উ-মা-গো!
সালেহা খানমের মুখ ফুটে শব্দটা বের হয়ে গেলো। চোখ দিয়ে পানিটা বের হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। খাটের পায়ার সঙ্গে তার পায়ের বুড়ো আঙুলটার ধাক্কা লেগেছে। নিচে তাকিয়ে দেখলেন, পুরো আঙুলটা টকটকে লাল হয়ে আছে। ব্যথায় যেন পা প্রায় অসাড় হয়ে গেছে। একটি খুশির দিনের এমন শুরুটা সালেহা আশা করেননি। আজকে মাসের দ্বিতীয় শুক্রবার, বৃদ্ধাশ্রমের এই দিন তার জন্য খুশির দিন। কারণ এই দিন তার ছেলে মঞ্জু তার কাছে আসে। তারপর তাকে নিয়ে তাদের বাসায় যায়। সারাদিন সে ছেলে, ছেলের বউ আর নাতনির সঙ্গে মজা করে কাটায়। সন্ধ্যায় আবার ছেলে তাকে বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে যায়।
এতে অবশ্য তার ছেলের কোনো দোষ নেই। আগে সবাই একসাথেই থাকতো। তারপর করোনা হানা দিলো। ছেলের ভালো চাকরিটিও গেলো। সংসার সামলাতে গ্রামে নামমাত্র জমিটুকু ছিল। তা-ও বিক্রি করতে হলো। মঞ্জু এই চারজনের পেট চালাতে ব্যর্থ হচ্ছিল। একদিন মঞ্জু তার মায়ের পাশে বসে হাত ধরে বলেছিল এই বৃদ্ধাশ্রমের কথা। সালেহা তার ভেতরের কষ্ট লুকিয়ে হাসিমুখে বলেছিল, ‘এ তো খুব ভালো বুদ্ধি। আগে বলিসনি ক্যানো?’ ছেড়ে আসার দিন তার একমাত্র নাতনি খুব কাঁদছিল।
নাতনি তার দিদিভাইয়ের অন্তঃপ্রাণ। তার বউমা যেন তার মেয়ের মতো আদর করে। খুব মন কাঁদে তাদের জন্য। তবুও তিনি আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করেন যে, মাসে একটিবার তার পরিবারকে দেখার সুযোগ পান। বৃদ্ধাশ্রমের অনেক নারী তো তা-ও পান না। তবে অনেকে বলেন, প্রথম প্রথম নাকি সবাই দেখতে আসে। তারপর আস্তে আস্তে সব বন্ধ হয়ে যায়।
সালেহা আঙুল ধরে ঘড়ির দিকে তাকায়, দশটা বাজে। এর মধ্যে তো মঞ্জুর চলে আসার কথা। তবে কি আজ মঞ্জু আসবে না? অবশ্য গত মাসে ছেলে মাকে বলেছিল, সে আর নিতে পারছে না। আর্থিক কষ্টে আরও ডুবে যাচ্ছে। তবে কি এই মাসে সালেহা তার প্রিয় মুখগুলোকে দেখতে পারবে না? মন থেকে যে শুধুই কুডাক দিচ্ছে।
হঠাৎ ঘরের দরজায় একটি টোকা পড়ল। সঙ্গে তার চিরচেনা কণ্ঠস্বর।
মাগো! আসবো?
কণ্ঠস্বরটি শুনেই যেন সালেহার চোখে পানি চলে এলো। কোনোমতে পানি মুছে হাতের কাছে থাকা কোরআন শরীফ কোলে নিয়ে বসে পড়লো।
দরজার ছিটকিনি খোলা আছে! চলে আয়।
মঞ্জু এসেই মায়ের পায়ে সালাম করে মাকে জড়িয়ে ধরল। ঠিক তখন যেন সালেহার চোখের কোণে থাকা শেষ অশ্রু ফোঁটা তার ছেলের শার্টে পড়ে গেলো।
কিরে বাবা! আজ এতো দেরি?
তোমার বউমা আজ তোমার জন্য খিচুড়ি রান্না করে দিলো, তাই লেট হলো।
মানে কি? আজ বাসায় যাবো না?
আজ না যাই মা। তোমার নাতনি আর বউমা গেছে তার এক মামার বাসায়। ওই বাসায় কি জন্মদিন না কি অনুষ্ঠান। তাই আমি ভাবলাম, আজ মা ছেলে একসাথে সারা ঢাকা শহর ঘুরবো। কী বলো, মজা হবে না?
সালেহা রেগে বললেন, তুই ঘোর। আমার শরীর ভালো না। আমি ঘুমাবো।
আরে! খিচুড়ি খেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। তোমার বউমার খিচুড়ির রান্নার হাত ভালো। ওপরে আবার এক চামচ ঘি দিয়েছে। দেখো?
ঘিয়ে মাখা খিচুড়ির ঘ্রাণ নাকে যেতেই সালেহার পেটের ক্ষিধে যেন নড়ে বসলো। ছেলে আসবে বলে সকাল থেকে কিছুই খাননি। তাই মঞ্জুর হালকা জোড়াজুড়িতেই সালেহা খেতে বসে গেলেন। মা-ছেলে শুক্রবার সকালে খিচুড়ি খাচ্ছে। সালেহা তাকিয়ে দেখলেন, তার ছেলে এখনো গুছিয়ে খেতে পারে না। প্লেটের চারিদিকে ভাত-ডাল ফেলে একাকার অবস্থা করে আছে। ঠিক যেন তার ছোটবেলার মতো। তিনি গম্ভীর মুখে বললেন, মঞ্জু, প্লেটের ভাত গুছিয়ে খা। প্লেটের বাইরে এত ভাত ফেলিস ক্যান! জানিস না আখিরাতে একটা ফেলে দেওয়া ভাত…
‘সত্তরটা সাপ হয়ে কামড়াবে’ মায়ের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে হাসতে হাসতে বলে দিলো মঞ্জু।
সালেহার শত মানাকে হার মানিয়ে মা-ছেলে ঘুরতে বের হলো। যদিও তার শুধু মনে হচ্ছে, তার নাতনি আর বউমা থাকলে বেশি ভালো হতো। তবুও মঞ্জু নাছোড়বান্দা। আর মঞ্জু যাবে কোথায়? সেই চিড়িয়াখানায়। ছোটবেলা থেকেই তার পছন্দের জায়গা ওই একটাই। কতবার যে সে গেছে। তবুও তার মন ভরে না। প্রত্যেকবার যাওয়ার ওই একটাই কারণ ইদানিং নতুন অমুক-তমুক প্রাণি এসেছে।
সালেহা খানম আর মঞ্জু চিড়িয়াখানা ঘুরছে। নানা রকম পশু-পাখি দেখছে। তিনি খেয়াল করে দেখলেন, মঞ্জু পশু-পাখির সব কর্মকাণ্ড কী মুগ্ধ চোখে দেখছে। ঠিক পুরো ছোটবেলার মতো। বাঘ-সিংহ দেখবে আর হাতি-ঘোড়ার পিঠে চড়বে। সালেহাকে অবাক করে দিয়ে মঞ্জু আজকেও ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসল। তিনি খেয়াল করে দেখলেন, তার ছেলেকে রাজকুমার থেকে কোনো অংশে কম লাগছে না। শুধু রোদে পুড়ে হালকা কালো হয়ে গেছে। এই আর কি! মঞ্জু আজ কেন যেন একটু বেশিই খুশি। ঘোড়ার পিঠে উঠে সে কী তার প্রাণখোলা হাসি।
মা ছেলে দুপুরে এক হোটেলে খেতে বসেছে। মঞ্জু বসেই অর্ডার দিলো ভাত আর দুটা সর্ষে ইলিশ! সালেহা রাগান্বিত কণ্ঠে বললেন, ইলিশ মাছের কাঁটা বাছতে শিখে গেছিস?
না মা।
তাহলে আনতে বললি ক্যান?
মঞ্জু হাসতে হাসতে বলল, মা-ছেলের পছন্দ তো ওই এক জায়গায়, সর্ষে ইলিশ! তাই দেখে লোভ সামলাতে পারলাম না। তুমি বেছে দিবা। মা-ছেলে একত্রে খাবো!
তাহলে বাসায় একটা কিনে নিয়ে যেতে পারিস না? বউমা রান্না করে দেবে।
ইলিশ মাছের যা দাম মা! তোমার ছেলে শুধু দুই পিছ কেনার সামর্থ রাখে, হা হা হা!
ছেলের মুখে এ কথা শুনে সালেহার মনটা যেন আরও খারাপ হয়ে গেল। মনে মনে বললেন, আল্লাহ, তুমি সারা দুনিয়ার ধন-সম্পদ আমার মঞ্জুর নামে লিখে দাও। যেন সারাজীবন কাটে তার সর্ষে ইলিশে!
ফেরার পালা!
