Image description

মিনার রশীদ

 

বড় বড় কথা বলার লোকের অভাব নেই। কিন্তু সে কথা অনুযায়ী কাজ করার মতো লোকের সত্যি অভাব রয়েছে। যে কাজ করা দরকার, তা কেউ করছে না। যা করছে, তা সব অকাজ আর কুকাজ। ফ্যাসিবাদের আইকন এক নেতার মূর্তি বানানোর পেছনে রাষ্ট্র কয়েক হাজার টাকা খরচ করেছে।

সেই দেবতার নামে স্যাটেলাইট ওড়াতে তিন হাজার কোটি টাকা স্রেফ পানিতে ফেলেছে! অথচ এই দেশে কয়েক কোটি বনি আদম এখনো অভুক্ত পেটে ঘুমাতে যায়। যে রাতটি আপনি পেরিয়ে এসেছেন, সেই মাধবী রাতেও তা ঘটেছে! এই বনি আদমগুলো শুধু বড় বড় কথাই শোনে, ছোট ছোট প্রয়োজনীয় কাজগুলো আর করতে দেখে না।

এই ‘ডুয়িং-নাথিং’ গেইমটি একজন ব্যক্তিকে যেমন চরম বিপদে ফেলতে পারে, তেমনি একটি রাষ্ট্রকেও। রাষ্ট্রের বিপদ নিয়ে কথা বলার আগে এক হতভাগা পুরুষ যিনি আবার এদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক ছিলেন, তিনি কীভাবে এই ‘ডুয়িং নাথিং’-এর করুণ শিকার হয়েছিলেন, সে ব্যাপারে কিছু কথা বলা জরুরি মনে করছি।

স্বনামধন্য সাংবাদিক কনক সারোয়ার ভাইয়ের সঙ্গে নিউইয়র্ক প্রবাসী লেখক ও প্রকাশক বিশ্বজিৎ সাহা একটি পিলে চমকানো তথ্য দিয়েছেন বা নতুন করে আলোচনায় টেনেছেন। তিনি দাবি করছেন, হুমায়ূন আহমেদ ক্যানসারে মারা যাননি। তিনি মারা গেছেন তার স্ত্রী শাওনের এই ‘ডুয়িং নাথিং’ গেইমের কারণে। বিশ্বজিৎ সাহা যেসব যুক্তি ও সাপোর্টিং ডকুমেন্ট দেখাচ্ছেন, তা স্বাধীন গবেষকদেরও চিন্তায় ফেলে দিয়েছে।

এটা এমন একটা গেইম যে কাউকে আপনি সরাসরি কিলার হিসেবে সাব্যস্ত করতে পারবেন না। বেচারা হুমায়ূন রোগশয্যা থেকে জীবনের অনেক গূঢ় রহস্য বা নাড়াচাড়া উপলব্ধি করলেও নিজের নাড়াচাড়ার শক্তিটুকু অবশিষ্ট ছিল না! পুরো এপিসোডটি দেখে মনে হলো, হুমায়ূন আহমেদ যদি সেই মৃত্যুশয্যা থেকে ফিরতে পারতেন, তবে বাংলা সাহিত্য নন্দিত নরকের চেয়েও হাজারগুণ জনপ্রিয় একটি উপন্যাস পেতে পারত। বিয়েপাগলা বুড়ো যারা সংসার তছনছ করে নিজের মেয়ে বা নাতির বান্ধবীকে বিয়ে করতে চান, তাদের জন্যে সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ লেখা হয়ে থাকত।

জনমনে তখন যে প্রশ্নটি দেখা দিয়েছিল, তাকে শাওনের মা ও দস্যুরানির এমপি তহুরা আলী ক্ষমতার জোরে মাটিচাপা দিয়েছেন। আর সেই মা যদি হন মাফিয়া রানির এমপি, তাহলে তো কথাই নেই।

