বাংলাদেশের হাসপাতালে ৬৭ শতাংশ চিকিৎসক রোগী বা রোগীর লোকজনের সহিংসতার শিকার হন। দক্ষিণ এশিয়ায় এ হার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। সবচেয়ে বেশি সহিংসতার শিকার হন ভারতের ডাক্তাররা ৭০ শতাংশ। তৃতীয় সর্বোচ্চ পাকিস্তানে ৩৮ শতাংশ।
বাংলাদেশে মোট সহিংসতার ৯১ শতাংশই ঘটছে সরকারি হাসপাতালে এবং ৫১ শতাংশই ঘটে জরুরি বিভাগে। সহিংসতার শিকার হতে হচ্ছে তরুণ চিকিৎসকদের, যাদের ৩০ শতাংশই ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার। রাতে একা ডিউটি করার সময় ও ভোরে শিফট পরিবর্তনের সময় হামলার ঘটনা বেশি ঘটে।
গত এক বছরে কর্মক্ষেত্রে চিকিৎসকদের ওপর শারীরিক নির্যাতনের মাত্রা বেড়েছে। শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন ১৪ শতাংশ চিকিৎসক। আগের বছর এই হার ছিল ১২ শতাংশ। সহিংসতার ৬৫ শতাংশ ক্ষেত্রেই প্রতিকার পান না চিকিৎসকরা। রোগীর লোকজন হামলার চারটি কারণের কথা বলেছেন। মূল কারণ চিকিৎসা পেতে দেরি হওয়া। আর চিকিৎসকরা পাঁচটি কারণের কথা বলেছেন। মূল কারণ অপর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
দীপাবলিতে দুই বউকে কী উপহার দিলেন মুকেশ-নীতাদীপাবলিতে দুই বউকে কী উপহার দিলেন মুকেশ-নীতা
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রেডিওথেরাপি ও অনকোলজি বিভাগের মেডিকেল অফিসার ও ক্যানসার-বিশেষজ্ঞ ডা. নাজিরুম মুবিনের নেতৃত্বে আট সদস্যের চিকিৎসক দলের একটি গবেষণায় এ চিত্র দেখা গেছে।
গবেষণায় ২০০২-২৪ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও জাতীয় গবেষণা, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সরকারি ছয়টি বিভাগীয় হাসপাতাল ও অনলাইনে চিকিৎসকদের থেকে নেওয়া তথ্য ব্যবহৃত হয়েছে। গত সেপ্টেম্বরে যুক্তরাজ্যের গবেষণা জার্নাল বিএমসি (বায়োমেটস সেন্ট্রাল) হেলথ সার্ভেইলেন্স রিসার্চে ‘ওয়ার্কপ্লেস ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট ডক্টর’ শীর্ষক গবেষণাটি জমা দেওয়া হয়েছে।
ডা. নাজিরুম মুবিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চিকিৎসক ও নার্সসহ সব ধরনের স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের ওপর নির্যাতনের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এ-সংক্রান্ত কোনো তথ্য সরকারের কাছে নেই। অন্যান্য দেশের তুলনায় দক্ষিণ এশিয়ায় চিকিৎসদের ওপর হামলার ঘটনা বেশি। অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য প্রভৃতি দেশে স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর হামলা প্রতিরোধে কঠোর আইন আছে। অস্ট্রেলিয়াতে স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে উঁচুস্বরে কথা বললে তাকে পুলিশ কাস্টডিতে নিয়ে যাওয়ার বিধান আছে। কিন্তু বাংলাদেশে এমন কোনো আইন নেই।’
এ চিকিৎসক বলেন, ‘কারও নিকটজন হাসপাতালে ভর্তি হলে তারা মানসিকভাবে খুবই ভঙ্গুর অবস্থায় থাকে। তখন চিকিৎসায় কোনো অনিয়ম হয়েছে মনে হলে তারা আক্রমণ করে। কিন্তু চিকিৎসায় অবহেলা বা ভুল চিকিৎসার বিচার আইনি কাঠামোর মধ্যেই থাকতে হবে; হামলা করা যাবে না। হামলা প্রতিরোধের জন্য যে জনশক্তি, অবকাঠামো ও নিরাপত্তা থাকা প্রয়োজন, সেটা সরকারি হাসপাতালে খুবই অপ্রতুল। এ কারণেই হামলা হয়।’
বাংলাদেশ দ্বিতীয় অবস্থানে: গবেষণায় দেখা গেছে, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভারতে ৭০ শতাংশ চিকিৎসক জীবনে কোনো না কোনো সময় কর্মক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকার হন। বাংলাদেশে এ হার ৬৭ শতাংশ ও পাকিস্তানে ৩৮ শতাংশ। তুরস্কে ১৭ শতাংশ ও চীনে ১৬ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা কর্মী কর্মক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকার হন।
অবশ্য শারীরিক নির্যাতনে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয় ১৪ শতাংশ; ভারতে ১৯ শতাংশ ও পাকিস্তানে ১৬ শতাংশ। বাংলাদেশের সঙ্গে তৃতীয় অবস্থানে আছে সিরিয়া। সবচেয়ে কম নির্যাতনের ঘটনা ঘটে যুক্তরাজ্যে ৫ শতাংশ।
পুরুষ চিকিৎসকরা বেশিরভাগই শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। যেমন লাথি, চড়, ছুরিকাঘাত, গুলিবিদ্ধ হওয়া, ধাক্কাধাক্কি, প্রহার প্রভৃতি। আর মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার বেশি হন নারী চিকিৎসকরা। যৌন নির্যাতনের মধ্যে রয়েছে অপ্রত্যাশিত যৌন আচরণ, যৌন সুবিধার আবেদন প্রভৃতি।
তরুণ চিকিৎসকরা বেশি নির্যাতনের শিকার: সরকারি হাসপাতালে সবচেয়ে বেশি সহিংসতার শিকার হন তরুণ চিকিৎসক; ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার ৩০ শতাংশ, ইন্টার্ন চিকিৎসক ২৬ শতাংশ, মেডিকেল অফিসার ১৭ শতাংশ ও রেসিডেন্ট মেডিকেল অফিসার ১১ শতাংশ। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাদের ৫ শতাংশ, সহযোগী ও সহকারী অধ্যাপক ৪ শতাংশ, অনারারি মেডিকেল অফিসার ৩ শতাংশ, জুনিয়র কনসালট্যান্ট ও ডেন্টাল সার্জনরা ২ শতাংশ হারে সহিংসতার শিকার হন।
বেশি সহিংসতা সকালে ও রাতে, ৫২% জরুরি বিভাগে: সরকারি বিশেষায়িত ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে কর্মরত পুরুষ ও তরুণ চিকিৎসকরাই বেশি সহিংসতার শিকার হন। সহিংসতার ৬১ শতাংশই ঘটে রাতে ও সকালে। সহিংসতার শিকার চিকিৎসকদের ৮৬ শতাংশই পুরুষ। মোট সহিংসতার ৯১ শতাংশই ঘটছে সরকারি হাসপাতালে এবং ৫২ শতাংশই ঘটছে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে।
সাধারণ জরুরি বিভাগে ১৬ শতাংশ, জেনারেল সার্জারি ও জেনারেল মেডিসিন বিভাগে ১৪ শতাংশ করে, গাইনি ও প্রসূতি বিভাগে ৯ শতাংশ ও শিশু বিভাগে ৮ শতাংশ ও ৩ শতাংশ হামলা হচ্ছে নাক-কান-গলা বিভাগে। ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট ও অর্থোপেডিকস বিভাগে ৫ শতাংশ সহিংসতা হয় ও ৩ শতাংশ হয় ব্যবস্থাপনা বিভাগে। বাকি ২৪ শতাংশ সহিংসতা হয় অন্যান্য বিভাগে।
৭২% আত্মীয় আক্রমণকারী: চিকিৎসকদের ওপর আক্রমণকারীদের ৭২ শতাংশই রোগীর আত্মীয়স্বজন, ২৪ শতাংশ ঘটনা ঘটায় দেখতে আসা দর্শনার্থী বা অপরিচিতরা এবং ৪ শতাংশ রোগী নিজে।
মোটা দাগে চারটি কারণের কথা বলেছেন রোগী ও রোগীর লোকজন। ৩০ শতাংশ আক্রমণ হচ্ছে চিকিৎসায় অসন্তুষ্টি থেকে, ২৭ শতাংশ রোগী ও রোগীর লোকজনের অপ্রত্যাশিত চাহিদার কারণে যেমন হাসপাতালে ব্যবস্থা নেই বা যন্ত্রপাতি নষ্ট এমন পরীক্ষা করাতে দিলে ও বাইরে থেকে ওষুধসহ অন্যান্য চিকিৎসা সরঞ্জামাদি আনতে বললে রোগীরা অনেক সময় ক্ষেপে গিয়ে চিকিৎসকদের ওপর আক্রমণ করেন। ২৪ শতাংশ সহিংসতা হয় রোগীর মৃত্যু কেন্দ্র করে ও ২৩ শতাংশ হামলা হয় চিকিৎসার জন্য দীর্ঘসময় অপেক্ষার কারণে।
প্রতিকার নেই ৬৫% হামলার: গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ৬৫ শতাংশ হামলার ঘটনার তদন্ত হয় না ও চিকিৎসকরা প্রতিকার পান না। চিহ্নিত ৪৪ শতাংশ হামলাকারীর শাস্তি হয় না। ২৬ শতাংশ হামলার জন্য হামলাকারীদের মৌখিকভাবে সতর্ক করে দেওয়া হয়। ২০ শতাংশ চিকিৎসক জানতে পারেন না তাদের ওপর হামলার কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। হামলায় দায়ের হওয়া ২০ শতাংশ মামলা অনিয়মিত হয়ে যায়। মাত্র ৬ শতাংশ হামলার ব্যাপারে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পুলিশকে অবহিত করে।
উপযুক্ত আইন নেই: ভারত সরকার ২০২০ সালে কর্মক্ষেত্রে চিকিৎসকদের ওপর হামলার মামলাকে ‘আমলযোগ্য’ ও ‘জামিন অযোগ্য’ করেছে। ভারতের আদলে নেপালও ২০২২ সালে অনুরূপ আইন করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে উল্টো। এখানে চিকিৎসকদের সুরক্ষায় ফৌজদারি দ-বিধি ১৮৬০-এর ৮০ ও ৮৮ ধারায় বলা হয়েছে, চিকিৎসা দেওয়ার পর রোগী মারা গেলে চিকিৎসকের বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে না। রোগীরা চিকিৎসদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলে (বিএমডিসি) অভিযোগ করতে পারবেন। বিএমডিসি আইন ও পেশাগত আচরণবিধি ২০১৪ অনুযায়ী অবহেলা প্রমাণিত হলে ওই চিকিৎসকের নিবন্ধন বাতিল বা স্থগিত করতে পারে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯-কে চিকিৎসকদের জন্য হয়রানিমূলক ও ফৌজদারি দ-বিধি ১৮৬০-এর পরিপন্থী বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
হামলা বন্ধে ৯ সুপারিশ: কর্মক্ষেত্রে চিকিৎসকদের ওপর হামলা বন্ধে নয়টি সুপারিশের কথা বলা হয়েছে গবেষণায়। সর্বোচ্চ ৬৭ শতাংশ চিকিৎসক হাসপাতালের সার্বিক নিরাপত্তা বাড়াতে বলেছেন, ৬০ শতাংশ চিকিৎসক জরুরি বিভাগে নিরাপত্তা বাড়াতে বলেছেন। ৫২ শতাংশ চিকিৎসক জনবল বাড়াতে ও ৫০ শতাংশ চিকিৎসক রোগীদের জন্য প্রটোকল তৈরি ও তার বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়েছেন। ৪৫ শতাংশ চিকিৎসক জরুরি বিভাগে রোগী ছাড়া অন্য কারোর প্রবেশের বিপক্ষে বলেছেন।
৪৬ শতাংশ চিকিৎসক জরুরি বিভাগের চিকিৎসকদের প্রচলিত শিফট বা রোস্টার পদ্ধতি বদলানোর পরামর্শ দিয়েছেন। ৪৪ শতাংশ চিকিৎসক তাদের ওপর হামলার পেছনে একা দায়িত্ব পালনকে কারণ মনে করছেন। আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণের পরামর্শ দিয়েছেন ৩৯ শতাংশ চিকিৎসক। ৩০ শতাংশ চিকিৎসক হাসপাতালে অবৈধ অর্থের লেনদেন বন্ধের কথা বলেছেন।
মামলা হতে পারে, হামলা নয়: ডা. নাজিরুম মুবিন বলেন, দেশে চিকিৎসকদের ওপর হামলা প্রতিরোধ ব্যবস্থা অপ্রতুল। ২০১২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইনের চারবার খসড়া হয়েছে। এখন যে আইনের খসড়া হচ্ছে, তাতেও চিকিৎসকদের নিরাপত্তার ধারাগুলো অপর্যাপ্ত।
তিনি বলেন, ‘চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জামাদি দিতে হবে। সরকারি হাসপাতালে ওষুধ না থাকা, মেশিন নষ্ট হওয়ার দায়ভার চিকিৎসকদের নিতে হচ্ছে। এসব সীমাবদ্ধতা দূর করতে হবে। চিকিৎসকদের ওপর হামলার কোনো যৌক্তিকতা নেই, মামলার যৌক্তিকতা আছে। রোগী বা রোগীর লোকজন চিকিৎসায় অবহেলা বা ভুল চিকিৎসার বিচার চাইতে পারেন, কিন্তু নিজে বিচার করতে পারেন না।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন