রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর থেকেই মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে আগ্রাসন চালাচ্ছে ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েল। প্রতিবেশী দেশগুলোতে তাদের আগ্রাসন দিন দিন বেড়েই চলেছে। বিগত কয়েক মাসে দেশটি ইরান, সিরিয়া এবং লেবাননের বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে। সর্বশেষ আসাদ সরকারের পতনের পর সিরিয়ায় ব্যাপক হামলা এক নতুন মধ্যপ্রাচ্য সৃষ্টি, বিশেষ করে ‘বৃহত্তর ইসরায়েল রাষ্ট্রের’ কথা আবারও উঠে এসেছে।
বৃহত্তর ইসরায়েল কী?
বৃহত্তর ইসরায়েল বলতে, বর্তমান ইসরায়েল রাষ্ট্র এবং ফিলিস্তিনি অঞ্চলসমূহকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়, যা মিশরের নীল নদ থেকে ইরাকের ফোরাত নদী পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলকে বোঝায়।
বৃহত্তর ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়ে চলতি বছরের শুরুতে মিডল ইস্ট মনিটরকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ইসরায়েলি রাজনীতিবিদ আভি লিপকিন বলেছিলেন, ‘পর্যায়ক্রমে আমাদের সীমান্ত লেবানন থেকে সৌদি আরবের বিশাল মরুভূমি পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। তারপর ভূমধ্যসাগর থেকে ফোরাত নদী (ইরাক)। আর ইউফ্রেটিস নদীর অপর পারে কে? কুর্দিরা! এবং তারা আমাদের বন্ধু।’
‘আমাদের পেছনে ভূমধ্যসাগর এবং সামনে কুর্দিস্তান। লেবাননের ইসরায়েলের সুরক্ষা প্রয়োজন এবং আমি নিশ্চিত আমরা মক্কা, মদিনা এবং সিনাইও দখল করব এবং এই স্থানগুলোকে পবিত্র করতে পারব,’ বলেন তিনি।
এছাড়াও গত অক্টোবর মাসে মুক্তিপ্রাপ্ত ফ্রান্স-জার্মানভিত্তিক ম্যাগাজিন আর্টে রিপোর্টেজ নির্মিত ‘ইন ইসরায়েল: মিনিস্টারস অব কেয়াস’ নামের তথ্যচিত্রেও বৃহত্তর ইসরায়েলের কথা উঠে এসেছে।
তথ্যচিত্রে ইসরায়েলের দুই উগ্রপন্থি ইহুদি নেতা জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গভির ও অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ সম্ভাব্য ‘বৃহত্তর ইহুদি রাষ্ট্র’নিয়ে কথা বলেছেন।
তথ্যচিত্রে স্মোট্রিচ জানান, তারা ধীরে ধীরে ইহুদি রাষ্ট্রটির সীমানা বাড়াতে চায়। তার মতে, ভবিষ্যৎ ইসরায়েল রাষ্ট্র জর্ডান, লেবানন, মিশর, সিরিয়া, ইরাক এমনকি সৌদি আরব পর্যন্ত বিস্তৃত হবে।
বিভিন্ন পদক্ষেপ
লেবাননে ইসরায়েলের সাম্প্রতিক সামরিক অভিযান, যা সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে শুরু হয় এবং ২৭ নভেম্বর যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে শেষ হয়েছে। এ আগ্রাসনকেও ইহুদিবাদী দেশটির বিস্তৃত সম্প্রসারণবাদী কৌশলের অংশ বলে মনে করা হচ্ছে।
আরেকটি উসকানিমূলক পদক্ষেপ হচ্ছে, গত ২৫ সেপ্টেম্বর দক্ষিণ লেবাননে বসতি স্থাপনের জন্য ইসরায়েলের একটি কট্টরপন্থী ইহুদিবাদী সংগঠন ওই অঞ্চলের নতুন মানচিত্র প্রকাশ করেছে। মানচিত্রে এই অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকার ‘নতুন হিব্রু নাম’ দেওয়া হয়েছে।
দক্ষিণ লেবাননের শহর ও গ্রামগুলোর হিব্রু নামকরণ ওই অঞ্চলে ইসরায়েলি আধিপত্য প্রতিষ্ঠার একটি নির্লজ্জ প্রচেষ্টা বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
একই সময়ে, ইসরায়েলি সংবাদপত্র জেরুজালেম পোস্ট সাংবাদিক মার্ক ফিশের একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে। যদিও তা পরে দ্রুত সরিয়ে নেওয়া হয়। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছিল, লেবানন এবং পশ্চিম এশিয়ার অন্যান্য দেশের অংশগুলো তাওরাতে বর্ণিত ইহুদিদের জন্য ‘প্রতিশ্রুত ভূমির’ অন্তর্ভুক্ত।
২৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত ওই নিবন্ধের সঙ্গে লেবাননে ইসরায়েলের আক্রমণের মিল রয়েছে। লেখক মার্ক ফিশ বলেন, ‘ইসরায়েলের সন্তানদের’ জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ অঞ্চলটি ‘আধুনিক ইসরায়েলকে’ ছাড়িয়ে প্রসারিত, যা পশ্চিম তীর, গাজা এবং লেবানন, সিরিয়া, জর্ডান, ইরাক এবং তুরস্কের কিছু অংশ জুড়ে বিস্তৃত।
তবে, দক্ষিণ লেবাননে ইসরায়েলের আগ্রাসী মনোভাব সত্ত্বেও লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর শক্তিশালী প্রতিরোধের কারণে তাদের সম্প্রসারণবাদী পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছিল। মূলত হিজবুল্লাহর শক্তিশালী প্রতিরোধ ইসরায়েলকে যুদ্ধবিরতিতে বাধ্য করেছিল।
লেবাননে দখলদারিত্ব সম্প্রসারণের ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর এবার সিরিয়ার দিকে মনোনিবেশ করেছে ইসরায়েল। যুদ্ধবিধ্বস্ত আরব দেশটির অস্থিতিশীল পরিস্থিতিকে পুঁজি করে তারা ব্যাপক স্থল ও বিমান হামলা চালিয়েছে।
১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর প্রথমবারের মতো সিরিয়ার ভূখণ্ডে ইসরায়েলি স্থল বাহিনীর সাম্প্রতিক আগ্রাসনের ফলে বৃহত্তর ইসরায়েলের ধারণা আবারও জল্পনার সৃষ্টি করেছে।
এমন ধারণার শুরু
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, বৃহত্তর ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এ ধারণা নতুন নয়। বরং এর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল ১৮৯৭ সালে। সে বছর সুইজারল্যান্ডের বাসেল শহরে আধুনিক ইহুদিবাদের প্রতিষ্ঠাতা থিওডর হার্জেলের নেতৃত্বে ইহুদিদের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে প্রথমবারের মতো ইহুদিদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা তুলে ধরেন হার্জেল।
এরই ধারাবাহিকতায় ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড আর্থার বেলফোর ইহুদিবাদী নেতা ব্যারন রথচাইল্ডকে একটি চিঠি লেখেন। যেখানে তিনি ইহুদিদের জন্য আবাসভূমি গড়ে তুলতে ব্রিটিশ সরকার সর্বোচ্চ সহযোগিতার করবে বলে উল্লেখ করেছিলেন। ইতিহাসে যা ‘বেলফোর ঘোষণা’ নামে পরিচিত। সে মাসেই অটোমানদের হাত থেকে জেরুজালেম দখল করে ব্রিটেন।
ব্রিটিশরা ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকে ইহুদিদের ফিলিস্তিনে বিভিন্নরকম সুবিধা দিতে থাকে। ফলে দলে দলে ইহুদিরা ইউরোপ ও অন্য আরব দেশ থেকে ফিলিস্তিনে পাড়ি জমাতে শুরু করে। ব্রিটিশদের প্রত্যক্ষ মদদেই অভিবাসী ইহুদিদের নিয়ে ১৯২১ সালেই গঠন করা হয় হাগানাহ নামের আধা সামরিক বাহিনী। এরপর আরও দুটি জায়নবাদী সন্ত্রাসী সংগঠন ইরগুন ও স্টার্ন গ্যাং গড়ে ওঠে পরে। যারা ১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর একীভূত হয়ে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীতে রূপ নেয়। একে একে ফিলিস্তিনিদের ভূমি দখল করতে করতে জন্ম হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের ‘বিষফোঁড়া’ খ্যাত আজকের ইসরায়েল রাষ্ট্র।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন