কবি শামসুর রাহমানের ৮৪তম জন্মদিন বুধবার
প্রতিবাদী কবি শামসুর রাহমানের ৮৪তম জন্মদিন ২৩ অক্টোবর বুধবার। শামসুর রাহমান বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি।
১৯২৯ সালের এই দিনে তিনি পুরান ঢাকার মাহুতটুলির নানার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। মোখলেসুর রাহমান চৌধুরীর দ্বিতীয় স্ত্রীর দশ সন্তানের (চারভাই-ছয়বোনের মধ্যে) মধ্যে জ্যেষ্ঠ শামসুর রাহমান। প্রথম স্ত্রী তিন পুত্র রেখে মারা যাওয়ার পর প্রথম স্ত্রীর ছোটবোন আমেনাকে বিয়ে করেন মোখুলেসুর রাহমান। ৭৭ বছর বয়সে ২০০৬ সালের ১৭ আগষ্ট কবি শামসুর রাহমান এই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন।
১৯৩৬ সালে শামসুর রাহমান পুরনো ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ পোগজ স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯৪৫ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা শেষ করে রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ, বঙ্কিম চন্দ্র ও শরৎ চন্দ্রের রচনা পড়া শেষ করেন।
১৯৪৭ সালে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণি পাশ করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে। স্নাতক সম্মান পড়া শেষ বছর পর্যন্ত চালিয়ে গেলেও পরীক্ষায় অবতীর্ণ হননি।
১৯৫৩ সালে পাস কোর্সে স্নাতক পাস করেন। মাস্টার্স ভর্তি হয়ে প্রথম পর্ব কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন, কিন্তু শেষ পর্বের পরীক্ষায় আর বসা হয়নি তার।
১৯৫৫ সালের ৮ জুলাই লেখাপড়া অসমাপ্ত রেখেই জোহরা বেগমের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এই দম্পতির তিন কন্যা (সুমায়রা রাহমান, ফাইয়াজুর রাহমান, ফৌজিয়া রাহমান) ও দুই পুত্র (ওয়াহিদুর রাহমান মতিন এবং সেবা রাহমান)।
সাংবাদিকতার বাইরে তিনি প্রথম সম্পাদনা করেন লিটল ম্যাগাজিন `কবিকণ্ঠ`। ১৯৫৬ সালে তিনি ছিলেন এটির সম্পাদক মণ্ডলীর সম্পাদক।
১৯৫৭ সালে কর্মজীবন শুরু করেন `মর্নিং নিউজ`-এর সহ-সম্পাদক হিসেবে। ১৯৫৮ সালে সাংবাদিকতা ছেড়ে অনুষ্ঠান প্রযোজক হিসেবে যোগ দেন রেডিও পাকিস্তান-এর ঢাকা কেন্দ্রে।
পরে আবার ফিরে আসেন জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক হিসেবে `মর্নিং নিউজ` পত্রিকায়। `মর্নিং নিউজ`-এ ১৯৬০ থেকে ১৯৬৪ পর্যন্ত কাজ করেন। ১৯৬৪ সালে পত্রিকা জগতে নতুন আসা সরকার নিয়ন্ত্রিত বাংলা পত্রিকা `দৈনিক পাকিস্তান`-এ (`দৈনিক বাংলা`) যোগ দেন সহকারী সম্পাদক হিসেবে।
দীর্ঘ ১৩ বছর কাজ করার পর ১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি `দৈনিক বাংলা` এবং এর অঙ্গ প্রতিষ্ঠান সাপ্তাহিক `বিচিত্রা`-র সম্পাদক নিযুক্ত হন। এসময় `একটি মোনাজাত` নামের কবিতা লেখার জন্য সরকারের রোষানলে পড়েন।
১৯৮৭ সালে স্বৈরশাসনের প্রতিবাদে `দৈনিক বাংলা` থেকে ইস্তফা দেন কবি। এ সিদ্ধান্ত ছিল শামসুর রাহমানের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, কেননা ঢাকায় থাকার মতো তখনো কোনো নিবাস ছিল না কবির, অর্থ উপার্জনের ছিল না কোনো বিকল্প রাস্তা।
তাছাড়া তখন কবির ফুসফুসেও দেখা দিয়েছে সমস্যা। সব মিলিয়ে প্রচণ্ড দুঃসময় কবির ব্যক্তিগত জীবনে। জাতীয় জীবনের দুঃসময়ে নিজের কথা ভুলে কবিতাকে অস্ত্র মেনে দুঃশাসন অবসানের আন্দোলন চালিয়ে গেলেন কবি।
১৯৮৭ থেকে পরবর্তী চার বছরের প্রথম বছরে `শৃঙ্খল মুক্তির কবিতা`, দ্বিতীয় বছরে `স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কবিতা`, তৃতীয় বছরে `সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কবিতা` এবং চতুর্থ বছরে `সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কবিতা` লেখেন তিনি।
গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারের অবসান ও গণতন্ত্রের পুনর্যাত্রা প্রত্যক্ষ করে ১৯৯১ সালে লেখেন `গণতন্ত্রের পক্ষে কবিতা।
১৯৮৭ সালে ক্ষণজীবী `অধুনা` সাহিত্যপত্রের সম্পাদক ছিলেন তিনি। সাপ্তাহিক `মূলধারা`-য় ১৯৮৯ সালে প্রধান সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন তিনি এবং ১৯৯১ সাল পর্যন্ত `মূলধারা`-র সাহিত্য সহযোগী পত্রের সম্পাদক ছিলেন। পরে তিনি ১৯৯৬ সালে বাংলা একাডেমীর সভাপতি নিযুক্ত হন।
শামসুর রাহমান সাংবাদিকতা পেশায় দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন। পঞ্চাশের দশকের শেষদিকে ‘মর্নিং নিউজে’ সাংবাদিকতা দিয়ে পেশাগত জীবন শুরু করেন। পরবতৃীতে দৈনিক বাংলাসহ অনেক পত্রিকায় কাজ করেছেন।
পেশাগত অবদানের কারণে শামসুর রাহমান স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক, বাংলা একাডেমী পুরস্কার, আদমজী পুরস্কার, আনন্দ পুরস্কার, জীবনানন্দ পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।
রবীন্দ্রভারতী ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে সম্মানসূচক ডি-লিট উপাধি দেয়া হয়।
পুরান ঢাকার বাসিন্দা কবি নগর জীবনের নানা অনুষঙ্গ ও প্রকরণ কবিতায় তুলে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন।
শামসুর রাহমানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে। এটি প্রকাশিত হয় ১৯৬০ সালে। কবির নিমগ্ন অন্তর্গত বোধ ও ভাবনার জগতের অপূর্ব রূপায়ণ ছিল এ কাব্যগ্রন্থে।
ষাটের দশকে প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘রৌদ্র করোটিতে’, ‘বিধ্বস্ত নীলিমা’, ‘নিরালোকে দিব্যরথ’, ‘আমি অনাহারী’ ইত্যাদি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ওপর লিখিত তার দুটি কবিতা ‘স্বাধীনতা তুমি’ এবং ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’ একইসঙ্গে পাঠকের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়।
সত্তরের নভেম্বরে ভয়াল জলোচ্ছ্বাসের পর মওলানা ভাসানীর পল্টনের ঐতিহাসিক জনসভার পটভূমিতে রচিত ‘সফেদ পাঞ্জাবি’, তারও আগে ‘বর্ণমালা আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’, ‘গেরিলা’, ‘কাক’ ইত্যাদি কবিতায় উচ্চারিত হয়েছে এদেশের কোটি মানুষের কণ্ঠধ্বনি।
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে জীবন বিসর্জন দেয়া আসাদকে নিয়ে লিখেছেন ‘আসাদের শার্ট’ কবিতাটি। সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লিখেছেন ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’।
সাহিত্যকর্মের পাশাপাশি প্রগতিশীলতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও মানবতার পক্ষে এবং সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, স্বৈরশাসন ও কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে কবির অবস্থান ছিল স্পষ্ট, সুদৃঢ় ও তর্কাতীত। বাংলাদেশের প্রায় সব মর্যাদাপূর্ণ সম্মাননা ও পদকে ভূষিত করা হয়েছে কিংবদন্তিতুল্য কবি শামসুর রাহমানকে। পেয়েছেন আদমজী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৩), বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬৯), রাষ্ট্রীয় `একুশে পদক` (১৯৭৭), মিৎসুবিশি পুরস্কার (১৯৮২) ও রাষ্ট্রীয় `স্বাধীনতা পুরস্কার` (১৯৯২)। ১৯৯৪-এ পেয়েছেন ভারতের আনন্দ পুরস্কার