ভয়ংকর হয়ে উঠছে রাতের ঢাকা। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি এবং বড় সড়ক দুর্ঘটনা। রাজপথে ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে প্রাণ যাচ্ছে নিরীহ মানুষের। সাম্প্রতিক সময়ে রাতের যানবাহনই হয়ে উঠছে যেন সাক্ষাৎ যমদূত। পুলিশ প্রশাসনও এ নিয়ে উদ্বিগ্ন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে ডিএমপি ঢাকার রাস্তা থেকে চেকপোস্ট উঠিয়ে নেওয়ায় বেড়েছে অপরাধীদের দৌরাত্ম্য। তবে রাতে ঢাকার রাস্তায় একের পর এক নৃশংস মৃত্যুর দৃশ্য দেখতে দেখতে যানবাহনের চালক ও আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের অনুভূতিও ভোঁতা হয়ে গেছে বলে মনে করেন বিশিষ্টজনরা। তারা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের ভূমিকা নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
অপরাধ-বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের দায়িত্বে অবহেলাই এর বড় কারণ। বিশেষ করে র্যাব-পুলিশ অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ছাড়াও নানা কাজে ব্যস্ত হয়ে যাওয়ায় এসব ক্ষেত্রে দৃষ্টিপাত কমে এসেছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, আগস্ট মাসে সাম্প্রতিক সময়ে ডিএমপি কর্তৃপক্ষ ঢাকার রাস্তা থেকে চেকপোস্ট উঠিয়ে নেওয়ার পর থেকেই বেড়েছে ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য। অলিগলিতে বেড়েছে চুরি, ডাকাতিসহ নানা অপরাধের ঘটনা। এর বাইরে শীতে করোনা আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে- আগে থেকে এমন স্বাস্থ্যবার্তার কারণে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের মধ্যে কিছুটা হলেও শিথিলতা বেড়েছে। এক সপ্তাহ ধরে রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক সরেজমিন পরিদর্শন করে রাত ১০টার পর থেকে বেশির ভাগ সড়কে ট্রাফিক পুলিশের উপস্থিতি খুব কমই চোখে পড়েছে। টহলের দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদেরও দেখা গেছে তীব্র কুয়াশায় মধ্যে জবুথবু হয়ে গাড়িতেই বসে থাকতে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কয়েকটা মাস ধরে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নিষ্ক্রিয়তা দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে সিনহা হত্যাকান্ডের পরই এ বিষয়টি উঠে এসেছে। অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ কাজে তাদের ব্যস্ততা বেড়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন সেক্টরে দুর্বৃত্তরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার কারণে এমনটা ঘটছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তবে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম) কৃষ্ণপদ রায় বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘করোনায় কৌশলগত কারণেই স্থায়ী চেকপোস্টের বিষয়ে সিদ্ধান্তে পরিবর্তন আনা হয়েছিল। তবে করোনায় অর্থনৈতিক মন্দার কারণে অপরাধ কিছুটা বাড়লেও আমরা তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছি। প্রায় প্রতিটি অপরাধেরই দ্রুততর সময়ে রহস্য উদ্্ঘাটন এবং অপরাধী গ্রেফতার হয়েছে। দুর্ঘটনার কারণ বিবেচনায় ট্রাফিক পুলিশের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। তবে গাড়িচালকদেরও আরও সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
ভাবাচ্ছে যেসব ঘটনা : ২৩ জানুয়ারি হাই কোর্টের সামনে অজ্ঞাত ছিনতাইকারীদের হাতে নৃশংসভাবে খুন হন শাহবাগ থানা জাসদের সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সমবায় বিষয়ক সম্পাদক হামিদুল ইসলাম (৫৮)। শুক্রবার দিবাগত রাত পৌনে ৩টায় বনানী সৈনিক ক্লাব ফুটওভার ব্রিজের নিচে বেপরোয়া গাড়ির চাপায় অজ্ঞাতপরিচয় এক ব্যক্তির নির্মম মৃত্যু হয়েছে। পরে তাকে বনানী থানা পুলিশ উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে নিয়ে যায়। ৯ ডিসেম্বর বুধবার গভীর রাতে উত্তরার আবদুল্লাহপুরে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে জিসান হাবিব (১৮) নামে সদ্য এসএসসি পাস করা এক শিক্ষার্থী নিহত হয়। এ ঘটনায় আহত হয়েছে জিসানের মামাতো ভাই রুহুল আমিন (১৭)। একই রাতে কলাবাগান বাসস্ট্যান্ডে জয়ই মামুন (৪০) নামে এক ব্যক্তিকে অসুস্থ অবস্থায় উদ্ধারের পর তার মৃত্যু হয়েছে। তিনি অচেতন অবস্থায় কলাবাগান বাসস্ট্যান্ডে পড়ে ছিলেন। পরে পুলিশ দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে এলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
ডাকাতি, ছিনতাই ও চুরি প্রতিরোধে গোয়েন্দা বিভাগ বিশেষ অভিযান চালিয়ে ৩৪ জনকে গ্রেফতারের পর বৃহস্পতিবার ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) এ কে এম হাফিজ আক্তারের ব্রিফিং স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছিল, চুরি-ডাকাতি নিয়ে কতটা উদ্বিগ্ন ডিএমপি কর্তৃপক্ষ। তিনি বলেছিলেন, শীতকাল এলে দোকান, বাসাবাড়ি ও মার্কেটে চুরি-ডাকাতি বেড়ে যায়। এটা প্রতিরোধের লক্ষ্যে ডিবির ৩২টি টিম একযোগে রাজধানীতে বিশেষ অভিযান চালায়। সবাই সচেতন হলে এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধ করা যাবে। বিশেষ করে কারও বাসায় নতুন দারোয়ান বা মালি নিয়োগ দিলে, তা যেন নিকটবর্তী থানাকে অবহিত করা হয়। যারা আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান তারা বাসায় সিসি ক্যামেরা স্থাপনের ব্যবস্থা করতে পারেন।
আরও কিছু ঘটনা : ২৮ ডিসেম্বর বিমানবন্দর এলাকায় গভীর রাতে ছিনতাইয়ের পর রাস্তায় ফেলে দেওয়া হয় সবজি ব্যবসায়ী আপন মিয়াকে। ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনি। গুরুতর আহত হন আপন মিয়ার সঙ্গে থাকা আরেক ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম। জানা যায়, পাইকারি সবজি কিনতে কাওলা থেকে কারওয়ান বাজারে যেতে মিনি ট্রাকে উঠেছিলেন তারা। এ ঘটনায় ৬ জানুয়ারি মামলা হলে তদন্তে নামেন গোয়েন্দারা। বেরিয়ে আসে ভয়ংকর সব তথ্য। ভাড়া গাড়িতে ছদ্মবেশে রাতে ব্যবসায়ী ও চাকরিজীবীদের ফাঁদে ফেলে সর্বস্ব কেড়ে নিচ্ছে ডাকাতরা। বিমানবন্দর এলাকার ঘটনায় সরাসরি জড়িত চারজন এবং একই চক্রের আরও দুজনসহ ছয়জনকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান বিভাগ। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার হয় নগদ টাকা, চাকু ও মোবাইল ফোন। গণমাধ্যমে এ খবর প্রকাশের পর ডাকাতির শিকার আরও অনেকেই যোগাযোগ করছেন গোয়েন্দাদের সঙ্গে। তাদেরই একজন ব্যাংক কর্মকর্তা শওকত বিন কাশেম। ২৬ ডিসেম্বর রাতে খিলক্ষেত থেকে তাকে মিনি ট্রাকে ওঠায় একই চক্র। কেড়ে নেয় সর্বস্ব। তবে ৩০০ ফুট এলাকায় লাফিয়ে প্রাণে বাঁচেন তিনি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন