হঠাৎ করেই আমানত হারাতে শুরু করেছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সরকারি ব্যাংকগুলো। সর্বশেষ ২০২৩ সালের শেষ তিন মাসে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) এ খাতের ব্যাংকগুলোতে আমানত কমেছে ৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি। আমানতের বড় অংশই কমেছে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকের। এগুলো হলো-সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক ও বিডিবিএল। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংক খাতে নয়ছয় সুদহারের সীমা তুলে দেওয়ার পর রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সরকারি ব্যাংকগুলো সেভাবে সুদ সমন্বয় করেনি। আবার উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে আমানত তুলে নিয়ে সংসারের খচর মেটাচ্ছেন অনেকেই। ফলে এসব ব্যাংকে আমানতে পতন হয়েছে। অন্যদিকে বেসরকারি ব্যাংকগুলো তুলনামূলক বেশিহারে সুদ বাড়িয়ে আমানত আকৃষ্ট করছে। ফলে এ খাতের ব্যাংকগুলোতে আমানত বেড়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, গত জুলাই থেকে নয়ছয় সুদের সীমা তুলে দেওয়ার পর বেসরকারি কিছু ব্যাংক আগ্রাসীভাবে আমানতে সুদহার বাড়িয়েছে। ফলে গ্রাহকরা বেশি লাভের আশায় আমানত রাখতে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে ছুটছে। অপরদিকে স্মার্ট সুদহার অনুযায়ী রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো সেভাবে সুদহার সমন্বয় করেনি। বেসরকারি ব্যাংকের তুলনায় সরকারি ব্যাংকের গড় সুদহার এখনো তুলনামূলক কম। যার কারণে এসব ব্যাংকের আমানত কমেছে। আবার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর গ্রামীণ শাখা বেশি। মূল্যস্ফীতির কারণে গ্রামীণ মানুষ তাদের আমানত তুলে খরচ করছে। যার প্রভাবেও আমানত কমতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর গড় সুদহার দাঁড়ায় ৪ দশমিক ৬৪ শতাংশ, যা ওই বছরের জুনে ছিল ৪ দশমিক ৪১ শতাংশ। এর মানে গত ছয় মাসে এসব ব্যাংকের গড় সুদহার বেড়েছে মাত্র দশমিক ২৩ শতাংশ। অন্যদিকে গত ডিসেম্বরে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে গড় সুদহার দাঁড়ায় ৪ দশমিক ৯৭ শতাংশ, যা জুনে ছিল ৪ দশমিক ৪০ শতাংশ। ফলে গত ছয় মাসে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে গড় সুদহার বেড়েছে দশমিক ৫৭ শতাংশ। সূত্রগুলো বলছে, দীর্ঘদিন ধরেই ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট চলছে। এ কারণে উচ্চ সুদ দিয়ে হলেও বেসরকারি অনেক ব্যাংক আমানত আকৃষ্ট করছে চাইছে। কোনো কোনো ব্যাংক আমানতে এখন ৯ থেকে ১১ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিচ্ছে।
এ বিষয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, সরকারি ব্যাংকগুলো চাইলে আগ্রাসীভাবে সুদহার বাড়াতে পারে না। কারণ সরকার এসব ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিভিন্ন প্রকল্প করে থাকে। তাই ব্যাংকগুলো সুদহার বাড়াতে চাইলেও সরকারের পক্ষ থেকে সেভাবে সুদহার বাড়াতে দেওয়া হয় না। ফলে বেসরকারি ব্যাংকগুলো উচ্চ সুদ অফার করলে গ্রাহক অনেক সময় সরকারি ব্যাংক থেকে আমানত নিয়ে সেখানে রাখে। এর কারণেই সরকারি ব্যাংকে আমানত কমতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, গত বছরের ডিসেম্বর শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর আমানতের স্থিতি ছিল ৪ লাখ ২৯ হাজার ৫৬৩ কোটি টাকা। তার আগের প্রান্তিক অর্থাৎ সেপ্টেম্বর শেষে আমানতের স্থিতি ছিল ৪ লাখ ৩৩ হাজার ৭৮৭ কোটি টাকা। সে হিসেবে তিন মাসে সরকারি ব্যাংকের আমানত কমেছে ৪ হাজার ২২৩ কোটি টাকা বা শূন্য দশমিক ৯৭ শতাংশ। অপরদিকে গত বছরের শেষ তিন মাসে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে আমানত বেড়েছে ৩৯ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা। ডিসেম্বর শেষে বেসরকারি ব্যাংকে আমানতের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ ৮৮ হাজার ৭২৬ কোটি টাকা, যা সেপ্টেম্বর শেষে ছিল ১১ লাখ ৪৯ হাজার ২৮১ কোটি টাকা। এ ছাড়া বিদেশি ব্যাংকে গত বছরের শেষ তিন মাসে আমানত বেড়েছে ৯২৪ কোটি টাকা। ডিসেম্বর শেসে এসব ব্যাংকে আমানতের স্থিতি ছিল ৮৩ হাজার ৭৩৭ কোটি টাকা, যা সেপ্টেম্বর শেষে ছিল ৮২ হাজার ৮১৩ কোটি টাকা।
এদিকে ডিসেম্বরে বিশেষায়িত খাতের ব্যাংকেই আমানতের গড় সুদহার ছিল সর্বোচ্চ ৬ দশমিক ০৭ শতাংশ। বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোতে আমানতের গড় সুদহার বেশি হলেও আমানত পাচ্ছে না। বরং আগের আমানত হারাচ্ছে। মূলত এসব ব্যাংকের ওপর মানুষের আস্থার সংকট থাকার কারণে উচ্চ সুদ দিলেও কেউ আমানত রাখছে না।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বর শেষে বিশেষায়িত ব্যাংকের আমানতের স্থিতি ছিল ৪৭ হাজার ১০৫ কোটি টাকা, যা সেপ্টেম্বর শেষে ছিল ৪৭ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসে আমানত কমেছে ১৪৯ কোটি টাকা বা শূন্য দশমিক ৩১ শতাংশ।
প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে মোট আমানত দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৪৬ হাজার ৭২ কোটি টাকা, যা গত সেপ্টেম্বর শেষে ছিল ১৪ লাখ ৫ হাজার ৮৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসে ব্যাংক খাতে আমানত বেড়েছে ৪০ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা বা ২ দশমিক ৯২ শতাংশ।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন