Image description
কোটা অন্দোলনঃ ২০১৮ তে আনন্দ মিছিল, ২৪ এ বাধা ছাত্রলীগের
২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সাথে রাজপথে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত। সে সময় আন্দোলন করতে গিয়ে আহতও হয়েছিলেন তিনি। শুধু সৈকত নয় ছাত্রলীগের পদধারী অনেক নেতাই অংশ নিয়েছিলেন সেই আন্দোলনে। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রীর কোটা বাতিলের ঘোষণায় আনন্দ মিছিলও করতে দেখা ছাত্রলীগের শীর্ষ-নেতাদের। তবে ২০২৪-এ এসে সে চিত্র পুরোপুরি পাল্টে যায়। সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে যেতে বাধা এবং কোটা-বিরোধী আন্দোলনের নেতাকে হল-ছাড়া করার চেষ্টার অভিযোগ উঠে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। ছাত্রলীগের এই অবস্থানে ক্ষুব্ধ সাধারণ শিক্ষার্থীরা দুয়োধ্বনিও দেন। ছাত্রলীগ সূত্রে জানা যায়, চলমান কোটা-বিরোধী আন্দোলনের পক্ষে নয় সরকারদলীয় এই ছাত্র সংগঠন। যতটা সম্ভব শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনের বাইরে রাখা এবং ছাত্রলীগের পদধারী নেতাদের এই আন্দোলন থেকে দূরে থাকার নির্দেশনা রয়েছে। শীর্ষ নেতাদের নির্দেশনা অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের বাধা দেওয়া এবং কোটা আন্দোলনের সময় ছাত্রলীগের কর্মসূচি ডাকছেন পদ-প্রত্যাশী নেতাকর্মীরা। শীর্ষ নেতারাও নেতাকর্মীদের নিয়ে মধুর ক্যান্টিনে বসছেন, সেখানে সাধারণ শিক্ষার্থীদের থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, অন্যথায় হলে থাকা যাবে না বলে হুশিয়ারি দেন তারা। বিভিন্ন মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কোটা আন্দোলনে না যেতে হুশিয়ার করা হচ্ছে। যার বেশ কয়েকটি প্রমাণ দেশ রূপান্তরের হাতে এসেছে। তবে কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের মধ্যেই দুই পক্ষ তৈরি হয়েছে। নির্দেশনা অমান্য করেই কোটা আন্দোলনে অংশ নিচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয় ও হল ছাত্রলীগের অনেক নেতাকর্মী। অনেকেই প্রকাশ্যে নেতিবাচক অবস্থানের কারণে নেতাদের সমালোচনা করছেন। তাদের ভাষ্য, এটা আমাদের অস্তিত্বের লড়াই, বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই। ছাত্রলীগের আরেকটি সূত্র বলছে, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের বাধা দেওয়ার কোনো নির্দেশনা নেই। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের দুই নেতার পক্ষ থেকে এই নির্দেশনা রয়েছে। যদিও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের অনুসারীদেরও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে যেতে বাধা দেওয়ার অভিযোগ আছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের এক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, কেন্দ্রীয় সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকের পক্ষ থেকে এমন কোনো নির্দেশনা নেই। কোটা আন্দোলনে ছাত্রলীগের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা ও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে যেতে বাধাদানের বিষয়ে আক্ষেপ করে সূর্যসেন হলের উপ-শিক্ষা ও পাঠচক্র বিষয়ক সম্পাদক মো. ওয়ালীউল্লাহ ফেসবুকে লিখেন, ‘অথচ আমার ভালোবাসার প্রিয় সংগঠনটির সুযোগ ছিলো সারা বাংলার ছাত্রসমাজের মণিকোঠায় জায়গা করে নেওয়ার! কিন্তু আফসোস!’ গত বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের সামনে অবস্থান নিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে যেতে বাধা দেয় হল ছাত্রলীগের পদ-প্রত্যাশীরা। মাস্টার দ্য সূর্যসেন হলের মূল ফটক বন্ধ করে শিক্ষার্থীদের আটকে রাখে ছাত্রলীগ। সেখানে কোটাবিরোধী আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সাথে বাকবিতণ্ডায়ও জড়ান তারা। পরে বাহির থেকে কোটা বিরোধী আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা গিয়ে গেইট খুলে ভেতর থেকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে নিয়ে আসেন। এ সময় ছাত্রলীগ নেতাদের সাথে শিক্ষার্থীদের বাকবিতণ্ডাও হয়। তারই জের ধরে সেদিন মধ্যরাতে কোটা বাতিল আন্দোলনের অন্যতম নেতা সারজিস আলমকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অমর একুশে হল থেকে বের করে দেওয়ার চেষ্টার অভিযোগ উঠে। সারজিসের দাবি, কোটাবিরোধী বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেওয়ায় তাকে অমর একুশে হল শাখা ছাত্রলীগের কমিটির নেতারা হল থেকে বের করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতা জানান, তাদের ওপর নির্দেশ আছে শিক্ষার্থীরা যাতে আন্দোলনে না যেতে পারে। শনিবার বিক্ষোভ মিছিলের আগেও হলগুলোতে শিক্ষার্থীদের বাধা প্রয়োগের অভিযোগ উঠে। তবে তা উপেক্ষা করে অনেক শিক্ষার্থী আন্দোলনে অংশ নেন। তবে একই সময়ে ছাত্রলীগ মধুর ক্যান্টিনে অংশ নেয়ায় অনেক শিক্ষার্থী সেখানে যেতে বাধ্য হন। মধুর ক্যান্টিনে অবস্থান করছিলেন ঢাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত এবং কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন। সেসময় কোটাবিরোধী বিক্ষোভ থেকে মধুর ক্যান্টিনের সামনে অবস্থানরত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের লক্ষ্য করে ‘ভুয়া ভুয়া দুয়োধ্বনি’ দেন আন্দোলনকারীরা। কোটা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ঢাবি শিক্ষার্থী হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, শিক্ষার্থীদের নানাভাবে হুমকি–ধমকি দেওয়া হচ্ছে আন্দোলনে না আসার জন্য। বিভিন্ন হলে বৃহস্পতিবার রাতেও তালা লাগিয়েছে। মেসেঞ্জার গ্রুপে নির্দেশনা দিচ্ছে কেউ যেন কোটা নিয়ে কোনো কথা না বলে। আমাকেও বিভিন্নভাবে বুঝানো হচ্ছে যাতে হলে না যাই। শিক্ষার্থীদের স্বার্থে আন্দোলন করতে গিয়ে পূর্বেও আমি এমন হুমকি–ধমকির সম্মুখীন হয়েছিলাম। আমরা আন্দোলন থেকে সরছি না। ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সম্পৃক্ত নেতাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সে সময় সামনের সারিতেই ছিলেন ঢাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত। তবে ছাত্রলীগের অনেকে সে সময় বিরোধিতা করেছিল এবং শিক্ষার্থীদের উপর হামলা করেছিল। যদিও পরবর্তীতে আনন্দও মিছিলও করে ছাত্রলীগ। প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক কোটা বাতিলের ঘোষণা পরবর্তী মিছিল থেকে প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ বলেন, ‘আপনি আমাদের আশা পূরণ করেছেন। এজন্য আপনাকে আমরা তরুণ-সমাজ অভিনন্দন জানাই।’ ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা ও ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের তৎকালীন আহ্বায়ক হাসান আল মামুন দেশ রূপান্তরকে বলেন, পুলিশ যখন শাহবাগে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের উপর টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে তখন সামনের সারিতেই ছিলেন তানভীর হাসান সৈকত। সে আহত হয়েছিল, তাকে আমরা হাসপাতালে নিয়েছিলাম। অথচ বিভিন্ন মাধ্যমে জানতে পারছি সে সৈকত এখন কোটা আন্দোলনে বিরোধিতা করছে, তার নেতাকর্মীরা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে যেতে বাধা দিচ্ছে। যদিও তার জন্য বিষয়টা নতুন না। ২০১৮ সালের ৩০ জুনের পর থেকেই সে কোটা সংস্কার আন্দোলনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। সেসময় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর ছাত্রলীগের তৎকালীন শীর্ষ নেতারা আনন্দ মিছিল করেছিল। যদিও সেটি ছিল লোক দেখানো। ছাত্রলীগ ক্ষণে ক্ষণে রূপ পরিবর্তন করবে এটাই স্বাভাবিক, ছাত্রলীগ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে বিরোধিতা করবে এটাই স্বাভাবিক সে সময় আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাবির এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘এটা স্পষ্টত দ্বিচারিতা। ১৮ এর কোটা সংস্কার আন্দোলনে তার একটি ছবি ছিলো পুলিশের হামলার সামনে প্রতিরোধ করছে এমন, সেই ছবি দেখিয়ে উনি নেতা হবার আগে কোটা আন্দোলনের ক্রেডিট নিতেন, গর্ব করে সেই ছবি প্রচারও করতেন। এমনকি কোটা বাতিল হবার খবরে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ আনন্দ মিছিলও করেছিলো। সেই ব্যক্তি এখন ঢাবি ছাত্রলীগের সেক্রেটারি হবার পরে পুরো উল্টে গেলেন! তবে ছাত্রলীগ নেতাদের দাবি, তারা কোনো শিক্ষার্থীকে আন্দোলনে যেতে বাধা দিচ্ছেনা। যেখানে সরকার এর পক্ষে সেখানে আন্দোলন করাই অযৌক্তিক বলে মনে করেন তারা। এছাড়া এই আন্দোলনে ছাত্রদল-শিবির সম্পৃক্ত আছে বলে অভিযোগ তাদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত বলেন, আমরা কারো কোনো আন্দোলনে বাধা প্রয়োগ করিনি। এটা মিথ্যা, বানোয়াট এবং গুজব। যারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের আবেগকে পুঁজি করে গোলা পানিতে মাছ শিকার করার চেষ্টা করছে, তারাই এসব গুজব ছড়াচ্ছে। তিনি বলেন, কোটা আন্দোলনে আমাদের অবস্থান ক্লিয়ার। আমরা মনে করি এটি সরকারের পক্ষে আন্দোলন। কিন্তু সাধারণ শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনে কেউ কেউ সরকারবিরোধী স্লোগান দিচ্ছে, ছাত্রদল এবং শিবির নেতাদের আমরা সেখানে দেখেছি। সরকার যেখানে এটার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে, সেখানে আন্দোলনের কোনো যৌক্তিকতা নেই। আন্দোলন থাকলেও সেটি সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন থাকবে। তাই কেউ যেন গোলা পানিতে মাছ শিকার করতেছে তারা যাতে সরকার বিরোধী কার্যক্রম হিসেবে ব্যবহার করতে না পারে, সেজন্য আমরা ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে সতর্ক অবস্থানে আছি। যাতে কেউ সাধারণ শিক্ষার্থীদের আবেগকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা না নিতে পারে। ঢাবি ছাত্রলীগের সভাপতি মাজহারুল কবির শয়ন বলেন, ছাত্রলীগ মনে করে সরকার আদালতের প্রক্রিয়া অনুযায়ী আবেদন করবে এবং তারপর আদালত যে রায় দেয় সে রায়ের প্রেক্ষিতে ছাত্রলীগ মন্তব্য করবে। আদালতের বিচারাধীন বিষয়ে ছাত্রলীগ সাংগঠনিকভাবে কোনো বিবৃতি এখন পর্যন্ত প্রকাশ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে যেতে ছাত্রলীগ কাউকে বাধা দেয়নি। কয়েকটি হলে বিচ্ছিন্নভাবে যা ঘটেছে সেসব ছিল ভুল বোঝাবুঝি।