মুহাম্মাদ সাইদুল ইসলাম
অনেক আগে বাংলাদেশের ধ্বংসাত্মক রাজনৈতিক সংস্কৃতি নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে লিখেছিলাম। সেখানে প্রথম যে ধারা আমি আলোচনা করেছিলাম সেটা ছিলো টোটেম সংস্কৃতি। এর অর্থ হলো, কোন প্রভাবশালী মৃত ব্যক্তিকে টোটেম বা "পুজার আসনে" বসানো, এবং তাকে ঘিরেই সকল রাজনৈতিক, সামাজিক, এবং সাংস্কৃতিক কার্যক্রম নির্ধারণ করা।
সমাজবিজ্ঞানের জনক ইমিল ডুরখেইম অষ্ট্রেলিয়ার অরুন্টাস সম্প্রদায়ের উপর গবেষণা করতে গিয়ে এই টোটেম সংস্কৃতি খুঁজে পান।
এই টোটেমকে কেন্দ্র করেই নির্ধারণ করা হয় সমাজের পবিত্র বা করণীয় (sacred) এবং অপবিত্র বা বর্জনীয় (profane) বিষয়াদি। বিকশিত টোটেম সংস্কৃতি নিজেই এক সময় এক ধরনের ধর্মের রূপ পরিগ্রহ করে এবং অন্যান্য ধর্মীয় চর্চাকে এই টোটেমের অধীনস্থ করে ফেলে। যেমন, মুসলিম হিসাবে আপনি হয়তো ইব্রাহীম (আ:) কে জাতির পিতা হিসাবে ভাববেন, কিন্তু বাংলাদেশের টোটেম সংস্কৃতি আপনাকে জোর করে শেখ মুজিবকেই জাতির পিতা হিসাবে গিলাবে।
গত পনের বছর ধরে শেখ হাসিনা তার মৃত পিতাকে টোটেম হিসাবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার সকল ব্যবস্থা করেছেন, খরচ করেছেন জনগণের ট্যাক্সের হাজার হাজার কোটি টাকা, আদালত থেকে বাগিয়েছেন "জাতির পিতা" হিসাবে রায়, আইন করেছেন তাকে সমালোচনার উর্ধ্বে রাখার। এসব করতে গিয়ে তিনি দানব ফ্যাসিস্ট বনে গেছেন। মুজিবায়ন এবং টোটেম সংস্কৃতিকে সর্বত্র দৃশ্যমান করতে শিল্পকলার নাম দিয়ে সারা দেশে স্থাপন করেছেন মুজিবের শত শত মুর্তি, প্রতিষ্ঠা করেছেন মুজিব কর্ণার, বানিয়েছেন হাজার হাজার মুর্যাল। তিনি মুজিব নামের বন্যা বইয়ে দিয়েছেন শত শত স্থাপনায়! কিছু উদাহরণ নীচে দেয়া হলো:
১. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
২. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ,ফরিদপুর
৩. বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ, সুনামগঞ্জ
৪. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর
৫. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়,গোপালগঞ্জ
৬. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পিরোজপুর
৭. বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়,কিশোরগঞ্জ
৮. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়
৯. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এভিয়েশন ও এরোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয়,লালমনিরহাট
১০. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়,গাজীপুর
১১. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নারায়নগঞ্জ (প্রস্তাবিত)
১২. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান নভোথিয়েটার, ঢাকা
১৩. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান নভোথিয়েটার, রাজশাহী (নির্মানাধীন)
১৪. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর নভোথিয়েটার, খুলনা (অনুমোদিত)
১৫. বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার, রংপুর ( প্রস্তাবিত)
১৬. বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার, বরিশাল (প্রস্তাবিত)
১৭. বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার, সিলেট (প্রস্তাবিত)
১৮. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক, গাজিপুর
১৯. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক, ডুলহাজরা
২০. বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘর, ঢাকা
২১. বঙ্গবন্ধু সেনানিবাস,টাঙ্গাইল
২২. বানৌজা বঙ্গবন্ধু,ক্ষেপণাস্ত্র ফ্রিগেট
২৩. বঙ্গবন্ধু সেতু
২৪. বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম,ঢাকা
২৫. বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র,ঢাকা
২৬. বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটি,গাজীপুর
২৭. বঙ্গবন্ধু দ্বীপ
২৮. বঙ্গবন্ধু এরোন্যাটিক্যাল সেন্টার, কুর্মিটোলা
২৯. বঙ্গবন্ধু ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট, খুলনা
৩০. বঙ্গবন্ধু উপগ্রহ
৩১. বঙ্গবন্ধু স্কয়ার, ফরিদপুর
৩২. বঙ্গবন্ধু উদ্যান, বরিশাল
৩৩. বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ-চীন প্রদর্শনী কেন্দ্র, পূর্বাচল
৩৪. বঙ্গবন্ধু টাওয়ার, ঢাকা
৩৫. বঙ্গবন্ধু টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, টাঙ্গাইল জেলা
৩৬. জতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারি কলেজ, ঢাকা
৩৭. জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কলেজ, গাজীপুর জেলা
৩৮. ফরিদগঞ্জ বঙ্গবন্ধু সরকারি কলেজ, ফরিদগঞ্জ উপজেলা, চাঁদপুর জেলা
৩৯. বঙ্গবন্ধু কলেজ, কুমিল্লা জেলা
৪০. বঙ্গবন্ধু কলেজ, খুলনা
৪১. বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্ক, (রাজশাহী,সিলেট)
৪২. বঙ্গবন্ধু কলেজ, ঢাকা
৪৩. বঙ্গবন্ধু মহিলা কলেজ, কলারোয়া
৪৪. বঙ্গবন্ধু ডিগ্রী কলেজ, রাজশাহী জেলা
৪৫. শিমুলবাড়ী বঙ্গবন্ধু ডিগ্রি কলেজ, নীলফামারী জেলা
৪৬. সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজ, গোপালগঞ্জ, বাংলাদেশ
৪৭. সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজ, জামালপুর
৪৮. বঙ্গবন্ধু ল কলেজ, মাদারীপুর জেলা
৪৯. সরকারি শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, টুঙ্গিপাড়া, গোপালগঞ্জ
৫০. বঙ্গবন্ধু ডিজিটাল লাইব্রেরি, পটুয়াখালি
টাকায় মুজিবের ছবি, গায়ে মুজিব কোর্ট, শ্লোগানে "আমরা সবাই মুজিব সেনা, ভয় করিনা বুলেট বোমা" কিংবা "এক মুজিব লোকান্তরে, লক্ষ মুজিব ঘরে ঘরে", বক্তৃতায় মুজিবের প্রশংসার ফুলঝুরি, ইতিহাসে "হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি", সিনেমায় " Mujib: The Making of a Nation", গানে "তুমি বাংলার ধ্রুবতারা", আকাশে মুজিব স্যাটেলাইট, বাতাসে মুজিবের ৭ই মার্চের ভাষণ, বাইরে তাকালেই মুজিবের মুর্তি, কোন অফিসে গেলেই মুজিব কর্ণার, বিমান থেকে এয়ারপোর্টে নামলেই " মুজিব ল্যান্ড"...সব জায়গায় কেবল মুজিব আর মুজিব। মুজিবায়ন থেকে আর কোন কিছুই বাদ নেই।
এই টোটেম সংস্কৃতি এখন হাজার মানুষের ডিএনএ'তে ঢুকে গেছে। তাদের চিন্তার সবটুকু জুড়ে এই টোটেম। টোটেমের জন্য অনেকে জীবনপন করতে প্রস্তুত। টোটেমের সম্মান রক্ষার্থে অনেকে আবার দানব হয়ে টোটেম বিরোধীদের খুন, জখম, লুন্ঠন, গুম করে ফেলে; অনেকে হয়ে ওঠে চরম ফ্যাসিস্ট। তখন এই টোটেমের বাইরে তারা চিন্তা করতে পারে না। লজিক্যাল থিংকিং তখন পরিবর্তিত হয়ে একরোখা যুক্তিবুদ্ধিহীন মাতালে পরিণত হয়। চক্ষু থেকেও তারা অন্ধ হয়ে পড়ে, কারণ তারা নিজেদের অসারতা দেখার ক্ষমতা হারায়। নিজেদের খুন, গুম, দুর্নীতিকে সমালোচনার পরিবর্তে সেগুলো জাস্টিফাই করে আরো মহাউৎসবে চালিয়ে যেতে থাকে। ধর্ষণের মতো মহাপাপকে তারা গ্লোরিফাই করে "ধর্ষণের সেঞ্চুরি" উৎসব পালন করে। চরম মিথ্যাচারকে তারা ধ্রুবসত্যের মতো প্রচার চালিয়ে যেতে থাকে। সমাজে এটা তখন ক্যান্সারের রূপ পরিগ্রহ করে, এবং তার ভয়াল থাবায় আক্রান্ত হয় সমাজের সকল প্রতিষ্ঠান এবং অঙ্গন। বাকি মানুষ তিক্ত বিরক্ত হয়ে নিমজ্জিত হয় চরম হতাশা, অমানিশা আর আতংকের মহাসাগরে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, "চিতকার করে কাঁদিতে চাহিয়াও করিতে পারেনা চিতকার!"
