বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার গত ১৫ সেপ্টেম্বর ডিম ও মুরগির দর নির্ধারণ করে দিয়েছিল। কিন্তু উৎপাদনকারী থেকে খুচরা ব্যবসায়ী– কেউই মানছেন না বেঁধে দেওয়া দাম। তাতে আমিষজাতীয় খাদ্যপণ্য দুটি আগের বাড়তি দরেই কিনতে হচ্ছে ভোক্তাদের। দাম বাড়ার ব্যাপারে খোঁড়া যুক্তি দেখিয়ে এক পক্ষ দোষ চাপাচ্ছে আরেক পক্ষের ওপর।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, দর নির্ধারণের আগে সরকার স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করেনি। উৎপাদন না বাড়িয়ে দর নির্ধারণ করলে তা বাস্তবায়ন হবে না। আবার কেউ বলছেন, বর্তমান দামের চেয়ে কম দরে বিক্রি করলে উৎপাদনকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তাতে খামারিদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
সরকারের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সবার সঙ্গে আলোচনা করেই ডিম-মুরগির দর নির্ধারণ করা হয়েছে। বাজারে সংকট না থাকার পরও দাম বাড়ায় কারা, তা খতিয়ে দেখা দরকার। যদিও কেউ কেউ বলছেন, তদারকির কাজে যুক্ত–এমন সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা করা হয়নি। তবে বাজারে তদারকি চলমান।
গত ১৫ সেপ্টেম্বর উৎপাদক, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে ডিম, সোনালি ও ব্রয়লার মুরগির দাম নির্ধারণ করে দেয় সরকার। খুচরা পর্যায়ে প্রতি পিস ডিমের দাম নির্ধারণ করা হয় ১১ টাকা ৮৭ পয়সা। সে হিসাবে প্রতি ডজনের দর দাঁড়ায় প্রায় ১৪৩ টাকা। সোনালি মুরগি প্রতি কেজি ২৬৯ টাকা ৬৪ পয়সা ও ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজি ১৭৯ টাকা ৫৯ পয়সা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। বলা হয়, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর এবং পোলট্রি-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের নেতাদের সমন্বয়ে গঠিত জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের মতামতের ভিত্তিতে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর এই মূল্য নির্ধারণ করেছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকার বাজারে বাদামি রঙের ডিমের ডজন বিক্রি হয়েছে ১৫৫ থেকে ১৬০ টাকা। তবে পাড়া-মহল্লার দোকানে ক্রেতাকে অতিরিক্ত আরও ৫ টাকা বেশি গুনতে হচ্ছে, যা সরকারের বেঁধে দেওয়া দরের চেয়ে ১২ থেকে ২২ টাকা বেশি। এ ছাড়া দেশি হাঁস-মুরগির ডিমের ডজন খুচরায় বিক্রি হচ্ছে ২০৫ থেকে ২১৫ টাকা দরে।
বাজারে ব্রয়লার মুরগির কেজি বিক্রি হতে দেখা গেছে ১৭৫ থেকে ১৮৫ টাকা। তবে মোটামুটি নির্ধারিত দরের কাছাকাছি সোনালি জাতের মুরগির কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৬০ থেকে ২৭০ টাকায়।
দাম নিয়ন্ত্রণে সরকার ডিম আমদানির অনুমতি দিয়েছে। কিছু ডিম আমদানিও হয়েছে। গত বছরের শেষ প্রান্তিকে এক কোটি পিস ডিম আমদানির অনুমতি নিয়েছিল জেএফজে প্যারাডাইস কানেকশন। প্রতিষ্ঠানটির মালিক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমদানির অনুমতি পাওয়ার পর দেখা গেছে, ভারতেও ডিমের দর বেড়েছে। তাছাড়া এটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসা। পরিবহনকালে কোনো কারণে একটা ক্যারেট ভেঙে গেলে এক হাজার ডিম ভেঙে যাবে; তাতে লোকসান গুনতে হবে। হিসাব করে দেখলাম, আমদানি করলে লাভের চেয়ে লোকসান হতে পারে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে ডিম আমদানি থেকে পিছিয়ে এসেছি।
আমদানির ডিম বাজারে দেখা যাচ্ছে না বলে দাবি করেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। পাইকারি ডিম ব্যবসায়ীদের সবচেয়ে বড় সংগঠন তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি আমানত উল্লাহ বলেন, ‘উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা না করেই সরকার দর নির্ধারণ করেছে। উৎপাদন পর্যায়ে দাম না কমলে খুচরা বাজারে প্রভাব পড়বে না। ডিম-মুরগির উৎপাদন না বাড়িয়ে দর বেঁধে দিলে তা বাস্তায়ন হবে না। তা ছাড়া সাম্প্রতিক বন্যায় ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুরসহ দেশের পূর্বাঞ্চলে হাজার হাজার ফার্মের লাখ লাখ মুরগি মারা গেছে। ফলে ডিমের উৎপাদন কমেছে। কিন্তু চাহিদা কমেনি। বরং বর্ষাকালে ডিমের চাহিদা বেশি থাকে। সামান্য পরিমাণে আমদানি করলে বাজারে এর প্রভাব পড়বে না।’
প্রান্তিক খামারিদের দাবি, মুরগির খাবারের বাজার পুরোপুরি করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণে। বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, ফিডের দাম কমালে ডিম-মুরগির উৎপাদন খরচ কমবে। কিন্তু খাদ্যের দাম না কমিয়ে ডিম আমদানি করলে ছোট খামারিরা লোকসানের মুখে পড়বে। তাই উৎপাদন বাড়াতে হবে। তা ছাড়া ডিম-মুরগির দর নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রান্তিক খামারিদের মতামত নেওয়া হয়নি।
জানা গেছে, দেশে ফিড উৎপাদনকারী কারখানা আছে প্রায় সাড়ে ৩০০টি। উৎপাদনকারীরা বলছেন, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় কাঁচামাল আমদানির ব্যয় বেড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে ফিডের দামে। ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাবেক সভাপতি এহতেশাম বি. শাহজাহান বলেন, ফিড তৈরির ৯০ শতাংশ কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। এসব কাঁচামাল আমদানিতে সরকার ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর বাবদ কেটে রাখে। কিন্তু বছরের পর বছর চলে গেলেও এসব টাকা উদ্যোক্তারা ফেরত পাচ্ছে না। এই টাকা ফেরত দিলে ফিডের দাম কিছুটা হলেও কমবে। তাছাড়া ডলারের দর অনেক বেড়েছে। ফলে আমদানি খরচ বেড়েছে, যা ফিডের দাম বাড়ার অন্যতম কারণ।
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘দর নির্ধারণের সময় কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর এবং পোলট্রি-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধির সমন্বয়ে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপে ভোক্তা প্রতিনিধি রাখার দরকার ছিল। অসাধু মজুতদারদের সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে দাম বেঁধে দিয়ে কখনোই বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। তদারকি না করলে বাজার আরও অস্থির হয়ে উঠবে এবং করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো এ সুযোগ নেবে।’
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. রেয়াজুল হক বলেন, ডিম-মুরগির দর নির্ধারণের আগে খাদ্যপণ্য দুটি উৎপাদনে জড়িত সব স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের পরামর্শ নেওয়া হয়েছে। খামারিদের মধ্যে ছোট-বড় সবার সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। উৎপাদন ব্যয়, লাভ-লোকসান হিসাব করেই দর নির্ধারণ করা হয়। জনস্বার্থে আমরা চেষ্টা করছি, দাম যেন নিয়ন্ত্রণে থাকে। বাজারে তো ডিমের সংকট নেই। তাহলে দাম বাড়ায় কারা? এটা এখন প্রশ্ন তুলতে হবে এবং বাজার তদারককারীদেরও এগিয়ে আসতে হবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন