Image description
ব্যারিস্টার নাজির আহমদ

প্রবাসী বাংলাদেশিরা প্রবাস থেকে যেন ভোট দিতে পারেন, এটা তাদের দীর্ঘদিনের দাবি। দুঃখজনক হলেও সত্য যে অতীতের কোনো সরকারই এই দাবি পূরণে সত্যিকার আন্তরিকতা দেখায়নি। বিগত ৫৪ বছর শুধু মুলা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। অথচ এই দেড় কোটি প্রবাসী বাংলাদেশের নাগরিক। তারা রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখেন। ভোটের অধিকার তাদের মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার। এবার যদি প্রবাসীদের ভোট দেয়ার ব্যবস্থা করা না হয় আর কখনও হয়তো করা হবে না। কোনো রাজনৈতিক সরকার করবে না। আশ্বাসের মধ্যেই রাখা হবে। সুতরাং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে সব প্রবাসীদের ঐক্যবদ্ধভাবে দাবি জানাতে হবে - আসন্ন নির্বাচনে যেকোনো উপায়ে প্রবাসীরা যেন ভোট দিতে পারেন তা নিশ্চিত করতে হবে। এবার না হলে আমাদের জীবদ্দশায় হয়তো আর হবে না। তাই সমস্বরে আওয়াজ তুলতে হবে - Now or never!

প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিয়ে হাইকোর্টে মামলা হয়েছিল সেই নব্বই দশকে। শুনানির পর হাইকোর্টের মাননীয় একজন বিচারপতি প্রবাসীদের ভোটাধিকারের পক্ষে রায় দিয়েছিলেন। এর অনেক পর তিনি আপিল বিভাগের বিচারপতি হলেন। এরপর বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি হলেন, এরপর যথারীতি অবসরে গেলেন। এরপর দুনিয়া থেকে চলে গেলেন। অথচ তাঁর রায়কে আজো বাস্তবায়ন করে প্রবাসীদের ভোটের অধিকার দেয়া হয়নি। প্রবাসীদের ভোটাধিকার দিতে অতীতের সরকারগুলোর কেন যে এত অনীহা ছিল তা বোধগম্য নয়। অথচ প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতির স্বীকৃত ‘লাইফ লাইন’।

বৈষম্য ও ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে প্রবাসী বাংলাদেশিরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। বিভিন্ন দেশে প্রবাসীরা নিজ নিজ অবস্থান থেকে দূতাবাস ও হাইকমিশন ঘেরাও করেছেন, সভা-সমাবেশ করেছেন নিয়মিতভাবে দিনের পর দিন। মধ্যপ্রাচ্যে বিক্ষোভ করতে গিয়ে অর্ধশত প্রবাসী জেল খেটেছেন। সর্বশেষে প্রবাসীরা গত বছর ৫ আগস্টের আগে মাসব্যাপী রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধ করে পতিত সরকারের টনক নাড়িয়ে দিয়েছিলেন। সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর কয়েক মাস আগে জানিয়েছেন, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর প্রবাসীদের রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ার ফলে বৈদেশিক রিজার্ভে হাত না দিয়েই বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা হয়েছে। সুতরাং এমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা দেড় কোটি প্রবাসীদেরকে অবহেলা করার কোনো সুযোগ নেই। তাদের ন্যায্য ভোটাধিকার অবশ্যই দিতে হবে, এবারই আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে।

বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি প্রবাসীদের আকুণ্ঠ সমর্থন আছে। যেকোনোভাবে এই সরকারকে সফল হতেই হবে। সরকার ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ ব্যর্থ হবে। সফল গণ-অভূত্থানের মাধ্যমে ৫৩ বছর পর দেশ গড়ার এবং দেশ গড়তে উপযুক্ত প্রতিনিধিদের ম্যান্ডেট দেয়ার এক সুবর্ণ সুযোগ এসেছে। এই সুযোগ থেকে মোট জনসংখ্যার ১০% বাংলাদেশি যারা প্রবাসে থাকেন তাদের বঞ্চিত করলে এবং তাদের মৌলিক অধিকার দিতে অবহেলা করলে বরং দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পৃথিবীর প্রায় ১৫টি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ আছে যাদের এক একটির মোট জনসংখ্যা দেড় কোটি হবে না। সুতরাং এত বিপুলসংখ্যক প্রবাসীদের ভোটাধিকারের মতো মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার দিতে অবহেলা করে রাষ্ট্রের টেকসই সংস্কার বা মেরামত করা সম্ভব নয়। দেড় কোটি প্রবাসীদের সন্তুষ্ট করুন, তাদের মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করুন, তার বিনিময়ে দেখবেন প্রবাসীরা আরো কোটি কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা করে দেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে।

পতিত সরকার ও প্রতিবেশী বড় একটি দেশ বর্তমান সরকারকে অস্থিতিশীল করার জন‍্য দেশের ভেতর ও বাইরে বহুমুখী ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বে অনবরত ব্যাপক মিথ্যা ও আজগুবি প্রচারণা এবং প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে। প্রতিবেশী বড় দেশের লবি পাওয়ার, কানেকশন, যোগাযোগ ও ডায়াসপরা অনেক বড় ও ব্যাপক। এগুলোর মোকাবেলা বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়। বাংলাদেশের একটি পজিটিভ দিক হচ্ছে- তার দেড় কোটি নাগরিক প্রবাসী। তাদের মৌলিক ভোটাধিকার দিয়ে দেশের নীতিনির্ধারক বাছাইয়ের কাজে সম্পৃক্ত করলে তারা দেশের বাইরে বাংলাদেশের জন্য এবং বাংলাদেশের ইমেজ বাড়াতে এক একজন আনঅফিসিয়াল অ্যাম্বাসেডরের ভূমিকা পালন করতে পারেন।

গত ডিসেম্বরে প্রবাস থেকে একটি বিশেষজ্ঞদের ডেলিগেশন সাক্ষাৎ করেছিলো ড. বদিউল আলম মজুমদারের নেতৃত্বাধীন পুরো নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সঙ্গে। আমিও ছিলাম ঐ ডেলিগেশনের সদস্য। প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিয়ে কমিশনের সঙ্গে বিস্তারিত আলাপ-আলোচনা হয়েছিল। আলাপে উপলব্ধি হলো যে নির্বাচন সংস্কার কমিশন নীতিগতভাবে একমত যে, প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা দরকার। যতটুকু জানি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের নেতৃত্বে গোটা নির্বাচন কমিশনও এ ব্যাপারে ইতিবাচক ধারণা রাখেন। এটা যদি হয় তাহলে আসন্ন নির্বাচনে প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে অসুবিধা কোথায়? শুধু প্রয়োজন সত্যিকারে সদিচ্ছা ও সেই সদিচ্ছা পূরণে যথাযথ কমিটমেন্ট, প্রয়োজনীয় রিসোর্স ও যোগ্য লোক। দেশের ভেতরে যোগ্য, স্মার্ট ও প্রশিক্ষিত লোকবল না থাকলে বা না পেলে বাইরের সহায়তা নেয়া যেতে পারে। পশ্চিমা বিশ্বে বসবাসকারী প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে বহু বিশেষজ্ঞ আছেন যারা সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা করতে পারেন। ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে ইমিগ্রেশন সম্পন্ন ও বেল্ট থেকে লাগেজ কালেকশন করতে হয় সেখানে এরচেয়ে বহুগুণে ব্যস্ত সিংগাপুর ও হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কয়েক মিনিটে তা করা হয়। বাস্তবে সফর করে তা যাচাই করে দেখেছি। তারা পারলে আমরা কেন পারি না? কেন পারবো না?

অন্যান্য দেশের প্রবাসীরা তাদের নিজ দেশের নির্বাচনগুলোতে ভোট দিতে পারলে আমরা কেন সেটা নিশ্চিত করতে কার্পণ্য করি? তুরস্কের বিগত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তুরস্কের প্রবাসীদের ভোট ছিল বিজয়ের ক্ষেত্রে একটি ডিসাইসিভ  ফ্যাক্টর (Decisive Factor)। সুপ্রিম ইলেকশন বোর্ড (ওয়াইএসকে) অনুসারে, বিদেশে বসবাসকারী ১৬ লাখেরও বেশি তুরস্কের নাগরিক নতুন প্রেসিডেন্ট এবং সংসদীয় প্রতিনিধিদের নির্বাচন করতে তাদের ভোট দিয়েছিলেন। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা তুরস্কের নাগরিকরা ভোট দিতে পেরেছিলেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচনে। এ লক্ষ্যে ফিনল্যান্ড, সুইডেনসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ এবং কাতার, লেবাননসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে থাকা তুরস্কের নাগরিকদের ভোট প্রয়োগ নির্বিঘ্ন করতে স্থাপিত হয়েছিল প্রয়োজনীয় সংখ্যক পোলিং বুথ।

ইউরোপের দেশ ফিনল্যান্ডে সবমিলিয়ে ৬ হাজার ৭৯১ জন তুরস্কের নাগরিক ভোট প্রয়োগ করার অধিকার পান। তাদের জন্য ফিনল্যান্ডের বিভিন্ন অঞ্চলে বুথ খোলা হয়েছিল। ফিনল্যান্ড ছাড়াও পোলিং বুথ খোলা হয়েছিল সুইডেনেও। দেশটির রাজধানীর নিকটবর্তী শহর আলভসজোতে স্থাপন করা একটি বুথে ধারণা করা হয়েছিলো ৪২ হাজার ৮০০ তুরস্কের প্রবাসী নাগরিক ভোট দেবেন। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতারে সবমিলিয়ে ভোট দেয়ার উপযুক্ত তুরস্কের প্রবাসী নাগরিক ছিলো ১০ হাজার ৮৬৮ জন। তারাও দেশটিতে স্থাপন করা পোলিং বুথে তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়েছিলেন। কাতারের রাজধানী দোহায় অবস্থিত তুর্কি দূতাবাসে স্থাপিত বুথে ভোট গ্রহণ শুরু হয়ছিল সকাল ৯টায় এবং শেষ হয়েছিল রাত ৯টায়।  এছাড়া, লেবাননে থাকা ৮ হাজার ৩৩৬ জন প্রাপ্তবয়স্ক তুরস্কের প্রবাসীদের জন্যও স্থাপিত হয়েছিল পোলিং বুথ। সেখানেও সকাল নয়টা থেকে রাত নয়টা অবধি চলেছিল ভোটগ্রহণ। তুরস্ক তাদের প্রবাসীদের ভোটের জন্য এত সুন্দর ব্যবস্থা করতে পারলে বাংলাদেশ তার প্রবাসী নাগরিকদের জন্য পারবো না কেন?

ফরাসীরা তাদের প্রবাসীদের ব্যাপারে বরং আরো এক ধাপ এগিয়ে! ফ্রান্সে তাদের প্রবাসীদের শুধু ভোটাধিকারই দেয়া হয়নি বরং ফ্রান্সের পার্লামেন্টে ১১ জন প্রতিনিধি (এমপি) নির্বাচিত হোন কেবলমাত্র প্রবাসে বসবাসরত ফ্রান্সের নাগরিকদের দ্বারা। পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ফরাসি নাগরিকদের জন্য মোট ১১টি নির্বাচনী এলাকা (Constituency) হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। যুক্তরাজ্য তাদের তৃতীয় নির্বাচনী এলাকার অন্তর্গত। এখন প্রশ্ন হচ্ছে ফ্রান্সের জন্য ফ্রান্সের প্রবাসী নাগরিকদের ভুমিকা কি বাংলাদেশের জন্য প্রবাসী বাংলাদেশীদের ভুমিকার চেয়ে বেশি? মোটেই না। বরং বাংলাদেশের জন্য বাংলাদেশের প্রবাসীদের ভুমিকা অনেক বেশি ও অগ্রগণ্য। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতির “ব্লাড সার্কোলেশন” বলে অভিহিত করা হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধে ও ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে প্রবাসীদের ভূমিকা ছিল অসামান্য। মুক্তিযুদ্ধে হানাদার বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রশস্ত্র কিনে দিয়েছিলো বৃটেনে বসবাসরত বাংলাদেশিরা। শুধু তাই নয় দেশ স্বাধীনের পর রাষ্ট্রীয় কোষাগার যখন একেবারে শূন্য ছিল তখন বৃটেনে বসবাসকারী বাংলাদেশিরা অর্ধ মিলিয়ন পাউন্ড দান করেছিলেন। এমতাবস্থায়, ফ্রান্সের পার্লামেন্টে তাদের প্রবাসীদের জন্য ১১ জন এমপির বিধান থাকলে প্রাবাসী বাংলাদেশিরা তো সেটা চাচ্ছেন না। তারা যাচ্ছেন ভোটাধিকার – ন্যুনতম মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার। এটা দিতে এতো গড়িমসি হবে কেন? আগামী নির্বাচনে প্রবাসীদের ভোট দেয়ার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। সব প্রবাসীদের এক হওয়া ও  আওয়াজ তোলাটা জরুরি।

বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায়। তারাই পারবেন প্রবাসীদের ন্যায্য  অধিকার নিশ্চিত করতে। তারা ক্ষমতায় এসেছেন একটি সফল গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে যার সক্রিয় অংশীজন ছিল দেড় কোটি প্রবাসী। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পলিটিক্যাল কোনো ব্যাগেজ  নেই। তাদেরকে তো অন্য কাউকে খুশি করতে হবে না। রাজনৈতিক দল বাইরে থাকতে যা বলে অনেক সময় ক্ষমতায় গিয়ে তা ভুলে যায়। আর এজন্যই তো দেড় কোটি প্রবাসীদের এই  ন্যায্য দাবিকে মুলা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিলো বিগত ৫৪ বছর ধরে। সুতরাং আর দেরি নয়, প্রবাসীদের ভোটাধিকার দিতে হবে, নিশ্চিত করতে হবে ভোট প্রদান আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে। এটা বাংলাদেশের প্রায় এক দশমাংশ অর্থাৎ দেড় কোটি প্রবাসীদের প্রাণের দাবি।

 

নাজির আহমদ: বিশিষ্ট আইনজীবী, রাষ্ট্রচিন্তক, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং ইংল্যান্ডের প্র্যাকটিসিং ব্যারিস্টার।