দেশের চিকিৎসায় অনাস্থায় বিদেশমুখি মানুষ
সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান না থাকলেও প্রতি বছর ভারত, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডসহ ১৯টিরও বেশি দেশে চিকিৎসা নিতে যাচ্ছেন ৮ লাখেরও বেশি মানুষ। যাদের অধিকাংশের গন্তব্য ভারত। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধারা রোধ করতে হলে আন্তর্জাতিক চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সহযোগিতা বৃদ্ধি করে অঙ্গ প্রতিস্থাপন, ক্যানসার চিকিৎসা ও উন্নত সার্জারির মতো উচ্চমূল্যের চিকিৎসায় সরকারের আর্থিক সহায়তা প্রদান জরুরি।
তারা বলছেন, মূলত চিকিৎসকরা রোগীদের যথেষ্ট সময় না দেওয়া, হাসপাতাল-ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে সঠিক রোগ নির্ণয় না হওয়াসহ অন্তত ২১ কারণে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি অনেকে আস্থা রাখতে পারছেন না। ফলে প্রতি বছর এই সংখ্যক মানুষ চিকিৎসার জন্য ভারতসহ বিভিন্ন দেশে যাচ্ছেন। বিশেষ করে ক্যানসার, কিডনি ট্রান্সপ্লান্টসহ তিন থেকে চারটি রোগের চিকিৎসায় বেশি পরিমাণে বিদেশ যাচ্ছেন রোগীরা।
শনিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে চিকিৎসকদের নিয়ে আয়োজিত ‘চিকিৎসা সেবায় বিদেশমুখিতা : আমাদের উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএমসিএ) এ আয়োজন করে।
বিপিএমসিএ সভাপতি এমএ মুবিন খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব ডা. মো. সারওয়ার বারী। বিশেষ অতিথি ছিলেন স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) সহ-সভাপতি অধ্যাপক ডা. মো. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিলের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ডা. মো. হুমায়ুন কবির তালুকদার প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে বিপিএমসিএ সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ডা. মো. মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, দেশে চিকিৎসা সেবায় কিছুটা উন্নতি হলেও অব্যবস্থাপনা ও মানসম্পন্ন চিকিৎসার ঘাটতি রয়ে গেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশের বাইরে পর্যটক ভিসায় গিয়ে চিকিৎসা ব্যয়ের পরিমাণ ছিল প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদেশে চিকিৎসা বাবদ প্রকৃত ব্যয় আরও কয়েক গুণ বেশি।
অধ্যাপক ডা. মো. হুমায়ুন কবির তালুকদার বলেন, পেশাজীবীদের মধ্যে ব্যবসায়ীরাই বেশি দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে যান। এসব ব্যবসায়ীর মধ্যে থাইল্যান্ড ও ভারতে যাওয়ার সংখ্যা প্রায় কাছাকাছি। এরপর রয়েছে সিঙ্গাপুরের অবস্থান। এজন্য সরকারি হাসপাতালগুলোর আধুনিকায়ন জরুরি। পাশাপাশি বিশ্বের নামকরা চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানকে দেশে বিনিয়োগের সুযোগ দিলে এই বিপুল অর্থ দেশে রাখা সম্ভব।
তিনি বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে, ১২ রোগের চিকিৎসা নিতে দেশের বাইরে যাচ্ছে মানুষ। এর কারণ চিহ্নিত হয়েছে আটটি। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে কার্ডিওভাসকুলার বা হৃদরোগের চিকিৎসা, যা মোট রোগীর ১৭ শতাংশ এবং সবচেয়ে কম যাচ্ছে চোখ ও দাঁতের চিকিৎসা করাতে, যা মোট রোগীর ২ শতাংশ করে। এ ছাড়া ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ রোগী কিডনি রোগের, ১১ দশমিক ৫ শতাংশ রোগী অর্থোপেডিক সার্জারির জন্য, ১১ শতাংশ করে রোগী লিভার ও ক্যানসার রোগের, ৯ শতাংশ রোগী নিউরোলজি, ৬ শতাংশ রোগী গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি ও ইউরোলজি, ৫ শতাংশ রোগী নাক-কান-গলা এবং ৪ শতাংশ করে রোগী জেনারেল সার্জারি ও গাইনোকলজির চিকিৎসায় বিদেশে যাচ্ছে।
অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব ডা. মো. সারওয়ার বারী বলেন, সরকার বর্তমানে দেশের স্বাস্থ্য খাতকে খুবই গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। এজন্য মেডিকেল অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিলকে আরও শক্তিশালী করা হয়েছে। সরকার সাধারণ মানুষের বিদেশ যাওয়ার প্রবণতাকে কমানোর জন্য দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে আরও উন্নত করতে বদ্ধ পরিকর।
বিপিএমসিএ সভাপতি এমএ মুবিন খান বলেন, স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামো এবং মান উন্নয়নের প্রয়োজন রয়েছে। জটিল রোগ নির্ণয় করার ক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জামাদির জোগান নিশ্চিত করতে হবে।
জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি হাসান হাফিজ বলেন, বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে উচ্চমানের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা যেতে পারে।
বিএমডিসি সহসভাপতি অধ্যাপক মো. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে সাশ্রয়ী সেবার সঙ্গে চিকিৎসা পর্যটন খাতকেও সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য সরকারকে কর ছাড়সহ আর্থিক সহায়তা দিতে হবে। এছাড়াও একটি জাতীয় বিমা স্কিম তৈরি করতে হবে, যাতে জটিল সার্জারি ও আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসাসহ সব চিকিৎসাসেবা দেওয়া সম্ভব হয়। এতে মানুষ বিদেশে যাওয়ার চেয়ে দেশে চিকিৎসা গ্রহণে আগ্রহী হয়ে উঠবে।