আষাঢ় শুরু হয় সৃজনশীল কবির মনে একাকী সিক্ত হওয়ার বেদনা সৃষ্টি করে। এই মাসে বৃষ্টির শব্দ ছাড়া প্রাণিকুলের গলা থেকে যেন ‘রা’ বেরোতে চায় না। কবির জন্য বন্ধুত্বের পিপাসা শত জলধরের মধ্যেও তাকে তৃষ্ণার্ত করে রাখে। চারদিকে জলতরঙ্গের গুঞ্জন শুনে তিনি বিহ্বলের মতো একাকী কল্পনার বালিশে মাথা গুঁজে কিসের যেন মিল খুঁজে বেড়ান।
এই জল এই ঝড়
এই জলতরঙ্গের খেলা
মনে হয় শেষ নেই
আমার তো ফুরিয়েছে বেলা।
ঝরে গেছে সব পাতা
তুলে নিয়ে খোলা ছাতা
কে যায় কোথায়
আমি শুধু বসে থাকি
আকাশের আনন্দ মাখি
ডাকি আয় আয় আয়।
এই ডাক বৃষ্টির শব্দের সাথে মিশতে থাকে। কারো ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনাই কবির মনে আশা জাগিয়ে তোলে না। এ ধরনের কোনো বেদনা থেকেই সম্ভবত কালিদাশ ‘মেঘদূত’ রচনার অনুপ্রেরণা খুঁজে পেয়েছিলেন। সব যেন কেমন একটু ভেজা ভেজা নরম। রাজি হওয়া নারীর মতন। আষাঢ় বাংলাদেশে বর্ষা ঋতুর মহিমাকে আনন্দঘন না করলেও বিরহের যাতনা আকাশ উল্টো করে ঢেলে দিয়েছে। কবির মনে যে অস্বস্তি জমা হয়, না-লিখতে পারার এক ধরনের খিঁচুনিতে সারা শরীরে সেই যাতনা ছড়িয়ে পড়ে। অথচ আষাঢ় হলো প্রকৃতিকে মিল ও সহজ করে দেয়ার মাস। সব কিছুতেই অসম্মত প্রকৃতি ও আষাঢ়ে তার রাজিনামা লিখে দেয়। সবই নরম, সম্মত, সহজ কিন্তু তৃপ্তি নেই কেবল কবির। সিক্ত শাড়ি কে যেন পাশের বাড়ির বারান্দায় মেলে দিয়েছে। সেই দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে কবি তার নৈসঙ্গ নিয়ে উদাসীন হয়ে থাকেন। আষাঢ় শহর ও গ্রামকে একাকার করে দেয়। অপরিতৃপ্তির বেদনা যেন জলের শব্দ হয়ে মাটিতে নিংড়ে মিশ্রিত হয়। প্রাণিকুলের মধ্যে শব্দ না করার একটা প্রকৃতি জাগিয়ে তোলে। শুধু দোয়েলের গলা খনখনিয়ে শিস দিয়ে এক ডাল থেকে অন্য ডালে উড়ে যায়। আর সবই নীরব নিস্তব্ধ। পানি পড়ার শব্দ।
‘‘কে যে কবে লিখেছিল
‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ এই মহাশ্লোক।
সেই ছন্দে আমি কাঁপি
শূন্য ঝোলা শূন্য ঝাঁপি
হৃৎপদ্মে ভোরের আলোক।’’
কবিতা তো থেমে থাকে না। সে প্রতিটি ঋতুতে পরমান্নের জন্য ুধার্ত থাকে। কেয়ার কাঁটার ফাঁকে মাদকতাময় তীব্র গন্ধময়ী কেয়া পুষ্প সব পোকা-মাকড়কে আকর্ষণ করে। উন্মাদ উৎসারণের মিলনের যুক্ত হওয়ার বাসনা জাগিয়ে উন্মাদ করে রাখে।
প্রকৃতিতে এই প্ররোচনা খুবই সন্তর্পণে সংক্রমিত হয়। অথচ চুষ্মানরা অন্তর্চু না থাকলে চর্মচক্ষে কিছুই দেখতে পায় না। আমরা যাকে বলি অবলোকন তা হৃদয়ের অভ্যন্তরে লুকানো চোখের পাপড়ি মেলে দিয়ে কেয়া বনে কামের কুসুম ফুটেছে, তা দেখে খুব ধীরে নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে।
আষাঢ় ছাড়া প্রকৃতিকে নরম করার আর কোনো মন্ত্র ঋতুরাজ বসন্ত দিতে পারে না। এই মাসেই কবির মনে এই প্রশ্ন জাগায় কবিতা না হলে বিপরীত লিঙ্গের মধ্যে সংযোগের লিপ্ত হওয়ার পৌরহিত্য করবে কে?
আষাঢ় কবিতাকেও ভিজিয়ে দেয়। শব্দের ওপর একটা চকচকে ভাব এসে গাঢ়তা সৃষ্টি করে দেয়। আষাঢ় হলো দুই বিপরীতের মধ্যে মিলনের পুরুহিত মাস। সেতু।
‘সেই শ্লোক তখনও বাজে
হৃদয়ে মেঘেরা সাজে
ঝরে পড়ে অমৃতের ধারা,
সব দিয়ে আমি খালি
মুছে চোখ অন্ধ কালি
রিক্ত আমি সিক্ত সর্বহারা।’
এসব দিয়ে শূন্য হয়ে যাওয়ার বেদনা আষাঢ় ছাড়া আর কোনো মাস পূর্ণভাবে প্রয়োজন মেটাতে পারে না। যদিও এরপরই শ্রাবণ এসে আষাঢ়ের অপূর্ণ কাজ নিজের মধ্যে দায়িত্ব হিসেবে এক ধরনের সজল পূর্ণতা দিতে বৃষ্টির বিবরণ ব্যাখ্যা করতে থাকে। তবে শ্রাবণে না পৌঁছা পর্যন্ত আষাঢ়ের কাজ হলো অসম্মতকে সম্মত করানো এবং দৃঢ়তাকে নম্য বা নরম করে তোলার প্রয়াসী পুরোহিত মাস মাত্র।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন