মনীষীদের উক্তি ‘স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন’। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশের জনতা দ্বিতীয় বার স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যারা সমন্বয়ক হিসেবে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে হাসিনার দানবীয় বাহিনীকে মোকাবিলা করেছেন তারা দেশের সূর্য সন্তান। আবু সাঈদ, মুগ্ধরা ইতিহাসের পাতায় মহাবীর হিসেবে বেঁচে থাকবেন। ১৯৫২, ১৯৭১, ২০২৪-এর সূর্য সন্তানরা ইতিহাসের একই কাতারে থাকবেন। এ যুগের ঘসেটি বেগম (দিল্লির নাচের পুতুল হাসিনা) পালানোর পর ভারত একের পর ষড়যন্ত্রের মিশাইল বাংলাদেশে ছুঁড়েছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার, রাজনৈতিক দল, ছাত্রজনতা মিলে সে ষড়যন্ত্রের মিশাইল (প্রতিবিপ্লব) ঠেকিয়ে দিয়েছে। এখনো ভারত সংখ্যালঘু নির্যাতনের ফেইক ইস্যুতে বাংলাদেশ বিরোধী ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। ‘ইসকন’ বিষফোঁড়ায় জন্ম দিয়েছে। দাদাদের ঘরে আশ্রয় নেয়া খুনি হাসিনাও বসে নেই। যদিও এরই মধ্যে হিন্দুত্ববাদী ভারতের আগ্রাসন ও দানব হাসিনার বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠেছে। ড. ইউনূস গঠিত কয়েকটি সংস্কার কমিশন দ্রুত গতিতে কাজ করছে। নির্বাচন কমিশন গঠন হয়েছে এবং মার্চের মধ্যেই পূর্ণাঙ্গ ভোটার তালিকা প্রকাশের পর নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা হবে। ড. ইউনূসের ভাষায় দেশে নির্বাচনের ট্রেন লাইনে উঠেছে। তারপরও কোথায় যেন একটা অস্বস্তি। সোস্যাল মিডিয়ায় এ নিয়ে বিতর্ক চলছে। নেটিজেনরা প্রতিবাদ করছেন, নানান মন্তব্য-বক্তব্য দিচ্ছেন। প্রশ্ন হচ্ছে আমরা স্বাধীনতা রক্ষা করতে পারবো তো?
দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জনের পরও অস্বস্তির একটি কারণ এখনো প্রশাসনে হাসিনার অলিগার্ক আমলারা রয়ে গেছেন। অন্যটি সরকারের ভিতরে যেন প্যারালাল সরকার গড়ে উঠেছে। কেউ কেউ আশঙ্কা করেছেন দেশ কি ’৭১ প্রথম স্বাধীনতা অর্জনের পর ’৭২ সালের পরিণতির দিকে ফিরে যাচ্ছে? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই লিখেছেন, প্রথম স্বাধীনতা অর্জনের পর ’৭২ সালে মুজিব বাহিনী যে ভাবে প্রশাসনযন্ত্রে ছড়ি ঘুরিয়েছে; সচিবালয় থেকে শুরু করে জেলা-মহুকুমা এমনকি অধিদফতর, পরিদফতর, কর্পোরেশন, ব্যাংক-বিমা অফিসের কর্মকর্তারা মুজিব বাহিনীর নেতা-সমন্বয়করা যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। সরকারি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সব সময় থাকতেন আতঙ্কে। মুজিব বাহিনীর সদস্যদের ইচ্ছার বাইরে ‘প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত’ দূরের কথা কিছুই করতে পারতেন না ডিসি-এসপিরা। অভিযোগ উঠেছে ’৭২-এর মতোই একই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের শাসনামলে। অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু কিছু উপদেষ্টার মতিগতি ও কর্মদক্ষতা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ড. মুহাম্মদ ইউনূস শক্তহাতে দেশের হাল ধরেছেন। ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজন সমন্বয়ককে সরকারে অন্তর্ভুক্তি করেছেন। তারপরও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কিছু সমন্বয়ক প্রশাসনে ছড়ি ঘুড়াচ্ছেন। এতে করে সরকারের ভিতরে যেন প্যারালাল সরকার গড়ে উঠেছে। হাসপাতাল, ব্যাংক-বিমা, কর্পোরেশন থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ঘুরে এবং কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র দেখা গেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কের পরিচয় দিয়ে ডিসি-এসপি অফিসসহ প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে প্রভাব খাটানো হচ্ছে। কেউ কেউ ডিসি এসপি অফিসেও ‘সমন্বয়ক’ প্রভাব খাটিয়ে নিজেদের ইচ্ছামতো প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করছেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের যাত্রা শুরুর পরপরই আমলাদের রদবদল, প্রমোশন, বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া, জেলা প্রশাসক নিয়োগ নিয়ে প্রথম সমন্বয়কদের বিরুদ্ধে ‘নিয়োগ বদলি বাণিজ্যের’ অভিযোগ উঠে। একজন ডিসি নিয়োগে ৩ থেকে ৫ কোটি টাকা ছাত্র সমন্বয়করা নিচ্ছে এমন অভিযোগে তোলপাড় শুরু হয়। ওই ঘটনা তদন্তে তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়। এখনো অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। প্রশাসনে কর্মরতদের অনেকেই জানিয়েছেন তারা উপদেষ্টাদের চেয়ে ছাত্র সমন্বয়কদের ভয়ে আতঙ্কিত থাকেন। ছাত্র সমন্বয়ক কোনো অফিসে গিয়ে কর্মকর্তাকে কোনো নির্দেশনা দিলে তা দ্রুত কার্যকর করতে হচ্ছে। এমনকি হাসপাতালে রোগী ভর্তি থেকে শুরু করে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মাদরাসায় কমিটি গঠন, নিয়োগ-বদলি, বরখাস্তসহ বিভিন্ন সিদ্ধান্তে ছাত্র সমন্বয়কদের কথা মতো করতে হচ্ছে।
১৯৭২ সালের দিকে তাকালে কি দেখি? ’৭১-এর ২৫ মার্চ কালো রাতে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান বাহিনীর হাতে ইচ্ছে করেই ধরা দেন। দেশের মানুষকে পাক বাহিনীর বন্দুকের নালের ডগায় ফেলে আওয়ামী লীগের নেতারা পালিয়ে ভারতে চলে যান। জিয়াউর রহমান বিদ্রোহ করে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার পর দেশের ছাত্র-জনতা, কৃষক শ্রমিক, ক্ষেতমজুর মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। মুজিব বাহিনী মাঠে নেমে ছিল কার্যত মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে অক্টোবর মাসে। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব যাতে শেখ মুজিবুর রহমানের হাতছাড়া না হয় সে জন্যই ইন্দিরা গান্ধীর পরিকল্পনায় মুজিব বাহিনী গঠন করা হয়। ওই মুজিব বাহিনী অক্টোবর মাসে মুক্তিযুদ্ধে নামে এবং তারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উপর আক্রমণের চেয়ে মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে বেশি অপারেশন করেন। স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষমতা গ্রহণ করলে দেশের প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা কোণঠাসা হয়ে পড়েন এবং মুজিব বাহিনীর সদস্যরাই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রশাসনে দাপিয়ে বেড়ান। তারাই মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ে প্রশাসনের বিভিন্ন শাখায় তদবির বাণিজ্য করেন। প্রশাসনের কর্মকর্তা কর্মচারীদের উপর ছড়ি ঘোড়ানোয় শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন সরকারের দায়িত্বশীলরা অসহায় হয়ে পড়ে। বাধ্য হয়েই শেখ মুজিবুর রহমান ‘মুজিব বাহিনী’র বিগড়ে যাওয়া তরুণদের উদ্দেশে কঠোর হন। তিনি বিগড়ে যাওয়া তরুণদের ‘সাইজ’ করতে খান আতাউর রহমানকে দিয়ে ‘আবার তোরা মানুষ হ’ সিনেমা নির্মাণ করে সারাদেশে ছড়িয়ে দেন। তরুণদের সিনেমাটি দেখার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন।
খোঁজ-খবর নিয়ে এবং অনুসন্ধান করে দেখা গেছে বর্তমানের চিত্রটা সেই ’৭২ সালের মতোই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের কারো কারো বিরুদ্ধে নিয়োগ বদলি বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। ওই সময় মুজিব বাহিনীর সদস্যরা ‘মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ে’ প্রশাসনে নিয়োগ-বদলি বাণিজ্যের নামে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন। দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জনের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কিছু প্রকৃত সমন্বয়কের বিরুদ্ধে প্রভাব খাটানোর অভিযোগ রয়েছে ঠিকই; তবে মুজিব বাহিনীর ‘মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়’-এর মতোই একটি রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের নেতারা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘সমন্বয়ক পরিচয়ে’ প্রশাসনের বিভিন্ন সেক্টরে ছড়ি ঘোড়াচ্ছেন। নিজেদের ‘সংগঠন নিষিদ্ধ’ থাকায় তারা আন্দোলনের শেষ দিকে ছাত্র আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। হঠাৎ গজিয়ে উঠা ওই সমন্বয়করা গতকালও ফেনিকে দেশের মাদরাসা শিক্ষক কর্মচারীদের সমন্বয়ে গঠিত অরাজনৈতিক একটি সংগঠনের আয়োজিত অনুষ্ঠান করতে দেয়নি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, একটি রাজনৈতিক দলের সহযোগী ছাত্র সংগঠনের নেতারা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ভিতরে প্রবেশ করে সমন্বয়ক পরিচয়ে ডিসির উপর প্রভাব খাটিয়ে ওই সংগঠনের অনুষ্ঠানের অনুমতি ঠেকিয়ে দেন। এর আগে অবশ্য বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজন সমন্বয়ক ভুয়া সমন্বয়কের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে সমন্বয়কের পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন এমন খবর গণমাধ্যমে এসেছে।
প্রশ্ন হচ্ছে ছাত্র সমন্বয়করা কী সরকারের অংশ? তারা কী মুজিব বাহিনীর মতো প্যারালাল সরকার গঠন করতে চাচ্ছেন? বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিনজন সমন্বয়ককে অন্তর্বর্তী সরকারে উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তারা বেশ সাফল্য দেখাচ্ছেন। এ ছাড়াও প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে কয়েকজন সমন্বয়ককে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়েছে। অন্য ছাত্র সমন্বয়কদের কেনো কিছু প্রয়োজন এবং প্রত্যাশা থাকলে তারা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের মধ্য থেকে সরকারে থাকা উপদেষ্টাদের মাধ্যমে করতে পারেন। কিন্তু ’৭২-এর মুজিব বাহিনীর মতো ‘মুক্তিযোদ্ধার প্রভাব খাটিয়ে’ প্রশাসনে ছাত্র সমন্বয়কের প্রভাব খাটানো কাম্য নয়। তাহলে কি ‘আবার তোরা মানুষ হ’-এর মতো সিনেমা নির্মাণ করতে হবে?
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন