ঘুমে অনিয়ম ডেকে আনে হার্টঅ্যাটাক-স্ট্রোক, বলছে গবেষণা
কারও কারও বেডটাইম নির্দিষ্ট। কেউ আবার সে সবের আশপাশ দিয়েও যান না। দিনে সাত-আট ঘণ্টা ঘুম হলেই হয় তাদের। তবে সাম্প্রতিক একটি গবেষণা বলছে, সাত-আট ঘণ্টার ঘুমই যথেষ্ট নয়। তার সঙ্গে জরুরি হলো, রোজ নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমিয়ে পড়া ও নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম থেকে ওঠা। অন্যথায় বিভিন্ন ক্ষতির মুখে পড়ে হৃদ-স্বাস্থ্য।
কারণ, প্রতিদিন যাদের ঘুমের সময়টা বাঁধা, তাদের হার্টঅ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি যখন-তখন ঘুমানো মানুষদের তুলনায় বেশ কম। প্রায় ৭২ হাজার মানুষের ওপর হওয়া একটি স্টাডি থেকে এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে ‘ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল’ বা বিএমজে বিজ্ঞান পত্রিকায় প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে।
চিকিৎসকরা বলছেন, শরীরের জৈব ঘড়িকে শৃঙ্খলায় বেঁধে না-রাখলে কার্ডিয়ো ভাসকুলার অসুখের ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমাতে যাওয়া এবং ঘুম থেকে ওঠার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
আমেরিকা, ক্যানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার একদল গবেষক ওই ৭২ হাজার মানুষের স্লিপ প্যাটার্ন এবং সার্বিক স্বাস্থ্য বিশ্লেষণ করে ঘুমের বাঁধাধরা সময় সম্পর্কে এমন ভয় ধরানো তথ্য তুলে ধরেছেন তাদের গবেষণাপত্রে।
মুখ্য গবেষক জিন ফিলিপ স্যাপু জানিয়েছেন, তারা সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের প্রতিধিনের ঘুমের ধরন দেখে তিনটি গোষ্ঠীতে ভাগ করেছিলেন-যারা প্রতিদিন সময় বেঁধে ঘুমায়, যাদের প্রায়ই বড়জোর আধঘণ্টা সময়ের হেরফের হয় এবং যাদের প্রায়ই একঘণ্টা সময়ের হেরফের হয়। প্রতি রাতে ঘুমোতে যাওয়া ও রোজ সকালে ঘুম থেকে ওঠার সময় মানার ব্যাপারে যাদের এক ঘণ্টার বেশি সময়ের হেরফের হয়, তাদেরই ‘অনিয়মিত’ তালিকায় ফেলা হয়েছে।
এই তিনটি গোষ্ঠীর জন্য তৈরি হয়েছিল স্লিপ রেগুলেটরি ইনডেক্স স্কোর। তার ১০০ পূর্ণমানের মধ্যে যারা ৭১ বা তার কম স্কোর করেছেন, হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকিটা মূলত তাদেরই বেশি বলেই দাবি গবেষকদের। তুলনায় ৮৭-র বেশি পাওয়া লোকজনের ঝুঁকি অনেকটাই, অন্তত ২৫% কম।
এই সিদ্ধান্ত তারা মিলিয়ে দেখেছেন ওই ব্যক্তিদের সার্বিক হৃদ-স্বাস্থ্যের সঙ্গে পর্যালোচনা করে। তাতে তারা দেখেছেন, হার্টঅ্যাটাক ও স্ট্রোকের আশঙ্কার নিরিখে সময়ে না-ঘুমোনো ও না-ওঠার মাশুল দেওয়ার আশঙ্কা তাদের অনেক বেশি।
শ্যাপু সতর্ক করে জানিয়েছেন, ঘুমের এই অনিয়ম সপ্তাহে দু’দিনের বেশি বরদাশত করতে পারে না শরীর। চিকিৎসকরাও মানছেন, এমনটা হওয়া স্বাভাবিক। নেপথ্যে রয়েছে শরীরের জৈব ঘড়ির ছন্দ বা সার্কাডিয়ান রিদম।
স্লিপ মেডিসিনের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সৌরভ বলেন, ‘গবেষকরা হাতে কলমে ঘুমের মান খারাপ হলে কী কী সমস্যা হয়, সেটা দেখিয়ে দিয়েছেন ঠিকই। তবে চিকিৎসাবিজ্ঞানে এ নিয়ে ধারণা নতুন নয়। অতীতেও দেখা গেছে, কর্মক্ষেত্রে যাদের শিফট বারংবার পরিবর্তন হয়, তাদের কার্ডিয়ো ভাস্কুলার হেলথের মান ভালো হয় না। কারণ, তাদের ঘুমোতে যাওয়া ও ঘুম থেকে ওঠার সময়টা খুবই অনিয়মিত।’
তিনি জানান, সার্কাডিয়ান রিদমে ছন্দপতন হলে শরীরে এমন কিছু হরমোনের পরিবর্তন ঘটে ও বিপাক বিঘ্নিত হয়, যা আখেরে হৃদস্বাস্থ্যে কুপ্রভাব ফেলে।
একই মত ভারতের ঘুম বিশেষজ্ঞ দীপঙ্কর দত্ত ও অরূপ হালদারের। সৌরভের সুরেই দীপঙ্কর বলেন, ‘সার্কাডিয়ান রিদমে গোলমাল হলে শরীরে স্ট্রেস হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায়, বিঘ্নিত হয় কোষস্তরের ড্যামেজ মেরামতির প্রক্রিয়াও। তা মারাত্মক প্রভাব ফেলে হার্টরেট, ব্লাডপ্রেশার, রেসপিরেটরি রেটে। এর জেরে রক্তবাহিকার নালীগুলি সরু হয়ে যায়, দেওয়াল হয়ে ওঠে শক্ত ও মোটা। ফলে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ে।’
অরূপ জানাচ্ছেন, ঘুম নিয়ে এই গবেষণা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, বিষয়টি মোটেই হেলাফেলার করার মতো নয়, বরং বেশ সিরিয়াস। তার কথায়, ‘সারা সপ্তাহ অনিয়মিত ঘুমের জেরে যে ক্ষতি হয় শরীরের, সেই ঘাটতি কখনোই সপ্তাহান্তে বা ছুটির দিনে পূরণ হয় না। তাই রোজ যথাসময়ে পর্যাপ্ত ঘুম জরুরি।’