যেহেতু টোটেম সংস্কৃতি অনেকটা পৌত্তলিকতার কাছাকাছি, সেহেতু বড় পৌত্তলিকদের সাথেই তাদের বন্ধুত্ব হয় বেশি। দেশী এবং প্রতিবেশী পৌত্তলিকরাই হয় তাদের জানের জান, প্রাণের প্রাণ। এই প্রেমে অন্ধ হয়ে ক্ষমতায় গিয়ে পৌত্তলিকদেরকেই বসায় নানান পজিশন অফ পাওয়ারে। বড় পৌত্তলিক রাষ্ট্রের বশ্যতা মেনে নেয় অনায়াসে। তখন সম্পর্কটা হয়ে যায় "স্বামী-স্ত্রী"র, যেটা তারা নিজেরাই গর্ব সহকারে স্বীকার করে। বড় পৌত্তলিক দাদাদের সংস্পর্শে এলে এদের আদেলকেপনার শেষ থাকে না। ওদের খুশি করতে বিনা পয়সায় দেশের করিডর দিয়ে দেয়, স্থলবন্দর হস্তান্তর করে, ট্রাক ট্রাক ইলিশ পাঠায়, তাদের জন্য দেশের বুকচিরে রেলপথ বানায়। এমনকি এই স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কে এশকে দেওয়ানা হয়ে পুরো দেশকে বিক্রি করে দিতেও এরা কুন্ঠাবোধ করেনা।
সবচেয়ে বড় প্যারাডক্স হলো, এই মানসিকতা নিয়ে তারা নিজেদেরকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের সোল এজেন্ট মনে করে। আর নিজের বাইরের সবাইকে দেশদ্রোহী, জংগী, শিবির, রাজাকার কিংবা রাজাকারের নাতিপুতি ভাবে। এগুলো আবার বক্তৃতা, নাটক, সিনেমা, পার্লামেন্ট, আদালতসহ সব জায়গায় দেদারসে বলতে থাকে এবং জোর করে প্রতিষ্ঠা করে। কৌটা বানিয়ে অন্যদেরকে বঞ্চিত করে, এবং শুধু নিজেরাই চাকরি, প্রোমোশন এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধা বাগিয়ে নেয়। পুরো দেশ তখন "ডিভাইড অ্যান্ড রুল" এর খপ্পরে পড়ে মুখ থুবড়ে পড়ে যায়।
শুধু আলাদাকরণ (otherizing) করেই খ্যান্ত হয় না, বরং এই চাপিয়ে দেয়া নতুন পরিচয়ের সাথে যুক্ত করে দেয় নানান নেতিবাচক অর্থ এবং অপরাধের ট্যাগ। এরপর চলে চরম ঘৃণার চাষ, যা উপস্থাপন করা হয় "চেতনার" নাম দিয়ে। এ পর্যায়ে শিবির ধরা, শিবিরকে সর ধরনের অপকর্মের জন্য দায়ী করা, শিবিরকে টর্চার করা, এমনকি শিবিরকে মেরে ফেলা শুধু জায়েজ নয় বরং অনেক প্রশংসনীয় কাজ (sacred) হিসেবে টোটেম সংস্কৃতিতে স্বীকৃতি পায়। আর এই "প্রশংসনীয় কাজে" যারা লিপ্ত হয়, টোটেম সংস্কৃতি তাদেরকে চাকরি, প্রোমোশনসহ নানান পুরস্কারে ভূষিত করে। শিবির ধরা এবং মারা তখন ধীরে ধীরে এক অপ্রতিরোধ্য মার্কেট কারেন্সি হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সাধারণ ছাত্ররাও তখন "শিবির সন্দেহে" চরম নির্যাতনের শিকার হয়।
এইসব নিয়ে একটু উচ্চবাচ্য করলেই টোটেমের অনুসারীদের পক্ষ থেকে আসে দৈহিক এবং সংস্কৃতিক আঘাত। কখনো এরা টর্চার সেল গঠন করে সারারাত পেটাতে থাকে ভিন্নমতের ছাত্রদের, কখনো অন্যদেরকে নৃশংসভাবে হত্যা করে গর্বে ফুলে ফেঁপে ওঠে। "শিবির সন্দেহে" এই কাজগুলো তারা করতে থাকে দেদারসে। এই টোটেম সংস্কৃতির ছোবলে বলি হয় কখনো আবরার, কখনো আবু বকর, আবার কখনো অবুঝ শিশু!
গত পনের বছর ধরে আমরা দেখেছি এই টোটেম সংস্কৃতির জয়জয়কার, প্যারাডক্স, এবং নৃশংসতা। অবশেষে দেওয়ালে যখন একেবারেই পিঠ ঠেকে গেছে, তখন জেগে উঠেছে বাংলার দামালেরা। "অগ্নিগিরির লাভার মতো উপগিরিত" হয়ে এরা এক ধাক্কায় এই টোটেম সংস্কৃতির রাণীকে "মামুবাড়ি দিল্লি"তে পাঠিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এই ধ্বংসাত্মক সংস্কৃতির বিষাক্ত ডালপালা, শেকড়বাকড় এবং অগণিত পত্রপল্লব ছেয়ে আছে বাংলাদেশের সবখানে। সত্যকার দ্বিতীয় স্বাধীনতার জন্য এগুলোর মূলোৎপাটন একান্ত জরুরি।