Image description
এশিয়া এনার্জির হয়ে মাঠে এশিয়াটিক!
বহুজাতিক এশিয়া এনার্জি এদেশে তাদের কার্যসিদ্ধির জন্য জনমত গঠনের দায়িত্ব দিয়েছে দেশীয় একটি প্রতিষ্ঠানকে। প্রতিষ্ঠানটি হচ্ছে সুপরিচিত এশিয়াটিক মার্কেটিং কমিউনিকেশন্স লিমিটেড। এশিয়াটিক বাংলাদেশে কাজ করছে ৪৬ বছর ধরে। এটি দেশের অন্যতম বিপণন, যোগাযোগ ও বিজ্ঞাপনী সংস্থা। এর আগে পেপসি, রবি, এয়ারটেল, গ্রামীণফোন, লাক্স, সানসিল্ক, বিএটিবি, নকিয়া, এইচএসবিসি, হুইল, রেডকাউ, ডানো, আইসিসি এর সঙ্গে বাণিজ্যিক এবং বাংলাদেশ সরকার, ইউনিসেফ, ব্র্যাক, সেভ দ্য চিলড্রেন, কেয়ার, টিআইবি, এসএমসি, ইউএনডিপি, বিসিসিপিসহ আরো অনেক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এশিয়াটিক অনেকগুলো জনপ্রিয় সামাজিক সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। এবার তারা যুক্ত হলো বহুজাতিক কোম্পানি গ্লোবাল কোল ম্যানেজমেন্ট (জিসিএম), এদেশে এশিয়া এনার্জি নামে পরিচিত বিতর্কিত এই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে। জিসিএম রিসোর্সেস পিএলসি’র সিইও গ্যারি লাই গত ৯ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে এশিয়াটিক মার্কেটিং এর সহযোগী প্রতিষ্ঠান ফোরথট পিআর (ঋড়ৎবঃযড়ঁমযঃ চজ) কে “বিবিধ তথ্য বিনিময়ের মাধ্যমে সার্বিক গণমাধ্যম সম্পর্কিত কার্যক্রম পরিচালনার” দায়িত্ব দিয়েছে। এর মাধ্যমেই বাংলাদেশে ফুলবাড়ী কয়লাখনিতে উন্মুক্ত খননের পক্ষে জনমত গঠন তথা পাবলিক রিলেশানস (পিআর) তৈরির কাজ করছে এশিয়াটিক মার্কেটিং! বিশেষজ্ঞরা একে একটি এলার্মিং বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করছেন। এশিয়াটিক মার্কেটিং এর সঙ্গে যুক্ত আছেন দেশের খ্যাতনামা কিছু সেলিব্রেটি। জনগণের ওপর যাদের প্রভাব রয়েছে। এছাড়া এশিয়াটিকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান আছে। যেগুলো বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করছে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ও সরকারি বেসরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে এসব প্রতিষ্ঠানের সুসম্পর্ক রয়েছে। এর বাইরে সরাসরি তাদের বেশকিছু মিডিয়া প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যেগুলোর কমবেশি গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে সাধারণ জনগণ ও সুধীমহলে। এশিয়াটিক তাদের এই ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে এশিয়া এনার্জির এই জাতীয় স্বার্থবিরোধী প্রকল্পকে বাস্তবায়নের দিকে নিয়ে যেতে পারে। যাতে করে দেশের বিস্তীর্ণ এলাকার জনগণ পড়বে গভীর সঙ্কটে। বর্তমানে এশিয়াটিকের সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে এশিয়াটিক এমসিএল, এশিয়াটিক টকিংপয়েন্ট, মিডিয়া এজেন্সি ম্যাক্সাস, মাইন্ডশেয়ার, মিডিয়াএজ-সিআইএ, ধ্বনিচিত্র লি:, স্টুডিও টুয়েন্টি মাইলস, নয়নতারা