ইসরায়েলের বেপরোয়া হামলা, সংঘাত নতুন মোড় নিতে পারে
বাশার আল-আসাদের পতনের পর সিরিয়ায় স্থিতিশীলতা ফেরার যে সুযোগ তৈরি হয়েছিল, ইসরায়েলের একের পর এক বেপরোয়া বিমান হামলায় তা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। ইসরায়েলের বিমানবাহিনীর ইতিহাসে অন্যতম বড় এই হামলা নতুন করে অস্থিতিশীলতা তৈরি করেছে সিরিয়ায়। সর্বাত্মক হামলার পাশাপাশি ইসরায়েলের সেনারা দেশটির ভূখণ্ডে ঢুকে পড়ছেন। সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে তাঁরা ‘নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছেন। পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে সিরিয়ার সংঘাত নতুন দিকে মোড় নিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর মাত্র ১২ দিনের ঝটিকা আক্রমণে গত রোববার স্বৈরাচার বাশার আল-আসাদ সিরিয়া ছেড়ে রাশিয়ায় আশ্রয় নিয়েছেন। এর পর থেকে দেশটিতে হামলা জোরদার করে ইসরায়েল। সর্বশেষ ৪৮ ঘণ্টায় দেশটির রাজধানী দামেস্ক ছাড়াও হোমস, তারতাস, পালমিরা, লাতাকিয়া, দেইর আজোরের মতো শহরে অন্তত ৪৮০টি হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। এসব হামলার লক্ষ্য ছিল দেশটির যুদ্ধজাহাজ, বিমানঘাঁটি, সামরিক যান, বিমানবিধ্বংসী অস্ত্র, অস্ত্র উৎপাদন কারখানা, অস্ত্রাগারসহ বিভিন্ন সামরিক স্থাপনা। এই সময়ে সিরিয়ার ১৪টি প্রদেশের ১৩টিতে হামলা চালায় ইসরায়েল।
সিরিয়ার সামরিক সক্ষমতা গুঁড়িয়ে দিতেই এ হামলা বলে মনে করে সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস নামের একটি সংস্থা। সিরিয়া সংঘাত নিয়ে কাজ করা সংস্থাটি জানায়, ইসরায়েলের হামলায় সিরিয়ার গুরুত্বপূর্ণ সব সামরিক স্থাপনা ধ্বংস হয়েছে। সিরিয়ার যুদ্ধবিমান, যুদ্ধজাহাজ ও হেলিকপ্টার থেকে শুরু করে ট্যাংক, সাঁজোয়া যান, ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন—সব ধরনের অস্ত্র ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।
ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী গতকাল বুধবার এক বিবৃতিতে দাবি করেছে, বাশার আল-আসাদ সরকারের পতনের পর সিরিয়ার সামরিক সরঞ্জামাদি যুদ্ধের আওতার বাইরে রাখতে দেশটির বিভিন্ন কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে সর্বশেষ এসব হামলা চালানো হয়েছে।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, ‘সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার কোনো ইচ্ছা আমাদের নেই; কিন্তু আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যা করা প্রয়োজন, তার সবটাই করব আমরা। সিরিয়ার সামরিক বাহিনীর ফেলে যাওয়া কৌশলগত সামরিক সরঞ্জাম ও স্থাপনায় বোমা হামলা চালাতে বিমানবাহিনীকে অনুমতি দিয়েছি, যাতে এগুলো জিহাদিদের হাতে না যায়।’
লন্ডনভিত্তিক চিন্তন প্রতিষ্ঠান চ্যাথাম হাউসের মিডল ইস্ট অ্যান্ড নর্থ আফ্রিকা কর্মসূচির পরিচালক সানাম বাকিল বলেন, সিরিয়ার অস্থিতিশীলতার সুযোগ নিচ্ছে ইসরায়েল। এটা অবশ্যই সিরিয়ার সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চুপ থাকা এবং ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের কারণে তারা এই সুযোগ নিচ্ছে। বাকিল বলেন, নিজেদের নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে আরব ভূখণ্ড ব্যবহার করে ইসরায়েল যেভাবে কথিত নিরাপদ অঞ্চল গড়ে তুলছে, তাতে আরব রাষ্ট্রগুলো অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে।
আরও ভূখণ্ড ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণে
বাশার আল-আসাদ সরকারের পতনের পর ইসরায়েলের সেনারা সিরিয়ার ভূখণ্ডে আরও ভেতরে ঢুকতে শুরু করেছেন। ইসরায়েলের দখলে থাকা গোলান মালভূমি পেরিয়ে সিরিয়ার ভেতরে ‘নিরস্ত্রীকরণ এলাকায়’ (ডিমিলিটারাইজড জোন) ঢুকে পড়েছেন ইসরায়েলের সেনারা। আল-জাজিরা বলছে, গোলান মালভূমি পেরিয়ে ইসরায়েলের সেনারা দামেস্ক অভিমুখে ১৮ কিলোমিটার অগ্রসর হয়েছেন।
১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় গোলান মালভূমি দখল করে ইসরায়েল। যুদ্ধ শেষে সিরিয়ার ভেতরে গোলান মালভূমি লাগোয়া সিরিয়ার একটি ভূখণ্ডকে নিরস্ত্রীকরণ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ইসরায়েলের সেনারা এই এলাকায় ঢুকে সামরিক চৌকিগুলোরও নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন।
ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী বলেছে, ইসরায়েলের সেনারা ওই অঞ্চলে থেকে যাবেন। এর আশপাশের আরও কিছু এলাকাতেও থাকবেন তাঁরা। তবে সিরিয়ার একটি সূত্র রয়টার্সকে জানিয়েছে, ইসরায়েলের সেনারা ইতিমধ্যে কাতানা শহরে পৌঁছে গেছেন। নিরস্ত্রীকরণ ওই অঞ্চল থেকে শহরটি বেশ কয়েক কিলোমিটার দূরে। সেখান থেকে কিছু দূর এগোলেই দামেস্ক বিমানবন্দর।
ইসরায়েলের সেনারা কি দামেস্ক অভিমুখে যাচ্ছেন—এমন প্রশ্নের জবাবে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল নাদাভ সোশানি সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, ইসরায়েলের সেনারা দামেস্ক অভিমুখে যাচ্ছেন না এবং দামেস্কে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনাও নেই।
এরই মধ্যে সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে একটি ‘নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল’ গঠনের কথা জানিয়েছেন ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ। তিনি বলেছেন, ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীকে সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে একটি নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল গড়ে তোলার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
ইসরায়েল কাৎজ বলেন, নিয়ন্ত্রিত ওই অঞ্চলে ইসরায়েলি বাহিনীর স্থায়ী উপস্থিতি থাকবে না, তবে সেটি নিয়ন্ত্রিত হবে। বিস্তারিত না জানালেও তিনি বলেন, এই অঞ্চল গড়ে তোলার লক্ষ্য হচ্ছে, যাতে সিরিয়ার ভূখণ্ডে সন্ত্রাসীরা সংগঠিত হতে না পারে।
ভূরাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক মাইকেল এ হরোভিৎস বলেন, নিরাপদ অঞ্চলের সীমানা ছাড়িয়ে সিরিয়ার ভূখণ্ডে ইসরায়েলের স্থল অভিযানের ইঙ্গিত দিয়েছেন নেতানিয়াহু। এটা যদি হয় তাহলে সংঘাতের ঝুঁকি আরও বাড়বে। তিনি বলেন, ইসরায়েলের সেনারা যদি আরও অগ্রসর হন অথবা নিয়ন্ত্রিত এলাকায় তাঁরা যদি স্থায়ীভাবে থেকে যান, তাহলে নতুন করে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে। কট্টরপন্থী গোষ্ঠীগুলো ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের যৌক্তিকতা তুলে ধরতে পারবে। এতে সংঘাত নতুন মোড় নিতে পারে।
হামলা বন্ধ ও সেনা প্রত্যাহারের আহ্বান
সিরিয়ায় ইসরায়েলের হামলার নিন্দা জানিয়েছে রাশিয়া, তুরস্ক, মিসর, কাতার, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশ। দেশগুলো বলছে, বাশারের পতনের পর ইসরায়েলের এমন হামলা দেশটিকে আরও অস্থিতিশীল করে তুলবে। ইসরায়েলকে সিরিয়ায় হামলা বন্ধ ও দেশটির ভূখণ্ডে সেনা না পাঠানোর আহ্বান জানিয়েছে দেশগুলো।
সিরিয়ার সামরিক স্থাপনায় সর্বাত্মক হামলা ও দেশটির আরও ভূখণ্ড দখলে নেওয়ার নিন্দা জানিয়েছে রাশিয়া। মস্কো বলেছে, ইসরায়েলের এ ধরনের তৎপরতা ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় করা চুক্তির লঙ্ঘন। একই সঙ্গে ইসরায়েলের এ ধরনের হামলা গভীর উদ্বেগের।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান বলেছেন, ‘সিরিয়ার মানুষের স্বাধীনতা ও দেশটির সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে এবং নতুন প্রশাসনকে অস্থিতিশীল করতে হামলা হলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমরা এর জবাব দেব।’
সিরিয়া পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে মধ্যপ্রাচ্য সফরে যাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার গতকাল জানান, বুধবার থেকে শুক্রবার তিন দিনের সফরে জর্ডান ও তুরস্কে যাবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
ইসরায়েলের হামলা ও ক্ষমতা হস্তান্তরপ্রক্রিয়াসহ সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সিরিয়ায় বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর নেতৃত্বে থাকা এইচটিএসের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন কাতারের কূটনীতিকেরা। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ এইচটিএস নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা চালাচ্ছে।
সিরিয়ায় শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরপ্রক্রিয়া যাতে কোনোভাবে বাধাগ্রস্ত না হয়, এ জন্য ইসরায়েল ও তুরস্কের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে জার্মানি। গতকাল জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্নালেনা বায়েরবক বার্লিনে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘সিরিয়ায় অভ্যন্তরীণ আলোচনার প্রক্রিয়া কেউ বাইরে থেকে বাধাগ্রস্ত করতে চাইলে আমরা মেনে নেব না।’
গোলান মালভূমি থেকে সেনা প্রত্যাহারে ইসরায়েলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ফ্রান্সও। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেছেন, সেখানে সেনা পাঠানো আরব-ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি চুক্তির লঙ্ঘন।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি বলেছেন, সিরিয়ার দখলকৃত ভূখণ্ড মুক্ত করা হবে। ইরান ও দেশটির মিত্রদের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, মধ্যপ্রাচ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে উৎখাত করবে প্রতিরোধের অক্ষশক্তি।
শান্তির ডাক অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রীর
সিরিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আল-বশির বলেছেন, এখন দেশটিতে শান্তি-স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার সময়। প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হওয়ার পর গতকাল কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আল-বশির এ কথা বলেন।
বাশার আল-আসাদের সরকারকে উৎখাতে নেতৃত্ব দেওয়া সিরিয়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শামের (এইচটিএস) প্রধান আবু মোহাম্মদ আল-জোলানি বলেছেন, সিরিয়াকে পুনর্গঠন করা হবে। সিরিয়া উন্নয়ন ও পুনর্নির্মাণের পথে অগ্রসর হবে। সিরিয়া স্থিতিশীলতার পথে এগোবে। যুদ্ধের কারণে মানুষ ক্লান্ত। এই দেশ আরেকটি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত নয়। তাঁরা আরেকটি যুদ্ধে জড়াতে যাচ্ছেন না।