প্রিয় পাঠক, শুধু বিনোদনের জন্য এখানে এই প্রসঙ্গটি টানিনি। অপরাধী যত বড় কৌশল প্রয়োগ করুক না কেন, অভিযোগের একটা সুষ্ঠু ও নির্ভরযোগ্য তদন্ত হওয়া দরকার। আইনের শাসন ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্যে এটা জরুরি। হুমায়ূন আহমেদের সফল সার্জারির পর নেহায়েত বডিলি ইনজুরির মাধ্যমে এই মৃত্যু নেহায়েত গাফিলতি। সন্ধ্যার সময় পার্টিতে তিনি চেয়ার থেকে পড়ে গেলে কেন তাকে রাতেই হাসপাতালে নেওয়া হলো না, কেন পরের দিন বেলা বাড়ার পর নেওয়া হলো—এ প্রশ্নগুলো এতদিন তহুরা আলীরা করতে না দিলেও এখন তা করার সুযোগ এসেছে।

হুমায়ূন আহমেদ কোনো ব্যক্তি বা পরিবারের সম্পদ নন, তিনি জাতির সম্পদ। তিনি তার স্বাভাবিক জীবনকাল অতিবাহিত করতে পারলে বাংলা সাহিত্যকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারতেন। আশা করব, বর্তমান সরকার এই ঘটনাটির যথাযথ তদন্ত করবে এবং বিশ্বাসযোগ্যভাবে মানুষের মনের এই প্রশ্নগুলোর জবাব পেতে সহায়তা করবে!

যে পাগল ভক্তকুল হুমায়ূন আহমেদের নাটকের এক চরিত্রের ফাঁসির বিরুদ্ধে মিছিল করেছিলেন, সেই ভক্তকুলের কেউ তার মৃত্যুরহস্য উদ্‌ঘাটনের দাবি নিয়ে তেমন কিছুই করেননি। দেশের লেখক-কবিকুলের অতি স্পর্শকাতর হৃদয়ে কিংবা বিশাল বুদ্ধিজীবীকুলের বিশাল মগজে এই প্রশ্নগুলো ওঠেনি। চট্টগ্রাম থেকে এক ভক্ত মামলা করেছিলেন। সেই মামলাও পরে তুলে নিয়েছেন। কী কারণে তিনি মামলা তুলেছিলেন, সেই কারণটিও জাতিকে জানানো দরকার।

লেখকের আপন ছোট ভাই হীরক রানির যন্তরমন্তর ঘরের প্রধান বিজ্ঞানী জাফর ইকবাল । সহোদরের এই নিদানকালে তিনিও কোনো কাজে লাগলেন না! তিনি অনেক অনেক জটিল মনস্তাত্ত্বিক বিষয় নিয়ে গবেষণা করেন, কিন্তু মৃত্যুশয্যায় ভাইয়ের মনে কোন কষ্টটি জমা হয়েছিল, তা জানার চেষ্টা করেননি।

প্রিয় ছাত্রলীগের হাতে সস্ত্রীক পিটুনি খেয়ে মনের কষ্টে তিনি বৃষ্টিতে ভিজেছিলেন। ভাইয়ের এই অপমৃত্যু নিয়ে মনের কষ্টে তিনি এক দিনও বৃষ্টিতে ভেজেননি। বরং তার সমর্থন শাওন আর তহুরা আলীর দিকে গেছে। হুমায়ূন আহমেদের প্রতি জাফর ইকবালেরও বোধহয় একটা ক্ষোভ ছিল। কারণ ১৯৭১ সালে জাফর ইকবালের গর্তবাসের কাহিনি হুমায়ূন আহমেদ জাতির গোচরে এনেছেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অনুজের এই মাত্রাতিরিক্ত চেতনা দেখে অগ্রজ হুমায়ূন আহমেদও বোধ হয় আর ঠিক থাকতে পারেননি। তাই আলগোছে জাতিকে এই গল্পটি জানিয়ে গেছেন।

রাষ্ট্র ও সমাজজীবনে বড় বড় কথার নমুনা

আসলে এই বড় বড় কথা বা চাপাবাজির মাধ্যমেই আমাদের ইতিহাসের পদযাত্রা শুরু হয়েছে। সারা জাতিকে ‘যার হাতে যা কিছু আছে, তা-ই নিয়ে শত্রুকে মোকাবিলা’ করার নির্দেশ দিলেন যিনি, দেখা গেল সময়মতো তিনি সবার আগে সুটকেস গুছিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেলেন। যাওয়ার আগে নিজের পরিবারের জন্যে মাসিক এক হাজার ৫০০ টাকার ভাতার সুবন্দোবস্ত করে গেলেন।