কমিউনিকেশনস, এশিয়াটিক ইভেন্টস লি:, গবেষণা সংস্থা এমআরসিমোড, মৈত্রী প্রিন্টার্স, জনসংযোগ প্রতিষ্ঠান ফোরথট পিআর এবং এফএম রেডিও চ্যানেল রেডিও স্বাধীন। এছাড়া এশিয়াটিকের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে রয়েছেন আলী যাকের, সারা যাকের, ইরেশ যাকের ও প্রখ্যাত অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর। আসাদুজ্জামান নূর একজন সাংসদ এবং তিনি স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল দেশ টিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালক। এই মাপের লোকজন এবং প্রতিষ্ঠানের পক্ষে জনগণকে যা কিছু বুঝিয়ে দেয়াটা সম্ভব হতে পারে। তাছাড়া এশিয়াটিকের কাজই হচ্ছে এরকম। তাদের ৪৬ বছরের অভিজ্ঞতাই মার্কেটিংয়ের। যার মাধ্যমে জনগণকে দিয়ে পণ্য গলাধঃকরণ করানো হয়। এশিয়াটিকের এসব যোগ্যতাকে এখন কাজে লাগাচ্ছে এশিয়া এনার্জি। ফুলবাড়ীর কয়লাখনি উন্নয়নের কাজ পেতে তারা সব ধরনের সম্ভাব্যতাকে কাজে লাগাচ্ছে। অথচ উন্মুক্ত কয়লাখনির বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন বজায় আছে। এ আন্দোলন পরিচালনা করছে তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি। এ কমিটির নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলনের ওপর ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট তৎকালীন বিডিআর গুলি চালালে তিনজন নিহত হয়। এরপর দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে এক সমাবেশে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা প্রতিশ্রুতি দেন, যদি তার দল সরকার গঠন করে তাহলে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা হবে না। প্রধানমন্ত্রীর সেদিনের সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষার কোনো নমুনা এখন আর দেখা যাচ্ছে না। ফুলবাড়ী কয়লাখনি উন্নয়ন প্রকল্প হাতে পেতে এশিয়া এনার্জির মূল প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল কোল ম্যানেজমেন্ট (জিসিএম) তৎপরতা চালিয়েই যাচ্ছে। কাজ না পেলেও বাংলাদেশের কয়লা নিয়ে লন্ডনে তারা শেয়ারবাজারে ব্যবসা চালাচ্ছে। সরকার পক্ষের কেউ তাদের বাধা দিচ্ছে না। বরং বেশ কিছুদিন ধরে কোম্পানিটি এ নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক দেন দরবার করছে। এমনকি প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তারা নানারকম লোভনীয় প্রস্তাবও দিয়ে চলেছে। নামে-বেনামে বিভিন্ন লিফলেট প্রচার করছে এশিয়া এনার্জি। কিছুদিন আগে সচেতন এলাকাবাসীর ব্যানারে তারা একটি লিফলেট প্রচার করে যাতে বলা হয়, ‘এলাকাবাসী এই খনির পক্ষে।’ গত ৯ জুলাই জিসিএম রিসোর্সেস-এর কর্মকর্তাদের সঙ্গে জ্বালানি সচিব মেজবাহ উদ্দীন একটি বৈঠক করেন। এছাড়া জিসিএম প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই ইলাহী চৌধুরীর কাছে গত ৩০ আগস্ট একটি চিঠি দেয়। গত ১৮ সেপ্টেম্বর জ্বালানি উপদেষ্টার সঙ্গে জিসিএমের চেয়ারম্যান জেরার্ড হোলডেনের একটি বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয় বলে জানা গেছে। এশিয়া এনার্জি বিভিন্ন গণমাধ্যমকেও তাদের পক্ষে টেনেছে। এগুলোর মধ্য দিয়ে তারা উন্মুক্ত খনির স্বপক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এশিয়া এনার্জি ফুলবাড়ী নিয়ে আগের চেয়ে বেশি তৎপর হয়েছে। তারা অনেককে পক্ষে টানছে। এর ভিত্তিতেই সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে নড়াচড়া শুরু হয়েছে। সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম। এক সার্কুলার দিয়ে তারা ফুলবাড়ী এলাকায় এশিয়া এনার্জির জরিপ কাজে সহযোগিতার জন্য স্থানীয় সব প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছে। সেখানে আবার জনগণ প্রতিরোধও গড়ে তুলেছে। গণপ্রতিরোধের সামনে টিকতে না পেরে পুলিশ পিছু হটেছে। কিন্তু এশিয়া এনার্জি দমেনি। সরকারও জনরায়ের পথে হাঁটেনি। ভেতরে ভেতরে এশিয়া এনার্জির সঙ্গে সরকারের নতুন চুক্তি সম্পাদনের কাজও এ লক্ষ্যে এগিয়ে নেয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে বিভিন্ন সূত্র থেকে। খবর বেরিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে এশিয়া এনার্জির ফাইল। বাকি সব কাজ শেষ। কিছুদিন আগে জানা গেছে, ফুলবাড়ী কয়লাখনি উন্নয়নে এশিয়া এনার্জি সরকারকে নতুন প্রস্তাব দিয়েছে। নতুন এ প্রস্তাবে ৬ শতাংশ রয়্যালটি ছাড়াও ১০ শতাংশ ‘ইকুইটি শেয়ার’ প্রদান এবং নিজস্ব বিনিয়োগে খনিমুখে দুই হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের কথা বলা হয়েছে। বিদ্যুৎ সঙ্কটের কথা বিবেচনা করে নতুন প্রস্তাবে সরকারকে বিদ্যুৎ কেন্দ্র করার টোপ দিয়েছে এশিয়া এনার্জি। সরকার এখনো সম্মতি না জানালেও কোনো বিরোধিতাও করেনি। সরকার এমনিতেই এশিয়া এনার্জিকে দীর্ঘদিন ধরে সুরক্ষা দিয়ে আসছে। একটি সূত্র জানিয়েছে, এরই ধারাবাহিকতায় সরকার পক্ষ থেকেই এশিয়া এনার্জিকে জনমত গঠনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সেই পরামর্শ অনুযায়ী এশিয়াটিকের দ্বারস্থ হয়েছে তারা। এশিয়া এনার্জি এখন চাচ্ছে, বিভিন্ন মিডিয়া ও রাজনৈতিক মহলকে প্রভাবিত করার মাধ্যমে যেন পুরো বিষয়টা সম্পর্কে একটা ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে ওঠে। এশিয়াটিকের কাজের ধারাবাহিকতা থেকে বোঝা যায়, এই কাজে তারা নিজেদের মিডিয়া ডিপার্টমেন্টের পাশাপাশি স্থানীয় মিডিয়া এজেন্সি বা পাবলিক রিলেশন কোম্পানিকে ভাড়া করবে। এদের মাধ্যমে বিভিন্ন মিডিয়ায় সাক্ষাৎকার, বিশ্লেষণ, পজেটিভ খবর প্রকাশ করবে। আর ক্ষমতাবানদের সাথে বিভিন্ন যোগাযোগ ও প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে এই মহা ক্ষতিকর প্রকল্পকেও দেশের উন্নয়নের জন্য মহা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে হাজির করবে। অনেকেই এখানে অপরাধের কিছু দেখেন না। তারা মনে করেন, একটি কোম্পানি তার নিজের বিনিয়োগে লাভবান হতে নিজের পক্ষে প্রচার চালাতেই পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে বিষয়টি ভিন্ন বলে মনে করছেন জাতীয় সম্পদ রক্ষার আন্দোলনকারী কর্মী ও সংগঠকরা। প্রকৌশলী কল্লোল মোস্তফা এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘পিআর এজেন্সি যখন গণমাধ্যমকে ম্যানেজ করে, যখন গণমাধ্যমে কোন ধ্বংসাত্মক প্রকল্পকে উন্নয়ন প্রকল্প হিসেবে চালানোর জন্য সাক্ষাৎকার, মতামত, বিশ্লেষণ ইত্যাদি প্রকাশ করে কিংবা অন্য কোনোভাবে, পরোক্ষ প্রচারণা চালায়- তখন সেগুলোকে বিশেষজ্ঞ মতামত, বিশ্লেষণ, ওপিনিয়ন হিসেবে চালায়। আবার সেলিব্রেটি ইমেজ ব্যবহার করে জনগণের মতামত প্রভাবিত করে। কিন্তু এগুলো যে নানানভাবে কোম্পানি স্পনসরড তা গোপন করে। কারণ এটা প্রকাশ পেলে তো এগুলোর পিআর ভ্যালু বলে কিছু থাকবে না। ফলে জনগণের পক্ষে বোঝা মুশকিল হয়ে যায় কোনটা বিশেষজ্ঞ মতামত আর কোনটা কোম্পানির পয়সা খাওয়া মতামত। এশিয়াটিকের এখানে জড়ানোতে আমরা এই আশঙ্কাটাই করছি। এশিয়া এনার্জির পয়সা খাওয়া লোকজন এশিয়া এনার্জির পক্ষে বক্তব্য দিবে। এশিয়াটিক এটার প্রচার চালাবে ‘বিশেষজ্ঞ মত’ হিসেবে। এটা ভয়ঙ্কর এক আঘাত। জনগণকে এখনই সচেতন হতে হবে।’’ অনুসন্ধানে জানা গেছে, এশিয়াটিকের সঙ্গে চুক্তির আগেই এশিয়া এনার্জি তাদের দিয়ে কিছু কাজ করিয়েছে। যার অংশ হিসেবে এশিয়াটিকের ব্যবস্থাপনাতেই ঢাকায় আনা হয়েছিল ভারতীয় খনি বিশেষজ্ঞ অজয় কুমার ঘোষকে। তিনি সোনারগাও হোটেলে এক জমকালো ককটেল পার্টির আগের আলোচনায় খোলামেলাভাবে বলেন যে ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত খনি করা সম্ভব। যদিও কিভাবে সম্ভব তা বলেননি। ধারণা করা হচ্ছে, এভাবেই উন্মুক্ত খনির পক্ষে জনমত গঠনের কাজ করবে এশিয়াটিক। উল্লেখ্য, উন্মুক্ত খনির ভয়াবহতার কথা এর অনেক আগেই বিশ্লেষকরা বিভিন্ন লেখায় তুলে ধরেছেন। সর্বশেষ ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১১ সরকার বাংলাদেশের কয়লা খনিসমূহের ভূতাত্ত্বিক ও পরিবেশগত অবস্থা, কয়লা উত্তোলনের বিভিন্ন দিক এবং বাংলাদেশের নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে উন্মুক্ত খনির ঝুঁকি ও সম্ভাবনা ইত্যাদি বিষয়ে বিশ্লেষণ করে মতামত প্রদানের জন্য একটি কমিটি গঠন করে। কমিটির সদস্যরা মত দেয়, ‘বাংলাদেশের কয়লা মজুদের ক্ষেত্রে এটা ঠিক যে উন্মুক্ত খনি কয়লা উত্তোলনের হার অনেক বৃদ্ধি করে বিনিয়োগকারীদের জন্য আকর্ষণীয় হতে পারে, কিন্তু পরিবেশের বিপর্যয়ের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক ও প্রতিবেশগত ক্ষতি বর্ধিত কয়লা উত্তোলনের থেকে প্রাপ্ত সুবিধার তুলনায় অনেক বেশি হতে পারে। যদিও বৈজ্ঞানিক যুক্তিতর্কে এটা বলা সম্ভব যে, স্ট্রিপ মাইনিংয়ে কয়েক বছর পরেই ভূমি আবার পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব, কিন্তু বাস্তবে মাটির উপরের স্তর সরিয়ে ফেলার পর জমির উর্বরতা পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব নাও হতে পারে। ...উন্মুক্ত খনির ক্ষতি এতো বেশি যে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।’ (পৃষ্ঠা ১৫) রিপোর্টে আরও বলা হয়, ‘উন্মুক্ত খনির খরচ কম কিন্তু পরিবেশের জন্য তা খুবই ক্ষতিকর। এতে অতিরিক্ত বর্জ্য ফেলার জন্য বিশাল জায়গার প্রয়োজন হয়। হিসাব অনুযায়ী অতিরিক্ত বর্জ্য ও কয়লার অনুপাত হচ্ছে ২৫:১। অর্থাৎ ১ মে. টন কয়লা উত্তোলনের জন্য ২৫ মে. টন সরাতে হবে। এই ভূগর্ভস্থ দ্রব্য যেগুলো প্রধানত দূষিত, তা রাখতে হবে পার্শ্ববর্তী কৃষি জমি জলাশয় ও নদীতীরে। এগুলো যে শুধু আশেপাশের জলাশয়কে দূষিত করবে তাই নয়, তার নিচের দিকের সকল নদী, খাল ও জলাভূমিকে ভয়াবহ মাত্রায় দূষিত করবে। ...বৃষ্টির কারণে অনেক বর্জ্য পানিতে ধুয়ে যাবে এবং তা জমি, জলপ্রবাহ ও নদীকে বিষাক্ত করবে।’ (পৃ. ৪৯) ওই রিপোর্টে কয়লা প্রকল্পের মারাত্মক ঝুঁকি সম্পর্কে কয়েকটি পয়েন্ট উল্লেখ করা হয়েছে : ১. পানি শূন্য করার প্রভাবের মাত্রা ও পরিমাণ পুরোটাই অনিশ্চিত। ২. পানিতে দূষণের মাত্রা পরিবেশগত ভয়াবহ বিপর্যয় আনবে। ৩. ভূগর্ভস্থ পানি তোলার ফলে কোথাও হস্তচালিত নলকূপ কাজ করবে না। তাছাড়া পানি সরবরাহের যে নেটওয়ার্ক আছে তা দূষিত হবার কারণে মানবিক বিপর্যয় ভয়াবহ হবে। ৪. সমগ্র অববাহিকা ভূগর্ভস্থ ও ভূউপরিস্থ পানি দীর্ঘ মেয়াদের দূষণের শিকার হবে। ৫. বিশাল আকারের বর্জ্য মজুদ বোমার মতো অবস্থা তৈরি করবে। ৬. প্রায় দশ লাখ মানুষের পুনর্বাসন জটিলতা সামাজিক অস্থিরতা ও সংঘর্ষের উচ্চ মাত্রার ঝুঁকি তৈরি করবে (পৃ. ৩০) ৭. ৩৮ বছর ধরে প্রতিদিন ৮০ কোটি লিটার ভূগর্ভস্থ পানি প্রত্যাহার করতে হবে (পৃ. ৫২) তেল গ্যাস খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘এশিয়া এনার্জি কয়লাখনি বিষয়ে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ। আর সেই সঙ্গে জালিয়াতি ও মানুষ হত্যার দায়ে অভিযুক্ত। এই কোম্পানি বহিষ্কার এবং উন্মুক্ত খনি নিষিদ্ধসহ ৬ দফা ফুলবাড়ী চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন ছিল বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার। কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার ভণ্ডুল করতে নেমেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এখন নামল এশিয়াটিক। শাসকগোষ্ঠীর রাজনীতিবিদদের তারা কিনে ফেলেছে আগেই। এখন তারকা ইমেজের লোকদের নিয়ে মাঠে নেমেছে। আর এদের পক্ষের মিডিয়াগুলো তো আগে থেকেই সক্রিয়। বিশেষজ্ঞ প্রতিবেদন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিঠি দেয়া, তেল-গ্যাস কমিটির প্রেস কনফারেন্সের খবর ও ফুলবাড়ী বিক্ষোভ নিয়ে প্রথম সারির মিডিয়াগুলোর মধ্যে কয়েকটির লেখার ধরন ও সেগুলো প্রকাশের জায়গা নির্ধারণ দেখেই বোঝা যায় তারা কার সেবা করছে। কিছু বিতর্কিত বিষয়কে রং বদলে পাঠকদের কাছে তুলে ধরা হচ্ছে যেন জনরোষ এড়ানো যায়। এশিয়া এনার্জি উন্মুক্ত পদ্ধতিতে খনি করতে সম্ভাব্য সব কিছুই করছে। এশিয়া এনার্জির সঙ্গে সরকারের কোনো চুক্তি নেই। তবু সরকার তাদের তৎপরতা চালাতে দিচ্ছে। এ থেকে স্পষ্ট বর্তমান সরকার জনগণের স্বার্থের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে।’’ এরকম একটি বিতর্কিত বিষয়ের সঙ্গে এশিয়াটিকের যুক্ত হওয়াটাকে অনেকেই ভালো চোখে দেখছেন না। এর মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে অর্জন করা সুনামকে তারা ধূলিসাৎ করে দিতে যাচ্ছেন বলে অনেকের ধারণা। অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, ‘মার্কেটিং বিভাগটাই করা হয়েছে যা খুশী তা জনগণকে গেলানোর জন্য। পুরো ডাহা একটা মিথ্যা কথাকে যদি খুব আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করা যায় মিথ্যা জেনেও মানুষ তার প্রতি আকৃষ্ট হয়। বর্তমান টিভি বিজ্ঞাপনগুলোতে এটা স্পষ্ট। একজন একটা বিস্কুট খেয়ে গাড়ি উঁচু করে ফেলছে। পুরো ভুয়া একটা জিনিস। কিন্তু ওই বিস্কুট বিক্রি হচ্ছে। বিজ্ঞাপন জিনিসটাই হচ্ছে মানুষকে অবচেতনে বোকা বানানোর একটা প্রক্রিয়া। যোগ্য একটি বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠান চাইলে এমনভাবে সব বিজ্ঞাপন তৈরি করতে পারে যাতে মানুষ নিজের অগোচরেই নিজের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নেবে। এজন্যই আমি মনে করি এশিয়াটিক এখানে যুক্ত হওয়াটা এলার্মিং। অন্য সব পণ্যের সঙ্গে এই কাজের তুলনা করে তারা ঠিক করেনি। এটা জাতীয় স্বার্থ, লাখো মানুষের জীবন মরণের প্রশ্ন। টাকার জন্য প্রতিষ্ঠানটি নিজেদের ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।’ বাংলাদেশে এখন যে সংস্কৃতি চলছে তাতে ব্যাপক জনগোষ্ঠী কিছু অন্যায় মেনে নিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। ছোটখাটো দুর্নীতির খবর এখন মিডিয়াতেও আসে না। বিবেকের কাণ্ডারী বুদ্ধিজীবী, কবি-সাহিত্যিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বিক্রি হয়ে যাচ্ছেন টাকার হিসেবে। নিজের ঢোল নিজে বাজানোটাকে এখন দেখা হয় যোগ্যতা হিসেবে। এসবেরই সুযোগ নিচ্ছে বিদেশি ফড়িয়া ও তাদের এদেশের এজেন্টরা। এতে কিছু লোকের লাভ হচ্ছে। কিন্তু ক্ষতি হচ্ছে বিপুল জনগোষ্ঠীর। ফুলবাড়ীর জনগণ এশিয়া এনার্জির বিপক্ষে তাদের রায় দিয়ে আসছে। তারা উন্মুক্ত খনির বিরুদ্ধে। স্বার্থাণ্বেষী একটি মহল জনগণের ভালো খারাপের দিকে না তাকিয়ে ফুলবাড়ীর প্রাণ-প্রকৃতি-মানুষের ভাবনা বাদ দিয়ে এশিয়া এনার্জির লাভের ব্যবস্থা করে দিতে উদ্যোগী হয়েছে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য। রাষ্ট্র এখানে সঠিক ভূমিকা নিতে পারছে না। সরকারের উচিত ছিল জনরায়ের পক্ষে হাঁটা। বিপুল জনগণের স্বার্থ নিশ্চিত করা। দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোরও দরকার ছিল দেশের স্বার্থের পক্ষে দাঁড়ানো। কিন্তু তার কিছুই হচ্ছে না। রক্তের বিনিময়ে ফুলবাড়ীতে যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে তা বাস্তবায়ন না হলে দেশ পড়তে পারে গভীর সঙ্কটে। সরকারকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। প্রতিক্রিয়া অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী শিক্ষাবিদ এশিয়া এনার্জি একটি বিতর্কিত প্রতিষ্ঠান। তাদের যে প্রস্তাব, উন্মুক্ত পদ্ধতিতে খনি করা, তা তো সে এলাকার মানুষ চায় না। বিভিন্ন পর্যায় থেকে এর বিরুদ্ধে বলা হয়েছে। আমাদের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন এটা দেশের জন্য ক্ষতিকর হবে। এখানে এশিয়াটিক গ্রুপের যুক্ত হওয়াটা দুঃসংবাদ। দেশীয় একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান এভাবে দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে যাবে, এটা আমি মানতে পারছি না। আশা করি তারা তাদের ভুল বুঝবে এবং সরে আসবে। সৈয়দ আবুল মকসুদ গবেষক, কলামিস্ট এশিয়া এনার্জির সঙ্গে বাংলাদেশের যে কোনো মিডিয়া ব্যবসায়িক বা অন্য যে কোনো কারণে প্রচারের জন্য চুক্তি করলে আমি তার নিন্দা জানাই। এশিয়া এনার্জির কার্যক্রম যেহেতু আমাদের জতীয় স্বার্থের পরিপন্থী সুতরাং তার সঙ্গে যারাই ব্যবসায়িক স্বার্থে চুক্তিবদ্ধ হবে তারাই জাতীয় স্বার্থবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত হবে। কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ চেয়ারম্যান পিকেএসএফ এশিয়া এনার্জি নিয়ে বহুমুখী আন্দোলন হয়েছে। দেশের স্বনামধন্য কোনো প্রতিষ্ঠান এর সঙ্গে যুক্ত হতে পারে না। তারা ভুল করছে। রাশেদ খান মেনন সংসদ সদস্য, সভাপাতি, ওয়ার্কার্স পার্টি এশিয়া এনার্জির পক্ষে এশিয়াটিকের এই কাজ দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে যাবে। দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে যে কাজ করুক, এটা ব্যবসা বা যাই হোক, প্রতিহত করা দরকার। পিয়াস করিম অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় এটা খুবই নেতিবাচক একটা ঘটনা। এশিয়াটিকের ব্যবসা করার অধিকার অবশ্যই আছে। কিন্তু সামাজিক দায়বদ্ধতাও তো আছে। আলী যাকের, সারা যাকের, আসাদুজ্জামান নূর সাহেবরা দেশপ্রেমিক মানুষ হিসেবে সর্বত্র পরিচিত। তারা যদি এরকম জনবিরোধী কাজে যুক্ত হন এটা মেনে নেয়া যায় না। এম এ মতিন সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন এশিয়া এনার্জির মতো বিতর্কিত প্রতিষ্ঠান এদেশে কমই আছে। এদেশ থেকে সম্পদ লুটের সঙ্গে তাদের নাম জড়িত। জনগণ এদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এদের সঙ্গে এশিয়াটিক? এশিয়াটিকের কর্তব্যক্তিরা সবাই গণমুখী চরিত্র হিসেবে পরিচিত। তারা কিভাবে এমন চুক্তিতে গেল যা জাতীয় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে, এটা আমি মানতে পারছি না।