
ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে ফসলি ও সরকারি জমি থেকে মাটি কেটে ইটভাটা, বাড়িঘর ও নির্মীয়মাণ বিভিন্ন কারখানায় বিক্রি করছে সংঘবদ্ধ প্রভাবশালী চোরচক্র। এই মাটি চুরির হিড়িক চলছে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের কোন্ডা ইউনিয়নের কাটুয়াইল ও কাজিরগাঁও মঠবাড়ি এলাকায়। এতে নষ্ট হচ্ছে আশপাশের ফসলি জমিসহ গোটা পরিবেশ ও পিচঢালা সড়ক। হুমকিতে রয়েছে পদ্মা সেতুর রেলপথও।
পদ্মা সেতু ঘিরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে ঢাকা-যশোর রেলপথ। দৃষ্টিনন্দন নির্মাণশৈলীর কারণে স্থানীয়দের দৃষ্টি কাড়ছে রেলপথটি। রেলপথের একটি অংশ গেছে কেরানীগঞ্জের কোন্ডা ইউনিয়নের ওপর দিয়ে। কেরানীগঞ্জের মাটিখেকো দস্যুদের লোভের কারণে ঝুঁকিতে পড়তে যাচ্ছে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এই রেলপথটি।
কোন্ডা ইউনিয়নের বাসিন্দারা জানায়, প্রায় এক দশক ধরে দিন-রাত সমান তালে মাটি চুরি করছিল পতিত সরকারের সাবেক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠান প্রিয় প্রাঙ্গণের ম্যানেজার ও ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ নেতা জসিম মাহমুদের নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ মাটিচোর চক্র।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বুড়িগঙ্গা নদীর তীরঘেঁষা কোন্ডা ইউনিয়নের সমতল ভূমি বা কৃষিজমি আর বাকি নেই। এই ইউনিয়নে প্রধান সমস্যা এখন মাটি চুরি। ফসলি জমি, বসতভিটা হয়ে গেছে পুকুর, ডোবা কিংবা বড় আকৃতির দিঘি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ব্রাহ্মণগাঁও, নোয়ার্দা ও কান্দাপাড়ার বাসিন্দারা বলেন, রেলপথের খুব কাছে চলে গেছে মাটিচোরদের খননযন্ত্র ভেকু। ফলে কেরানীগঞ্জের কোন্ডা ইউনিয়নের কাটুয়াইল মৌজার প্রায় চার কিলোমিটার রেলপথের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা হাবিবুর রহমান জানান, প্রতিদিন শিফট করে দিনে ও রাতে ২৪ ঘণ্টা চলছে মাটি কাটা। কেউ তাদের বাধা দিলে চলে নির্যাতন, হতে হয় বাড়িঘরছাড়া। আর এই মাটিচোর চক্রকে সাহায্য করেন স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতারা। বুড়িগঙ্গা নদীর পারে বন্যাপ্রবণ কোন্ডা ইউনিয়নের তিনটি গ্রামে রেলপথের উভয় প্রান্ত থেকে মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। এই চক্রের কারণে রেল সেতুর উভয় দিকে গভীর খাদ সৃষ্টি হওয়ায় রেলপথটি ঝুঁকিতে পড়তে পারে বলে মনে করেন তিনি। সরেজমিনে দেখা যায়, বুড়িগঙ্গা নদী পেরিয়ে ঢাকা-মাওয়া রেলপথটি পড়েছে কেরানীগঞ্জের কান্দাপাড়ায়। নদীঘেঁষা এলাকা নিচু হওয়ায় রেলপথ বানানো হয়েছে পিলার দিয়ে মাটি থেকে কিছুটা ওপরে। কান্দাপাড়ার অদূরেই ব্রাহ্মণপাড়া গ্রাম। ব্রাহ্মণপাড়া স্কুল পেরিয়ে একটু এগোলেই বড় বড় খাদ। খাদগুলো ২০-৩০ ফুট গভীর। মাটিদস্যুদের ভেকু পৌঁছে গেছে রেলপথের ৩০ থেকে ৫০ গজের মধ্যে। রেলপথের অন্য প্রান্তেও দেখা গেছে একই চিত্র।
স্থানীয় বাসিন্দা রতন বলেন, মাটিখেকোরা কাউকে তোয়াক্কা করে না। তারা প্রকাশ্যেই সাধারণ মানুষের জমি ও সরকারি জমি থেকে মাটি নিয়ে যাচ্ছে। এই মাটি তারা আশপাশের ইটভাটায় বিক্রি করছে। তিনি রেলপথের উভয় পাশে অতি দ্রুত মাটি কাটা বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান। ব্রাহ্মণগাঁওয়ের মো. রফিক মিয়া জানান, রেলপথ থেকে ৫০ গজের মধ্যেই বেশ গভীর করে মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে মাটিচোর চক্র। সমতল ভূমি থেকে অন্তত ২০-৩০ ফুট গভীর করে মাটি কাটা হচ্ছে, যা রেলপথের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
গত সোমবার সাংবাদিকরা সরেজমিনে উপস্থিত হলে মাটিদস্যুরা তাদের ডাম্প ট্রাক ও এক্সকাভেটর ভেকু ফেলে পালিয়ে যায়।
অভিযুক্ত বিএনপি নেতাদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ওসি সৈয়দ মোহাম্মদ আক্তার হোসেন বলেন, ‘জমিসংক্রান্ত বিষয়গুলো দেখভাল করেন ভূমি কর্মকর্তা ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার। মাটি কাটার বিষয়ে থানায় কোনো অভিযোগ এলে আমরা অভিযোগ গ্রহণ করে তা তদন্ত করে দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। কাটুয়াইল মৌজায় কিছু লোক মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে, তা উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে কাটছে বলে জানতে পেরেছি।’
জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) রিনাত ফৌজিয়া বলেন, ‘আমার অফিসে ওই এলাকার কিছু লোক অনেক দিন আগে তাদের বাড়িতে কাজ করার জন্য কিছু মাটি প্রয়োজন বলে তাঁরা নিজ জমি থেকে মাটি কাটার আবেদন করেন। সেটা তদন্ত সাপেক্ষে জেলা প্রশাসক স্যারের পরামর্শে তাঁদের অনুমতি দেওয়া হয়। কিন্তু তা কেটে বিক্রির জন্য অনুমতি দেওয়া হয়নি। মাটি কাটার জন্য আমি অনুমতি দিইনি। যদি তাঁরা সেখানে মাটি কেটে থাকেন, তাহলে তাঁদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’