সালেহা জানে, এখন মঞ্জু তার স্বভাবমতো মায়ের কাছে মাফ চাইবে। তাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখেছে বলে। বলবে, যখনই তার অবস্থার বিন্দুমাত্র উন্নতি হবে; তখনই তাকে এই বৃদ্ধাশ্রম থেকে নিয়ে যাবে। সালেহার মন খারাপ হলেও হাসিমুখে বলবেন, তুই আমাকে নিয়ে টেনশন করিস না। আমি এখানে খুব ভালো আছি। সবার সাথে গল্প করি। ভালোই কাটে সময়।
তবুও মঞ্জু মাফ চায়, কথা দেয়। পাশের রুমে রহিমা আপা অবশ্য সালেহাকে বলেছেন, এসব কথা হলো সন্তানদের ঢং। তারা শুধু মন রক্ষার্থে এসব প্রথম প্রথম বলে। কিছুদিন পর দেখবেন, তা-ও বলছে না। আজ মঞ্জু কিছু বলছে না, শুধু মায়ের হাত ধরে বসে আছে। তাহলে কি!
সালেহা এবার নিজে থেকেই বলা শুরু করলেন, তোরা ভালো থাকিস। খবরদার অহেতুক আমার বউমাকে জ্বালাবি না। আমার দিদিভাইকে অনেক আদর দিবি। আমি ভালো আছি। আমাকে নিয়ে টেনশন করবি না।
মঞ্জু কিছু বলল না। শুধু মাথা নিচু করে হ্যাঁ-হুঁ করে গেলো। সালেহা এবার চোখটা বন্ধ করলেন। সারাদিন আজ অনেক হাঁটা হয়েছে। শরীর বড্ড ক্লান্ত। বৃদ্ধাশ্রমে এসে গেলে মঞ্জুই তাকে জাগিয়ে দেবে।
দিদিভাই ও দিদিভাই, ওঠো!
সালেহা খানম মনে হয় স্বপ্নে তার নাতনির ডাক শুনতে পেলো। তিনি আবারও স্বপ্নে শব্দগুলো শোনার চেষ্টা করলেন। এবার হাতে হালকা ঝাঁকুনি খেলেন। চোখ খুলে দেখেন, সামনে তার দিদিভাই আর খানিকটা দূরে একটা নতুন বাসার সামনে দাঁড়িয়ে তার ছেলে আর বউমা মুখ টিপে হাসছে। সালেহা পুরো হতভম্ব। হচ্ছেটা কী? এবার মঞ্জু এসে মায়ের হাত ধরে বলল, বলেছিলাম না মা! আমার অবস্থার বিন্দুমাত্র উন্নতি হলে তোমাকে নিয়ে আসবো? আমার করোনার আগের চাকরিটি দশদিন আগে ফেরত পেয়েছি। এমনকি আমার বেতন আগের থেকে বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই বড় বাসা ভাড়া নিয়েছি। আর নয় সেই বৃদ্ধাশ্রম। আজ থেকে আবারো আমরা একসাথে!
সালেহা কী বলবেন বুঝতে পারছেন না। নাতনি এসে হাত ধরে টেনে বাসার ভেতর নিয়ে যাচ্ছে। বলছে, জানো দিদিভাই, আজ সারাদিন বাবা তোমায় নিয়ে ঘুরেছে। আমি আর মা তোমার আসার জন্য এই বাসা সাজিয়েছি। সুন্দর হয়েছে না বলো? মজার কথা হলো, নতুন বাসায় বাবা-মা এক রুমে আর তুমি-আমি এক রুমে। কত্ত মজ্জা। তাড়াতাড়ি আসো, দেখাই। বলে টানতে টানতে রুমে নিয়ে যাচ্ছে। সালেহা খানমের বিশ্বাস হচ্ছে না, তিনি বোবার মতো চারিদিকে তাকিয়ে দেখছেন। তিনি স্বপ্ন দেখছেন না তো। কেউ একটু চিমটি কাটুক।
উ-মা-গো!
মুখ ফুটে শব্দটা বের হয়ে গেলো। চোখ দিয়ে পানিটা বের হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। রুমের সাইডে রাখা চেয়ারের পায়ার সাথে সালেহা খানমের বুড়া আঙুলটা ধাক্কা খেয়েছে। একদিনে দুবার আঙুলটা ব্যথা পেলো। তবে এবার এতটা ব্যথা লাগছে না কেন?
সাখাওয়াত হোসেন , গণমাধ্যমকর্মী ও শিক্ষার্থী
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন