

বিএনপির বর্ধিত সভায় দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বক্তব্য বড় চমক হিসেবে দেখা যায়। খালেদা জিয়া ভাষণ দেবেন, এটা তেমন প্রচার করা হয়নি। সাধারণ মানুষের মধ্যে এ নিয়ে আলোচনা খুব বেশি ছিল না। অনেকেই মনে করেছিলেন, বর্ধিত সভায় দলের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে। নির্বাচন, দলের অভ্যন্তরীণ বিষয় ও সরকারের আলোচনা–সমালোচনা করার গতানুগতিক সভা হবে। যদিও এই বর্ধিত সভার দিকে আগ্রহী সবাই দৃষ্টি রেখেছিলেন।
খালেদা জিয়ার ভাষণ বর্ধিত সভাকে যেন বিএনপির নিজস্ব কর্মসূচির গণ্ডি থেকে বের করে একধরনের জনগণের অনুষ্ঠানে পরিণত করল। সারা দেশের মানুষ দিনভর খালেদা জিয়ার ভাষণ নিয়ে আলোচনা করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও বিস্তর আলাপ হয়েছে খালেদা জিয়ার ভাষণ নিয়ে।
খালেদা জিয়া ছয় বছর পর দলীয় নেতা–কর্মীদের সামনে কথা বললেন। কিন্তু এমন না যে এর আগে দেশের মানুষ খালেদা জিয়ার ভাষণ শুনেননি। ১৯৮২ সালের ৭ নভেম্বর জিয়াউর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করে প্রথম রাজনৈতিক বক্তব্য দেন খালেদা জিয়া। ১৯৮৩ সালের মার্চ মাসে দলের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হন। এপ্রিল মাসে দলের বর্ধিত সভায় বক্তব্য প্রদান করেন। এরপর তিনি মাঠে–ময়দানে অজস্র বক্তব্য দিয়েছেন।
কিন্তু খালেদা জিয়ার এবারের বক্তব্য বিশেষ গুরুত্ব বহন করছে। খালেদা জিয়া তাঁর বক্তব্যে একবারের জন্যও পুরো রাজনৈতিক জীবনের প্রতিপক্ষ শেখ হাসিনার নাম উচ্চারণ করেননি। এমনকি আওয়ামী লীগের নামও বলেননি। প্রচণ্ড দমন, নির্যাতন, বাড়ি থেকে উচ্ছেদ, বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা ও জেলে ঢোকানোর পরও খালেদা জিয়া শেখ হাসিনার নাম মুখেই আনলেন না। ভয়ংকর এক নির্যাতনের কাল অতিক্রম করার পর এ ধরনের বক্তব্য বা অত্যাচারীর নাম মুখে না আনা এককথায় বিস্ময়কর।
খালেদা জিয়া তাঁর রাজনৈতিক জীবনে দেশকে শক্ত হাতে আঁকড়ে ধরে ছিলেন। বাংলাদেশের বিষয়ে তাঁকে কখনোই টলানো যায়নি। খালেদা জিয়া রাজনৈতিক চরিত্র ও নেতৃত্বের বিশ্লেষণ আমাদের রাজনীতির গুণাগুণের পাঠোদ্ধারে ঋদ্ধ করবে।
খালেদা জিয়ার জায়গায় শেখ হাসিনা থাকলে ভাষণ কী রকম হতো বা শব্দচয়ন কোন পর্যায়ের হতো, তা সহজেই অনুমান করা যায়। গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনা অত্যন্ত অশোভন ভাষায় খালেদা জিয়াকে বারবার আক্রমণ করেছেন। শেখ হাসিনা এমনো বলেছেন, ‘এই মরে মরে, এই যায় যায়। বয়স তো আশির ওপরে। মৃত্যুর সময় হয়ে গেছে। এত কান্নাকাটি করে তো লাভ নাই।’ কোনো দায়িত্বশীল রাজনীতিবিদের ভাষা এমন হতে পারে না।
শেখ হাসিনার শাসনামলে জেল, জুলুম, লাঞ্ছনা ও অবমাননার স্বীকার হয়েও খালেদা জিয়া বিচারের দায়ভার দেশ ও জনগণের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন, বরং তিনি জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে খালেদা জিয়ার সীমাবদ্ধতা নিশ্চয়ই ছিল। তবে মানুষ হিসেবে তিনি শোভন রুচির প্রমাণ দিয়েছেন পুরো ভাষণে নিজের ওপর দিয়ে যাওয়া ভয়াবহ নির্যাতনের কথা উল্লেখ না করে। তিনি কাউকে দোষারোপ করেননি। কাউকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেননি।
ভাষণের সময় খালেদা জিয়ার অভিব্যক্তি দেখে মনে হয়েছে রোগ, শোক তাঁকে কাবু করতে পারেনি। তিনি আগের মতোই দৃঢ় ও অনঢ়। মূলত খালেদা জিয়ার অনঢ় অবস্থান, অনমনীয় মনোভাব, শেষ পর্যন্ত লড়াই করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা ও জনগণের পাশে থাকার কৌশলই তাঁকে অন্যদের থেকে এগিয়ে দিয়েছে।
খালেদা জিয়ার ক্যারিশমার কারণেই বিএনপি ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করেছিল। এরপর ২০০১ সালের নির্বাচনেও বিএনপি জোট গঠন করে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে খালেদা জিয়ার দল বিএনপি হেরে যায়। এরপর দলের ওপর বিপর্যয় নেমে আসে। দমন–পীড়নের শিকার হয় দলটি। খালেদা জিয়াকে জেলে যেতে হয় অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায়। যে কারণে তিনি ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি।
নানা উত্থান–পতনের মধ্য দিয়ে ১৯৮১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪–এর আগস্ট বিপ্লব পর্যন্ত খালেদা জিয়া দীর্ঘ ও ঘটনাবহুল রাজনৈতিক পথ অতিক্রম করেছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী পদে থেকে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন। জেলে গিয়েছেন দুইবার। রাজনীতিতে উত্থান–পতনের মধ্য দিয়ে নিজস্ব নেতৃত্বের ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছেন।
খালেদা জিয়ার রাজনীতির নিজস্ব একটি ধারা আছে। তাঁর নেতৃত্বে আছে গাম্ভীর্য, প্রজ্ঞা ও কৌশলের মিশ্রণ। ৩৬ বছর বয়সে স্বামীকে হারিয়ে দুই কিশোর সন্তানকে নিয়ে রাজনীতির মাঠে নেমেছিলেন খালেদা জিয়া। নিজে নেতৃত্ব দিয়ে বাহুধারায় বিভক্ত বিএনপিকে দুইবার ব্যালটের রাজনীতিতে জয়ী করেছেন। একাধিকবার দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য চাপ এসেছিল। কিন্তু দেশের বাইরে যেতে রাজি হননি তিনি।
রাজনীতিবিদদের জীবনে দুই ধরনের পাঠই থাকে। সফলতা ও ব্যর্থতা। আলোচনা ও সমালোচনাও থাকে। তা খালেদা জিয়াকে নিয়েও আছে। তবে খালেদা জিয়াকে কোনোভাবেই সমালোচনার কাঠামোর মধ্যে আটকে রেখে দেওয়া যায় না। ক্ষমতার রাজনীতিতে এ দেশের মানুষ খালেদা জিয়াকে দুহাতে আগলে রেখেছে। রাজনীতি থেকে খালেদা জিয়ার অর্জন বিশাল। কেড়ে নিয়েছে অনেক কিছুই। কিন্তু তার গাম্ভীর্য কেড়ে নিতে পারেনি।
বিতর্কিত জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থন করে খালেদা জিয়া আদালতে দেওয়া বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘বারবারই প্রমাণ হয়েছে যে বাংলাদেশ ও এ দেশের জনগণের ভাগ্যের সঙ্গে আমার নিজের ও আমার পরিবারের ভাগ্য একসূত্রে গাঁথা হয়ে গেছে।’
খালেদা জিয়া তাঁর রাজনৈতিক জীবনে দেশকে শক্ত হাতে আঁকড়ে ধরে ছিলেন। বাংলাদেশের বিষয়ে তাঁকে কখনোই টলানো যায়নি। খালেদা জিয়া রাজনৈতিক চরিত্র ও নেতৃত্বের বিশ্লেষণ আমাদের রাজনীতির গুণাগুণের পাঠোদ্ধারে ঋদ্ধ করবে।
-
ড. মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক