতনের জন্য আন্দোলনের প্রয়োজন নেই।

মুশকিল হলো, শেখ হাসিনার দীর্ঘ দানবীয় শাসনে অত্যাচারিত জনগণ তখন খড়কুটো ধরে বাঁচার মতো করে তার সেসব ‘প্রাণঘাতী অসুখের’ গুজবের মধ্যে অক্ষমের সান্ত্বনা খুঁজতেন। তারা এক-এগারোর মইন-ফখরুদ্দীন সরকারের সময়কার শেখ হাসিনার ভুয়া অসুস্থতার নানারকম নাটকের কথা একেবারে ভুলে গিয়েছিলেন। ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় শেখ হাসিনা মারা গেলে বাপ আর মেয়ের অসংখ্য মূর্তিতে বাংলাদেশ যে ছেয়ে যাবেÑ সেই মহাবিপদের আশঙ্কাও আমার মনে ছিল।

ভেবে দেখুন, বিপ্লব-উত্তর বাংলাদেশে এক মুজিবের শত শত মূর্তি ভাঙতেই ছেলেমেয়েদের কত কষ্ট করতে হয়েছে। দেশজুড়ে দুজনার মূর্তি ভাঙতে হলে ঝামেলা কী পরিমাণ বাড়ত, কত বুলডোজার লাগত- সেটা ভেবেই তো ঘাবড়ে যাই। ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের আগে শেখ হাসিনা যে মারা যাননি, এতে আমি খুবই খুশি হয়েছি। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া।

যাহোক, ১৯৮১ সালে প্রভুর দেশ দিল্লি থেকে ঢাকায় প্রত্যাগত শেখ হাসিনা এখন সেই দিল্লিতেই পালিয়ে আছেন। ভারত সরকার আজ পর্যন্ত হাসিনার পালিয়ে থাকার ঠিকানা প্রকাশ করেনি। আমার দেশ-এর দিল্লি প্রতিনিধি তার বাসস্থান খুঁজে বের করার জন্য যথাসম্ভব চেষ্টা করেছেন। সে-সংক্রান্ত একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন গত সপ্তাহে প্রকাশিত হওয়ার পর পাঠকদের মধ্যে বেশ সাড়াও ফেলেছে।

ফ্যাসিস্ট শাসকের সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণের যোগাযোগ এখন কেবল ভার্চুয়াল জগতে তার বক্তৃতার মাধ্যমেই। সেসব বক্তৃতায় একবারের জন্যও শেখ হাসিনা তার শাসনকালীন গুম-খুন, ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘন, জনগণের ভোটের অধিকার হরণ এবং অবিশ্বাস্য লুটপাটের জন্য দুঃখ প্রকাশ বা ক্ষমা চাওয়া তো দূরের কথা, কোনো অপরাধই স্বীকার করেননি। তিনি নাকি এখনো বুঝতে পারছেন না তার কী এমন অপরাধ! ‘হাসিনা পালায় না’, ‘বঙ্গবন্ধুকন্যা পালায় না’—এ ধরনের বাগাড়ম্বর করার দু-তিন দিনের মধ্যে দলের সব নেতাকর্মীকে ফেলে রেখে, তাদের না জানিয়ে কেবল পরিবারের সদস্যদের নিয়ে পালিয়ে মোদির পায়ে আশ্রয় নিয়েও নির্লজ্জের মতো শেখ হাসিনা তার বক্তৃতায় যেসব জঞ্জাল উগরে দিচ্ছেন, তাতে তাকে একজন বিকারগ্রস্ত স্যাডিস্ট ছাড়া আর কিছু মনে হচ্ছে না।

তার কোনো বক্তব্যে কোনো রাজনৈতিক বয়ান, অথবা ভবিষ্যৎ কর্মসূচির কোনো রূপরেখা নেই। যেসব নামগোত্রহীন ‘আপা-আপা’ লীগের নারী-পুরুষ জুমে তার অর্থহীন প্রলাপ শুনে লাফান, তাদেরও আমার কাছে নিরেট গর্দভ বলেই মনে হয়। ভারত তার সেই প্রাচীনকালের চাণক্যর কূটনৈতিক বুদ্ধি নিয়ে এত গর্ব করে, অথচ হাসিনার এসব ‘গার্বেজ’ বক্তৃতা সে দেশের যেসব আধুনিক চাণক্য লিখে দিচ্ছেন, তাদের ইতিহাস, রাজনীতি ও কূটনীতি নিয়ে কোনোরকম জ্ঞানগম্যি আছে বলে মনে হয় না।

মোদি যেভাবে হাসিনাকে পাগলামি করার লাইসেন্স দিয়েছেন, তাতে এটা মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে, ভারত বোধহয় হাসিনার রাজনৈতিক পুনর্বাসন সম্পর্কে সব আশা ছেড়ে দিয়েছে—এখন সাপের ছুঁচো গেলার মতো না পারছে গিলতে, না পারছে উগরাতে। এ তো গেল হাসিনার ভারতে পলাতক জীবন নিয়ে আলোচনা। এবার দেশে তার আইনগত সমস্যার দিকে নজর দেওয়া যাক।

বিডিআর ম্যাসাকার

বিডিআর সৈনিকদের বিদ্রোহের নামে সেনাকর্মকর্তাদের হত্যা এবং তাদের পরিবারের ওপর পৈশাচিক নির্যাতনের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতা ও শেখ পরিবারের সদস্যদের সম্পৃক্ততার প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও শেখ হাসিনার সরাসরি হস্তক্ষেপে তাদের বিচারের আওতায় আনা হয়নি।

বিডিআর বিদ্রোহবিষয়ক জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন শেষ পর্যন্ত গত রোববার বিশেষ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে শেখ হাসিনা, তারেক সিদ্দিক, শেখ সেলিম, ফজলে নূর তাপস, নানক, মির্জা আজম ও বাহাউদ্দিন নাসিমকে কমিশনে তলব করেছে। তারা সবাই বর্তমানে পলাতক থাকায় তাদের জেরা ও গ্রেপ্তারের সুযোগ না থাকলেও অনুপস্থিতিতে বিচার করতে কোনো বাধা নেই। বিডিআর ম্যাসাকারের ভিকটিমরা আশা করছেন, বিলম্বে হলেও পালের গোদাদের বিচার এবার হবে।

২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ৯টায় বিডিআর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল সরাসরি শেখ হাসিনাকে ফোন করে অবস্থার ভয়াবহতা সম্পর্কে অবহিত করলেও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বিদ্রোহ দমন ও হত্যাকাণ্ড বন্ধে সেনাবাহিনীকে প্রয়োজনীয় তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া থেকে নিবৃত্ত করেন। প্রায় দুদিন ধরে হাসিনা নিজে পিলখানায় নারকীয় হত্যাকাণ্ড অব্যাহত রাখার সুযোগ করে দিয়েছিলেন।

২৫ তারিখ বিকালে বিডিআর বিদ্রোহের বাছাই করা নেতারা পরিকল্পনামাফিক তার সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি সেনাকর্মকর্তা ও তাদের পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করেননি। জেনারেল শাকিলসহ জিম্মি সেনা অফিসাররা জীবিত আছেন কি না, সেটাও জানতে চাননি। বরং যখন সেনাকর্মকর্তারা নির্মমভাবে নিহত এবং তাদের পরিবার পৈশাচিকভাবে অত্যাচারিত হচ্ছিল, তখন শেখ হাসিনা তার বাসভবন যমুনায় অবিশ্বাস্য নির্লিপ্ততায় খুনিদের পাঁচতারকা হোটেলের মহার্ঘ খাদ্যদ্রব্য দিয়ে আপ্যায়িত করছিলেন।

আমার দেশ-এর অনুসন্ধানে আমরা জানতে পেরেছি, কেবল জেনারেল তারেক সিদ্দিককে দিয়ে নির্দেশ প্রদানের মাধ্যমেই নয়, ক্ষেত্রবিশেষে শেখ হাসিনা নিজেও সরাসরি সংশ্লিষ্ট সেনা অফিসারদের সঙ্গে কথা বলে সেনাবাহিনীকে পিলখানা থেকে দূরে রেখেছিলেন। তিনি হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাওয়ার জন্য আরো সময় দিচ্ছিলেন। ২৬ তারিখ বিকালের দিকে সব হত্যাকারীকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেওয়ার পরই কেবল সেনাবাহিনী বিডিআর সদর দপ্তরের অভ্যন্তরে প্রবেশের অনুমতি পেয়েছিল। অতএব, পরিস্থিতিগত তথ্য-প্রমাণে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, নিরপেক্ষ বিচারে বিডিআর ম্যাসাকারে সম্পৃক্ততার অপরাধে শেখ হাসিনার সাজা থেকে বেঁচে যাওয়া কঠিন হবে।

গুম-খুন

২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সময়কালে বাংলাদেশে পুলিশ, র‍্যাব, সেনাবাহিনীর কিছু অংশ নির্বিচারে যে গুম-খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে, তার পেছনে অনেক ক্ষেত্রেই শেখ হাসিনার নির্দেশ ছিল। আমার দেশ-এর অনুসন্ধানে প্রকাশ পেয়েছে, বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর গুমে সরাসরি জড়িত থাকা সত্ত্বেও নির্মম ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ইলিয়াস আলীর শোকাতুর স্ত্রী ও অসহায় পুত্র-কন্যাকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ডেকে নিয়ে সহানুভূতি দেখানোর তামাশা করেছিলেন।

‘স্বজন হারানোর বেদনা’র কথা বলার মতো তামাশা রাজনৈতিক জীবনজুড়েই তিনি করে গেছেন। সুতরাং, ১৫ বছরের ফ্যাসিস্ট শাসনে হাজার হাজার নাগরিকের গুম-খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যার নির্দেশদাতার দায় (Command Responsibility) শেখ হাসিনাকেই বহন করতে হবে। আশা করি বিশেষ আদালত সঠিকভাবে তার বিচার সম্পন্ন করতে পারবে।

জুলাই বিপ্লবে গণহত্যা

মহান জুলাই বিপ্লবের ৩৬ দিনে শেখ হাসিনার সরাসরি নির্দেশেই তরুণ ছাত্র-জনতার ওপর যে গণহত্যা চালানো হয়েছে, তার বহু প্রমাণ আইসিটি এরই মধ্যে সংগ্রহ করেছে। ছাত্র-জনতার ওপর হেলিকপ্টার থেকে প্রাণঘাতী অস্ত্র (Lethal Weapon) ব্যবহার করে হাসিনার গুলি চালানোর নির্দেশের অডিও ইউটিউবে কোটি কোটি মানুষ শুনেছে।

এ ছাড়া তিনি ছাত্র-জনতাকে নির্বিচারে হত্যার জন্য পুলিশের তৎকালীন আইজির প্রশংসা করে সেনাবাহিনীকে যে পুলিশের মতো করে গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন, তারও যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। এ-সংক্রান্ত জাতিসংঘের প্রতিবেদন হাসিনার কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছে।

জুলাই বিপ্লব গণহত্যা নিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক দপ্তর প্রকাশিত প্রতিবেদনের এক স্থানে বলা হয়েছে—‘জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের তথ্যানুসারে ১৯ জুলাই এক বৈঠকে বিক্ষোভকারীদের হত্যার জন্য সরাসরি নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা।

ওই বৈঠকে তিনি বিক্ষোভ পরিচালনাকারী নেতা ও ‘বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী’দের গ্রেপ্তার এবং হত্যা করে লাশ গুম করার নির্দেশ দেন। অন্য এক বৈঠকে জ্যেষ্ঠ নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের তিনি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক বিক্ষোভকারীদের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করার জন্য সহিংস পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য ব্যক্তিগতভাবে আলোচনা করেছেন।’

জাতিসংঘের প্রতিবেদনজুড়েই জুলাই ও আগস্ট হত্যাকাণ্ডে শেখ হাসিনার সরাসরি সম্পৃক্ততার অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে।

বিডিআর ম্যাসাকার, ১৫ বছরব্যাপী অসংখ্য গুম-খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং জুলাই বিপ্লবে গণহত্যা চালানো ছাড়াও শেখ হাসিনা শাপলা চত্বর ম্যাসাকারে আলেম ও মাদরাসা ছাত্রদের হত্যার মূল আসামি। তার নির্দেশেই বেনজীর (তৎকালীন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার), জেনারেল আজিজ (তৎকালীন বিজিবিপ্রধান) এবং র‍্যাবের কর্নেল জিয়া (পরবর্তী সময়ে মেজর জেনারেল) মধ্যরাতে শাপলা চত্বরে ঘুমন্ত আলেমদের ওপর নারকীয় জিঘাংসা নিয়ে হামলা চালিয়েছিল।

বেশুমার হত্যা ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের বেপরোয়া লুণ্ঠনের দায়ে অভিযুক্ত এক ভয়ংকর অপরাধীর নাম শেখ হাসিনা। এ ছাড়া বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব দিল্লির পদতলে বিসর্জন দেওয়ার অপরাধেও তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হওয়া উচিত। আইন যতটুকু জানি, তাতে করে শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরানো সম্ভব হলে বাংলাদেশের চলমান আইন অনুসারে সর্বোচ্চ সাজা হতে তার বাঁচার কোনো সম্ভাবনা আমি দেখি না।

আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও একমাত্র ভারত ছাড়া পৃথিবীর সব রাষ্ট্র তাকে পরিত্যাগ করেছে। অনেক চেষ্টা করেও দিল্লি তার জন্য কোনো তৃতীয় রাষ্ট্রে আশ্রয়ের বন্দোবস্ত করতে পারেনি। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক দপ্তরের প্রতিবেদন প্রকাশের পর নিশ্চিতভাবেই আর কোনো দেশ এই দুর্গন্ধযুক্ত পচা মালের দায় গ্রহণ করতে চাইবে না। সুতরাং দিল্লিতে পলাতক জীবনই শেখ হাসিনার একমাত্র নিয়তি। সেখানে থেকেই মাঝেমধ্যে হয়তো এই বৃদ্ধা প্রলাপ বকে যাবেন। তাই বলাই যায়Ñ জীবিত অবস্থাতেই তার রাজনৈতিক দাফন সম্পন্ন হয়েছে।