পাকিস্তান আমলের সেই এক হাজার ৫০০ টাকা এখনকার সময়ের তিন লাখের সমতুল্য। নিজের পোয়াতি কন্যা পাকিস্তানিদের সেবাযত্নে হাজার ওয়াট বালবের নিচে সিএমএইচে সন্তান প্রসব করলেন, কোনো গেরিলা ক্যাম্পের ঘুটঘুটে অন্ধকার গর্তে সেদিন নবজাতকের জন্ম দেননি । ‘আমার ডাইনে চোর, বামে চোর’ এই কিছিমের কথা বলে চমক দেখালেও একজন চোরকেও তিনি পাকড়াও করেননি।

সেই বাপের বেটিও কম নন। সারাক্ষণ বলে গেলেন, ‘হাসিনা পালায় না, হাসিনা পালায় না।’ কিন্তু সেই হাসিনাই শুধু বোনকে বগলদাবা করে হেলিকপ্টারে চড়লেন। দেশের লাখ লাখ নেতাকর্মীর কথা একটুও ভাবলেন না। নিজের জ্ঞাতি-গোষ্ঠীকে জানালেন আসল খবর, তাই শেখের গোষ্ঠী সবাই নিরাপদে পগার পার হতে পেরেছেন। কিন্তু নেতাকর্মীদের জানালেন অন্য কথা।

এখন ইন্ডিয়ার কোলে বসে দেশটিকে অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা করছেন। এতে দেশের ভেতরে থাকা নেতাকর্মীরা বিপদে পড়লেও তার নিজের বা জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর তো আর কিছু হবে না!

ডুয়িং নাথিং লেথারিজমে আক্রান্ত ছয় মাসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার

বর্তমান সরকারে যারা বসেছেন, তারা যে একটি আপৎকালীন সরকারের অংশ, সেটা তাদের কাজকর্মে বা আচরণে বোঝা কঠিন। এই সরকার তার প্রাইওরিটি নির্ধারণে মারাত্মক ভুল করে যাচ্ছে। সরকারের উপদেষ্টারা ক্ষমতার হাওয়া লাগিয়ে নানা জায়গায় ঘুরছেন-ফিরছেন। মন্ত্রণালয়গুলো ১৮০ দিনের মধ্যে চোখে পড়ার মতো ১৮টি কাজও করেনি। দিনের মধ্যে আট ঘণ্টা, সপ্তাহে পাঁচ দিন—এরা আসলেই কী করেন? এদের Man-hour গুলো কীভাবে ব্যয় করা হচ্ছে?

দেশের কষ্টের কথা বললেও নিজের কষ্টের কথা কম লিখি। এ কারণে নিজের স্ত্রীর পক্ষ থেকেও নির্মম সমালোচনা শুরু হয়ে গেছে। আমার ‘হ্যাডম’ নিয়ে প্রশ্ন শুরু করেছেন। কারণ তার পরলোকগত বাপের একটা ফার্ম গত ১৫ বছর এক ভূমিদস্যু গায়ের জোরে দখল করে রেখেছে। জমিটার সব ডকুমেন্টস আমার শাশুড়ির হাতে রয়েছে। আমার বিধবা শাশুড়ি ওই ভূমিদস্যুর বিরুদ্ধে মামলা করেছেন।

সেই মামলা গত ১৫ বছর ধরে সাগর-রুনির মামলার ভাগ্য বরণ করেছে। বারবার মামলার তারিখ বদলাচ্ছে, কিন্তু এখনো রায় দিচ্ছে না। এতদিন বউকে বলেছি, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুকূলে নয়, একটু অপেক্ষা কর। এরপর পরিস্থিতি অনুকূলে আসার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করলাম। প্রত্যাশিত উদ্ধারকারীদের মধ্যে একজন ঊর্ধ্বতন আইনি কর্মকর্তাও রয়েছেন। তার কাছে গিয়েছি আমাদের এক কমন বন্ধুর মাধ্যমে। আগস্টের পরিবর্তনের পর তিনি এই আসনে সমাসীন হয়েছেন।

কিন্তু সার্বিক আচরণ দেখে প্রতীয়মান হলো যে, আমরা নানা চেয়ারে শুধু তাদের সম্রাট শাহজাহানকে সরিয়ে আমাদের জনকে বসিয়েছি। আমরা হয়তোবা উপদেষ্টা বদলিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই নতুন মন্ত্রী নিয়ে আসব, কিন্তু প্রতিটা অফিসের এই সম্রাট শাহজাহানদের খাসলত কীভাবে পরিবর্তন করব?

একটা আদালতে ১৫ বছর ধরে শুধু একটার পর একটা তারিখ পড়েছে, কোনো রায় হচ্ছে না। যারা এখানে বিচারক বা জাজ হিসেবে বসেছেন, তারা সবাই দেশের অত্যন্ত মেধাবী সন্তান। কিন্তু তাদের মনে কি এটা একবারও ধাক্কা দেয় না? তাদের বিবেক সম্পূর্ণ মরে গেছে। আমরা শুধু পলিটিশিয়ানদের সংস্কার করতে চাই। কিন্তু এই আমলা, এই বিচারক, এই প্রশাসক এদের মন, মনন ও বিবেকের সংস্কার কারা করবে? কীভাবে করবে?

‘ডুয়িং নাথিং’ করেই তারা নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শন করে। যে যত ‘ডুয়িং নাথিং’ করবে, সে তত ক্ষমতাবান! অথচ এই অপদার্থরা এতে লজ্জিত হন না, বরং এক ধরনের গর্ব ও তৃপ্তি অনুভব করেন। কেউ কেউ ধর্মকর্মও করেন। কিন্তু বোধে নেন না যে, মানুষের (বান্দার) এই হক নষ্ট করার দায় থেকে আল্লাহও ক্ষমা করবেন না। তখন নামাজ-কালাম সব অর্থহীন হয়ে পড়বে।

এক বড় ভাইয়ের ব্যবসায়িক অফিসে অন্য এক জেলা জজের সঙ্গে মোলাকাত হলো। কথাবার্তায় খুবই দয়ার্দ্র মনে হল। তাকেও এই দুর্দশার কাহিনি বললাম এবং কিছু করা যায় কি না, সেজন্য অনুরোধ করলাম। সেই জজ সাহেব প্রতিদিন সকালে সুন্দর সুন্দর বাণীসহ শুভ সকাল জানালেও আসল ব্যাপারে একটা কথাও বলেন না।

কাজেই আমাদের সমস্যা কি শুধুই রাজনৈতিক?

এক সম্রাট শাহজাহানের জায়গায় অন্য সম্রাট শাহজাহান বসবেন। এক নবাব সিরাজুদ্দৌলার পরিবর্তে অন্য নবাব সিরাজুদ্দৌলা বসবেন। তাতে জনগণের ভাগ্যের কতটুকু পরিবর্তন হবে? আমাদের মতো পরিচিত মুখের সঙ্গে এই আচরণ হলে সাধারণ জনগণের সঙ্গে কী হচ্ছে? আমরা কীভাবে জনগণকে এই জাহান্নাম থেকে উদ্ধার করব? কারা উদ্ধার করবে?

সাহিত্য ও সংস্কৃতি জগতের উপন্যাস, সিনেমা ও নাটকের মাধ্যমে এসব সম্রাট শাহজাহান কিংবা নবাব সিরাজুদ্দৌলাকে আক্রমণ না করে গত ৫০ বছর দাঁড়ি-টুপিওয়ালা রাজাকারদের পেছনে লেগে রয়েছে। এ-সংক্রান্ত সব মগজ আমরা এ কাজে খরচ করেছি।

মানুষ কেন হতাশ হয়ে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়, আশা করি আপনারা আমার এই ট্রাজিক ঘটনার মাধ্যমে উপলব্ধি করতে পারবেন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন যদি শক্তি প্রয়োগ করে এই দখলটি নেই, তখন নিজের প্রাপ্য ফেরত পাওয়ার জন্য দখলবাজ হিসেবে চিহ্নিত হতে হবে।

এই সরকার পড়ে গেলে আমাদের বিপদ হবে, কিন্তু বর্তমান কিছিমে টিকে থাকলে প্রতি পদে আপদ বাড়বে। এসব বিবেচনায় তাড়াতাড়ি প্রয়োজনীয় সংস্কার সেরে রাজনৈতিক দলগুলোর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করুন—এ কথা বললে বিপদ আর আপদ একসঙ্গে আপতিত হয়! তখন বলা হয়, ‘একদল খাইছে, এখন অন্য দল খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।’

এখন যাবেন কোথায় ?

পেছন থেকে কেউ এসে বলবে, ‘একদম চুপ! এটাও বলা যাবে না।’