যে কারণে বিপ্লব ব্যর্থ হতে পারে
অলিউল্লাহ নোমান
আগষ্টের ৫ তারিখে মানুষ নতুন এক বাংলাদেশ পেয়েছে। ফ্যাসিবাদ পরাজিত হয়েছে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে। এই বিজয়কে দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলেও মনে করা হয় এখন। তবে এই অর্জনের পেছনে রয়েছে গত ১৭ বছর ধরে রাজনৈতিক দল গুলোর লড়াই। রাজনৈতিক দল গুলো কখনো জোটবদ্ধভাবে, আবার কখনো যুগপদ আন্দোলন করেছে। কিন্তু বিপ্লবের চুড়ান্ত বিজয় এসেছে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রী ও সজনতার ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ে। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে সব দল ও মতের ছাত্ররা এক সামিয়ানার নিচে এসে লড়াই করেছে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন সাধারণ জনতা। ছাত্র জনতার এই মহামিলন দেখে ফ্যাসিবাদের সাজানো সেনাবাহিনী ও পুলিশ অনেকটা পিছু হটতে বাধ্য হয়। যদিও ততদিনে অনেক প্রাণ কেড়ে নিয়েছে পুলিশের গুলিতে। শেষ পর্যন্ত সেনাবাহিনী গুলি চালাতে অপরাগতা প্রকাশের পরই আন্দোলন চুড়ান্ত বিজয়ের দিকে এগিয়ে গেছে। নতুবা আরো রক্ত হয়ত ঝড়তো রাজপথে। তারপরও কম রক্ত ঝড়েনি। শহীদদের তালিকা হলে দেখা যাবে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যাই বেশি।
এইসব শহীদের রক্তের দাগ এখনো মুছেনি। অনেক শহীদ গণকবরে শূয়ে আছেন গাদাগাদি করে। অনেক শহীদের নাম পরিচয় এখনো পাওয়া যায়নি। সবার নাম ঠিকানা পাওয়া গেলে এই তালিকা অনেক দীর্ঘ হবে। হাজারো আহত ছাত্র-ছাত্রী এখনো হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছেন। অনেকে পুঙ্গু হয়ে গেছেন আজীবনের জন্য। অনেকে চোখ হারিয়ে অন্ধ হয়ে গেছেন।
এই ত্যাগ ও রক্তের পথ মারিয়ে অর্জিত বিপ্লবকে ব্যর্থ করে দিতে ফ্যাসিবাদের ক্রিড়নকরা কিন্তু সক্রিয় রয়েছেন। এটাই স্বাভাবিক। তারা চাইবে বিপ্লব যেন ব্যর্থ হয়। ফ্যাসিবাদের সাজানো প্রশাসন, বিচার বিভাগে বসানো দলদাস এখনো নিজ নিজ আসনে রয়েছেন। মিডিয়ায় ফ্যাসিবাদের সহযোগি গুম, খুনে উস্কানিদাতারা এখনো নিজ নিজ জায়গায় বহাল তবিয়তে।
বিচার বিভাগের কথাই ধরা যাক। আপিল বিভাগ থেকে ফ্যাসিবাদের সহযোগি ও জুডিয়াল খুনিদের তাড়ানো হয়েছে। কিন্তু এখনো তাদের বিচারের আওতায় আনার উদ্যোগ লক্ষ করছি না।
হাইকোর্ট বিভাগে ফ্যাসিবাদের দালালরা রয়ে গেছেন। বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী ক্যাডারদেরই প্রাধান্য দিতো ফ্যাসিবাদ। এরমধ্যে অনেকে ঘুষ দিয়েও বিচারক হয়েছেন তখন। ফজলে নুর তাপসের কোটায় যারা বিচারক হয়েছেন সকলেই মোটা অঙ্কের টাকা দিয়েছেন। ঘুষ দিয়ে যারা বিচারক হয়েছেন তাদের নৈতিকতা হচ্ছে সর্বনিম্নমানের।
