স্মৃতিপাঠ : কবি মতিউর রহমান মল্লিক
[b]নাজমি নাতিয়া[/b]
‘‘....তোমার আব্বা কি করেন?’’ ক্লাশ থ্রি অথবা ফোর থেকেই বুঝতে শুরু করেছিলাম যে আমার আব্বু অত্যন্ত মেধার সাথে বড় বড় কাজ করে থাকেন। কবিতা, গান, প্রবন্ধ, সাইমুম, সংগঠন, প্রত্যাশা প্রাঙ্গণ চলে সারাদিন। আর রাতের বেলা জুম্মি আপু, মুন্না এবং আমার ঝগড়া মিটিয়ে দেয়া, মশারির দড়ি খুঁজে বের করা, জুতার র্যাকে জুতা সাজিয়ে রাখা, মধ্যরাতে কোরআনের আয়াত কিংবা কবিতার লাইনগুলো এস এস সি পরীক্ষার্থীদের মত উচ্চস্বরে আউড়ে যাওয়া, কখনও জ্বীনের ভয়ে ছিঁটকে এসে আমাদের মাঝখানে গুঁটিশুঁটি ঘুমিয়ে পড়া, তারপর সকালবেলায় তাঁর ভক্ত জ্বীনের অতিরিক্ত বাড়াবাড়ির গল্প শোনানো- সব আব্বুর কাজ।
তাই আব্বু আসলে কি করেন হুট করে এক কথায় তা কখনোই বলতে পারতাম না। কোনরকমে যদি বলে ফেলতাম যে আমার আব্বু একজন কবি তো সাথে সাথে করুনার বর্ষণে ভিজতে ভিজতে নিজেকে অভাগীদের একজন হিসেবে আবিষ্কার করে নিতে বাধ্য হতাম।যদিও আব্বুর কবি বা সংগঠক অথবা কোন প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী হওয়ার ওপর আমার ভাগ্যের তারতম্যের কোন সম্পর্কই ছিলো না তবুও ঐ মুহূর্ত গুলোয় মনে হতো, ইস! আব্বু যদি রবীন্দ্রনাথের মত বিশাল কবি হতো, আব্বুর কবিতার বইয়ের যদি লাখ লাখ কপি বিক্রি হয়ে যেত, আব্বুর যদি অনেক নাম ডাক থাকতো তাহলে প্রশ্নকারী খুব সহজেই বুঝে নিতো যে আমরা ভালো আছি, আমাদের কোন অর্থাভাব নেই, আমাদের জীবনে এক ফোঁটা করুনারও কোন প্রয়োজন নেই। খুব ইচ্ছে করতো জোর গলায় বলতে, “ মহান আল্লাহ পাকের দরবারে শুকরিয়া, আমি অনেক ভাগ্য নিয়ে জন্মেছি। কারণ আমার আব্বু হলেন মতিউর রহমান মল্লিক। তিনি কি করেন সেই প্রশ্ন অবান্তর। বরং প্রশ্ন করুন যে তিনি কি করেন না।” ছেলেমানুষী ইচ্ছা। কিন্তু আব্বুর কফিনের সামনে দাঁড়িয়ে এক প্রতিবেশীর সেই একই প্রশ্নের জবাবে যখন এই কথাগুলোই বিড়বিড় করে বলতে লাগলাম, একবারও মনে হলো না, আমি ছেলেমানুষ।
ক্লাশ সেভেনে সেবার প্যারেন্টস মিটিংয়ে আব্বুকে বক্তৃতা দিতে ডাকা হলো। আব্বু ধীর পায়ে বিনয়ের সাথে মাইকের দিকে হেঁটে যাচ্ছিলেন। আমার বান্ধবীরা ফিসফিসিয়ে উঠলো। এই যেমন একজন আদর্শ পিতার বেশ ভূষা চেহারা যেমন হওয়া দরকার তেমনটা না, এইসব আর কি ।
ওদের মন্তব্যে ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁয়ের কথা আমার ঝট করে মনে এসে গিয়েছিলো। শোনা গল্প। আমেরিকার এক সঙ্গীত জলসায় তিনি স্টেজে উঠলেন সরোদ হাতে নিয়ে। দর্শক তাঁর সাধারণ বেশভুষা, ছোটখাটো আকৃতি আর ঘোরকালো গায়ের রং দেখে হাসাহাসি করতে লাগলো।
কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি তাঁর সরোদে হাত ছোঁয়ালেন।সাথে সাথে পুরো দর্শক গ্যালারী স্তব্ধ হয়ে গেলো। মন্ত্রমুগ্ধ সবাই মোহনীয় সুরের ঈন্দ্রজালে। পরদিন ভোরের সবকটি দৈনিকের শিরোনাম হয়েছিলেন ওস্তাদ।
আব্বুর বক্তব্যের ঢং, উচ্চারণ আর একটু মাধুর্যে উদ্বেলিত অডিয়েন্স যখন প্রচন্ড করতালিতে ফেটে পড়ছিলো আমার বান্ধবীরাও তখন হাঁ করে সেই সাধারণ মানুষটাকে দেখছিলো। মনে হচ্ছিলো ওরা অপার্থিব কাউকে দেখছে। আমরা চাইতাম আব্বুকে ফুলবাবু সাজিয়ে অফিস পাঠাতে। তাতে তাঁর ছিলো ভীষন অনীহা। এই পাঞ্জাবী মোটা, ওই জুতো শক্ত আরও নানান বাহানা।
প্রতিটাদিন পায়ে সেই আবদুল কাদের মোল্লা চাচার জুতোজোড়া যা অতি ব্যবহারে জরাজীর্ন, গায়ে রংচটা কিন্তু সাইমুমের দেয়া পাঞ্জাবীটা নয়তো মিঠুন চাচীর নিজ হাতে বানানো ঘিয়ে রংয়ের ফতুয়াটা, চোখে আলমাহমুদ চাচার পছন্দ করে দেয়া ফ্রেমের চশমা আর নিতান্তই পড়তে হবে তাই আম্মুর কিনে দেয়া পা’জামা পড়ে পৃথিবীর প্রতি একবুক ভালোবাসা নিয়ে আব্বু রাস্তায় বের হতেন। কিন্তু যখনি বের হতেন দেখতাম এক দঙ্গল রিক্সাওয়ালা আব্বুকে প্যাসেঞ্জার সীটে বসানোর প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। আশপাশের সব দোকানদারের সালামের জবাব দিতে দিতে, পথচারী আর প্রতিবেশীদের খবর নিতে নিতে আমার আব্বু যখন রাজার হালে আট নম্বর গলি বেয়ে অদৃশ্য হয়ে যেতে থাকতেন আমি তখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ পাতাল ভেবেও কুলকিনারা করতে পারতাম না যে লোকজন এই অতি সাধারণ পোশাকের মানুষটাকে এত সম্মান দেখায় কেন? ওরা তো আব্বুকে কবি কিংবা গীতিকার হিসেবে চেনে না।
আব্বুর কাছ থেকে কোন স্বার্থ আদায় বা ব্রেক পাওয়ার উদ্দেশ্যও তো ওদের থাকতে পারে না। তাহলে? এতটুকু অবশ্য বুঝতাম যে এই সম্মান ছিলো নিখাঁদ। দুনিয়াবী স্বার্থ এই সম্মানকে ছুঁতে পারতো না। আব্বু শুধু সফরে যেতেন। পুরো বাংলাদেশে অথবা বাংলাদেশের বাইরে মুক্ত পাখির মত ওড়াউড়ি ছিলো আব্বুর স্বভাব। আম্মু রাগ করে বলতো ‘জাত কবি’। আমি রোমাঞ্চিত হতাম।একবার কি এক বিচিত্র কারণে আব্বু আমাকে সফরসঙ্গী বানালেন। সেবারই বোধহয় তাঁর শেষ খুলনা যাত্রা। পাইকপাড়ায় এক প্রচন্ড বর্ষণের দিনে আমরা স্কুটার থেকে নামলাম।একটু এগুতেই পুকুর।পুকুরের সবুজ পানিতে বৃষ্টির একগুঁয়ে দখলবাজীর খেলা দেখে আমি তখন মুগ্ধ।আব্বু আমার মুগ্ধতা টের পেয়ে সবাইকে সরে যেতে ইশারা করলেন। তারপর আমার কানের কাছে এসে বললেন, ‘ সাঁতার শিখবে ছোট মা?’ আমার জীবনের সবচাইতে অসাধারণ সেই স্মৃতি আমি কোনদিনও ভুলবো না। একরাশ অপার্থিব ভালো লাগা নিয়ে আব্বুর হাত ধরে ডুবতে শিখি সেদিন।আমার একটুও ভয় করেনি। কারণ আমার তো অবলম্বন ছিলো। এক আকাশ সমান ভালোবাসা নিয়ে একটা মানুষ হাত বাড়িয়ে রেখেছিলো। আমি পানিতে ভেসে উঠতেই সেই মানুষটা হেসে উঠছিলো ফিক করে । বৃষ্টির ঝাপটায় চোখ বন্ধ করে ফেলতে ফেলতে আমি সেই মানুষের মুখটাকে দেখে নিচ্ছিলাম। কি অসাধারণ ছিলো সেই হাসি!
লেখক : কবি মতিউর রহমান মল্লিকের ছোট মেয়ে