হাইকোর্ট বিভাগের বর্তমানে ৫৭জন রয়েছেন শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদের সরাসরি দালাল। এরমধ্যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি খিজির হায়াত, জাসদ ছাত্রলীগের নেতা ও রাজশাহি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিপক্ষ সংগঠনের ছাত্রনেতাকে খুনের মামলায় প্রধান আসামী রুহুল কুদ্দুস, ২০০৬ সালের ৩০ নভেম্বর সুপ্রিমকোর্টে নজিরবিহীন তাণ্ডবে নেতৃত্ব দিয়ে ভাংচুরে অংশগ্রহনকারী সন্ত্রাসী খসরুজ্জামান, ফ্যাসিবাদের স্পীকার ফজলে রাব্বির মেয়ের জামাই খুশিসহ অনেক চিহ্নিত আওয়ামী ক্যাডার রয়েছেন।
শোনা যাচ্ছে, সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে তাদের বহাল তবিয়তে রাখতে একদল আইনজীবী নেতা সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। এজন্য মোটা অঙ্কের টাকা লেন-দেনের কথাও বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। টাকা লেনদেনের বিষয়টি সঠিক নয় বলে যদি ধরেও নেই, তারপরও সন্দেহ থেকে যাবে। কারণ, এইসব বিচারকদের সরানোর জন্য সুপ্রিমকোর্ট বার থেকে যথাযথ কোন উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। বরং সুপ্রিমকোর্ট বারকে দেখা যাচ্ছে এসব বিচারকের কাছে বিচার চাইতে যাচ্ছেন।
কেন তাদের সরাতে হবে, এমন প্রশ্ন আসতে পারে। এখানে একটি উদাহরণই যথেষ্ট। ২০০১ সালে বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছিল চার দলীয় জোট। এটাকে বলা হত ভোট বিপ্লব। ভোট বিপ্লবের পর মানুষের প্রত্যাশা পুরণে ব্যর্থ হয়েছিল এই জোট সরকার। রাষ্ট্র সংস্কারে কোন উদ্যোগ এগিয়ে নেওয়া হয়নি। ক্ষমতায় আসার পরপর অনেক গুলো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। ন্যায়পাল আইন কার্যকর করা, স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালি করা, পুলিশে রিফর্ম করা এবং কাউন্টার ইন্টিলিজেন্স গঠন করে পুলিশের কাজে চেক অ্যাণ্ড ব্যালেন্স আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এ উদ্যোগ গুলো অনেক দূর এগিয়ে যাওয়ার পর অদৃশ্য কারণে থেমে যায়। মোটকথা কোন ভাল উদ্যোগ তখন আর সামনে আগাতে দেয়নি একটি চক্র। এতে বিপুল ভোট বিপ্লবের সরকার রুটিন কাজ ছাড়া রিফর্মে কোন রকমের সফলতা দেখাতে পারেনি। এই সুযোগ নিয়েই শেখ হাসিনা ধ্বংসাত্মক আন্দোলন শুরু করে। ফলে ১/১১-এর সরকার জরুরী আইনের সরকার ক্ষমতায় আসে।
চার দলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিচার বিভাগে আওয়ামী লীগের রেখে যাওয়া বিচারকদের সরাতে ব্যর্থ হয়েছিল। মোট কথা বিচার বিভাগ সংস্কারের কোন পদক্ষেপই ছিল না। এই সুযোগ নিয়েই আওয়ামী ক্যাডার বিচারক খায়রুল হক হাইকোর্ট বিভাগে একটি রায় দিলেন। মুন সিনেমা হল রাষ্ট্রীয় মালিকানা থেকে ফিরিয়ে নিতে আবেদন করেছিলেন মূল মালিক। এই মামলাটি যখন হাইকোর্ট বিভাগে নিয়ে যাওয়া হয়, খায়রুল হক ওপেন কোর্টে পরামর্শ দিলেন সামরিক ফরমান চ্যালেঞ্জ করার জন্য। বাদী পক্ষ খায়রুল হকের পরামর্শ অনুযায়ী সামরিক ফরমান চ্যালেঞ্জ করলেন। কারণ, সামরিক ফরমানেই মূল সিনেমা হল রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নেওয়া হয়েছিল। খায়রুল একটি অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এই পরামর্শ দিয়েছিলেন বাদী পক্ষকে। রাষ্ট্রীয় ফরমান চ্যালেঞ্জ করে রীট আবেদন করার পর খায়রুল হক সরকারের প্রতি রুল দিলেন। এই রুল দেওয়ার কিছুদিন পর তাঁকে বেঞ্চ পরিবর্তন হয়েছিল স্বাভাবিক নিয়মে। এতে মামলাটি আর তার বেঞ্চে শুনানীর সুযোগ ছিল না।
খায়রুল হক প্রধান বিচারপতি সৈয়দ জে আর মোদাচ্ছির হোসেনের কাছে একটি নিবেদন করলেন। বললেন, এই মামলাটিতে তিনি রুল জারি করেছিলেন। মামলাটির চুড়ান্ত শুনানী তিনি গ্রহন করে রায় দিতে চান। তাঁর আবেদন অনুযায়ী রুল ইস্যুকারী খায়রুল হক ও এটিএম ফজলে কবীরকে শুধু এই মামলা শুনানীর জন্য বিশেষ বেঞ্চ বসার সুযোগ করে দিলেন। কেন খায়রুল হক বিশেষ আগ্রহ নিয়ে শুধু এই মামলাটি শুনানীর জন্য নিবেদন করছেন তখনো উদ্দেশ্য বুঝতে ব্যর্থ। রুলের শুনানীতে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ফিদা এম কামাল ছিলেন রাষ্ট্র পক্ষে। তিনিও ছিলেন মূলত জিয়াউর রহমানে শাসনামলের বিপক্ষের লোক। তাই যা হওয়ার তা-ই হয়েছিল। ৫ম সংশোধনী বাতিল করে রায় দিলেন খায়রুল হক। কারণ, জিয়াউ রহমানের সময়ে সামরিক ফরমানে যা কিছু করা হয়েছিল সব-ই অনুমোদন হয়েছিল ৫ম সংশোধনীর আওতায়। এছাড়া তিনি জিয়াউর রহমানের পুরো শাসনকে অবৈধ ঘোষণা করলেন। চার দলীয় জোট সরকারের সময়ে খায়রুল হক এই কাজটি করেছিলেন হাইকোর্ট বিভাগে থাকতে পারার সুযোগ নিয়ে।
এখনো হাইকোর্ট বিভাগে অনেক খায়রুল হক রয়েছেন। যারা মনেপ্রাণে ফ্যাসিবাদকে লালন করেন। কিছু আইনজীবী নেতা টাকার বিনিময়ে তাদের স্বপদে বহাল রাখলে তারাও খায়রুল হকের মত সুযোগ নিবেন। সুতরাং বিপ্লবকে সঠিক পথে এগিয়ে নিতে হলে ফ্যাসিবাদের নিয়োগ দেওয়া ৫৭জনকে এখনই পদত্যাগ করাতে হবে। যেভাবে আপিল বিভাগের ৫জনকে পদত্যাগ করানো হয়েছে, একই কায়দায় ৫৭ জনকেও পদত্যাগ করানো সময়ের দাবী। নতুবা আখেরে মাশুল গুণতে হবে গোটা দেশ ও জাতিকে। অতীতের ভুলভ্রান্তির কারণে গত ১৭ বছর দেশের মানুষ নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। এই ভুলভ্রান্তি গোটা দেশের মানুষের ছিল না। এই ভুলভ্রান্তি ছিল যারা ক্ষমতায় ছিলেন এবং তখন যারা নীতি নির্ধারক ছিলেন তাদের। আবারো যদি একই ভুলের পুনরাবৃত্তি হয়, জাতি ক্ষমতা করবে না। ইতিহাসের কাটগড়ায় দাড়াতেই হবে।
বিচার বিভাগের মত একই ঘটনা মিডিয়ায়। ফ্যাসিবাদ নিজের প্রচারণার জন্য অনেক গুলো মিডিয়া খুলেছিল। তারা শেষদিন পর্যন্ত শেখ হাসিনার পক্ষে সাফাই গাওয়ার অপচেষ্টা চালিয়েছিল। গুম এবং খুনের উস্কানিদাতা হচ্ছে এইসব ফ্যাসিবাদি মিডিয়া। এমনকি একপাল মিডিয়ার সাংবাদিক ও সম্পাদক শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাৎ করে ১৫ জুলাই থেকে ঘটে যাওয়া খুনের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। আরো খুন করলে তারা যে কোন প্রয়োজনে শেখ হাসিনার সাথে আছেন বলে ওয়াদা করেছিলেন। খুনের উস্কানিদাতা এসব সাংবাদিক ও সম্পাদককে প্রতিটি মামলায় শেখ হাসিনার সঙ্গে সহযোগি আসামী করা আইনের দাবী। তারা স্বঘোষিতভাবে শেখ হাসিনার সহযোগি। দণ্ডবিধির ৩৪ ধারায় বলা আছে ঘটনায় উপস্থিতির প্রয়োজন নেই। খুনের বা অপরাধের সমর্থক হিসাবে থাকলে সেটাকে কমন ইনটেশন হিসাবে বিবেচনা করা হয়। শেখ হাসিনা এবং গুম-খুনের উস্কানিদাতা এসব সাংবাদিক ও সম্পাদকদের কমন ইনটেশন ছিল। এই কমন ইনটেনশনের আওতায় তারা সমান অপরাধি।
অথচ, দেখা যাছে প্রতিটি মিডিয়া থেকে প্রতিকী দু/একজনকে সরিয়ে দিয়ে সব সেটআপ বহাল রাখা হচ্ছে। মিডিয়ার মালিক যারা শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদের জয়গান করেছেন, খুনের উস্কানি দিয়েছে সেই মিডিয়ার মালিকরাও অপরাধী। সুতরাং একই মালিক ও সাংবাদিক কর্মচারি রেখে কখনো ভাল কিছু আশা করা উচিত নয়। বরং বোকামী। তারা সুযোগের সন্ধানে থাকবে। যে কোন সময় পাল্টা আঘাত এনে বিপ্লবকে নস্যাৎ করে দেওয়ার জন্য অপতৎপর হয়ে উঠবে।
মিডিয়া গুলোতে দেখা যাচ্ছে, বিএনপি বিটের সাংবাদিকদের সামনে এনে উপরের সীটে বসানো হচ্ছে। উদ্দেশ্য বাকীদের আড়াল করা। কিন্তু মালিক আগেরই। অন্যান্য আওয়ামী ক্যাডাররাও সাংবাদিকতার লেবাসে বহাল তবিয়তে।
বিপ্লবের ফসল জাতির কাছে পৌছাতে হলে বিচার বিভাগ ও মিডিয়ায় অবিলম্বে সংস্কার আনতে হবে।
হাইকোর্ট বিভাগে ফ্যাসিবাদের নিয়োগ দেওয়া সকল বিচারককে অপসারণ করতে হবে। যারা এদের রক্ষায় মাঠে নেমেছেন তাদেরকে চিহ্নিত করে গণশত্রু হিসাবে ঘোষণা করতে হবে।
মিডিয়ার মালিক ও যারা শেখ হাসিনাকে গুম-খুনে উস্কানি দিয়ে সঙ্গে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তাদের তালিকা রয়েছে। এইসব মিডিয়ার মালিক ও শেখ হাসিনার সাথে দেখা করে সঙ্গে থাকার প্রতিশ্রুতি দেওয়া প্রত্যেককে সহযোগি আসামী করতে হবে। তারা স্বঘোষিতভাবে ফ্যাসিবাদের ঘুম-খুনের সহযোগি।
এই দু’টি কাজ অবিলম্বে না করতে পারলে বিপ্লব যে কোন সময় বুমেরাং হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাবে। শহীদদের রক্তের মর্যাদা দিতে বিপ্লবকে সফলতার চুড়ান্ত পর্যায়ে নিতে সংস্কার করতে হবে এখনই।
লেখক: যুক্তরাজ্যে নির্বাসিত সাংবাদিক