কাওসার হোসেন হৃদয়। ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলায় নিজ গ্রামে গরুর খামার করে জীবিকা নির্বাহ করেন। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া ঢাকায় আসা হয় না। সর্বশেষ এসেছেন প্রায় চার বছর আগে। কয়েকদিন আগে জানতে পারেন তার বিরুদ্ধে দুটি হত্যা মামলা হয়েছে রাজধানীর মিরপুর থানায়। এমন ঘটনায় হতবাক তিনি। এরই মধ্যে পরিচিত এক পুলিশ সদস্যের মাধ্যমে থানায় খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন শুধু তিনি নন বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত তার দুই ভাইয়ের নামেও মামলা হয়েছে। এর মধ্যে বড় ভাই নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে দুটি ও ছোট ভাই ফখরুল ইসলাম শামীমের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা হয়েছে। অথচ তারাও কেউ মিরপুরের বাসিন্দা নন। একজন নোয়াখালীর বসুরহাটে কর্মরত। আরেকজন রাজধানীর ইমামগঞ্জে। এ ঘটনায় বিধ্বস্ত কাওসারের পরিবার। কী করবেন বুঝছেন না কাওসারের পরিবারের সদস্যরা। তবে তাদের ধারণা পারিবারিক বিরোধের জের ধরে জেঠাতো ভাই হাসান আহমেদ রুমন (মিরপুরের বাসিন্দা) এসব মামলার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারেন। কারণ পাওনা টাকার জন্য রুমনকে দীর্ঘদিন ধরে চাপ দিচ্ছে কাওসারের পরিবার। কাওসার বলেন, আমি গরুর খামার করে জীবিকা নির্বাহ করি। আমার দুই ভাই বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত। এলাকায় কেউ কখনো বলতে পারবে না আমরা কারও ক্ষতি করেছি।
অথচ আমাদের তিন ভাইয়ের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দেয়া হয়েছে। আমরা এর প্রতিকার চাই। জানা গেছে, ছাত্র আন্দোলনের সময় ১৯শে জুলাই বিকাল সাড়ে ৫টায় মিরপুর এলাকায় ময়মনসিংহের সেলিম আলী শেখ নামে এক ব্যক্তিকে হত্যা ও রাত ৮টায় মনিরুল ইসলাম নামে একজনকে হত্যার পৃথক দুই মামলার আসামি করা হয়েছে তিন ভাইকে। এ ছাড়া ৪ঠা আগস্ট বিকাল পৌনে ৩টায় পারভেজ হোসেন নামে এক ব্যক্তিকে হত্যার ঘটনায় একটি মামলা হয়। এটিতে আসামি করা হয় ছোট ভাই শামীমকে। ফখরুল ইসলাম শামীম তিন মামলার দুটির হত্যাকাণ্ডের সময় অফিসে উপস্থিত ছিলেন। আর নজরুল ইসলামও একটি মামলায় উল্লেখিত ঘটনার সময় অফিসে উপস্থিত ছিলেন।গণঅভ্যুত্থানের পর দেশ জুড়ে গণহত্যা মামলা নিয়ে বাণিজ্য চলছেই। সরকারের পক্ষ থেকে নানা পদক্ষেপ নিয়ে মামলা বাণিজ্য বন্ধ করা যাচ্ছে না। এসব মামলা বাণিজ্য রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী থেকে শুরু করে খোদ পুলিশ কর্মকর্তারা জড়িয়েছেন। প্রকৃত আসামির পাশাপাশি নিরীহ ব্যক্তিদের আসামি করে হয়রানি করা হচ্ছে। আবার টাকার বিনিময়ে প্রকৃত আসামিকে গ্রেপ্তারও করা হচ্ছে না।
অথচ মামলায় নাম নেই এমনকি ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সম্পৃক্ততা নেই এমন ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। ৫ই আগস্টের পর গণহত্যার ঘটনায় করা ঢালাও মামলার তদন্ত নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। পুলিশের যেসব কর্মকর্তারা এসব মামলার তদন্ত করছেন তারা কুলকিনারা করতে পারছেন না। কারণ হত্যা মামলা আদালতে প্রমাণ করার জন্য যেসব তথ্যপ্রমাণ ও আলামত লাগে সেগুলো পুলিশের কাছে নাই। এ ছাড়া ঘটনার অনেক পরে মামলা হওয়াতে কোনো আলামতও পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক নিহতদের ময়না তদন্ত ছাড়াই দাফন করা হয়েছে। হত্যা মামলা প্রমাণ করার জন্য ময়নাতদন্ত রিপোর্ট, হত্যার আলামত, যে অস্ত্র দিয়ে হত্যা করা হয়েছে সেটি বা গুলি করে হত্যার আলামত তদন্ত সংশ্লিষ্টদের কাছে নাই। তাই মামলার তদন্ত বাদ দিয়ে পুলিশ এজাহারে নাম আছে এমন ব্যক্তি এবং অনেক সাধারণ মানুষকে হয়রানি করছে। গ্রেপ্তারের পর ভীতি দেখিয়ে টাকা আদায় করছে। টাকার বিনিময়ে মামলা থেকে নাম বাদ দিচ্ছে। আবার টাকার বিনিময়ে অনেকের নাম যুক্ত করা হচ্ছে। এমনকি পুলিশ গণহত্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে খোদ পুলিশের কাছ থেকেও ঘুষ নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। পদবি বুঝে ৫০ হাজার থেকে শুরু করে ৫ লাখ টাকাও ঘুষ দাবির অভিযোগ আছে।
গত বছরের ১৮ই জুলাই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে রামপুরা থানার এসআই অনুপ বিশ্বাস ইটের আঘাত পেয়ে আহত হন। পরে তিনি কয়েক সপ্তাহ হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেন। বিপ্লবের পর তিনি জানতে পারেন ১৯ই জুলাই খিলগাঁও এলাকায় বিক্ষোভে একজন আহত হওয়ার ঘটনায় ১৭ই অক্টোবরের এক মামলায় তাকে আসামি করা হয়েছে। অথচ ঘটনার সময় তিনি হাসপাতালেই চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। পরে ওই মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে অনুপের কাছে লাখ টাকা ঘুষ চান তারই এক সহকর্মী। কিন্তু তিনি ঘুষ দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। পরে তাকে বলা হয় ঘুষ না দিলে একাধিক হত্যা মামলায় তাকে ফাঁসানো হবে। অনুপকে যে হত্যা চেষ্টা মামলায় আসামি করা হয়েছে ওই মামলায় অন্য আসামিদের পাশাপাশি পুলিশের ৩৬ জন সদস্যকে আসামি করা হয়। অন্য আরেকটি মামলায় আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালানোর অভিযোগে রামপুরা থানার এসআই রাশেদুর রহমানকে আসামি করা হয়। কিন্তু ঘটনার ১১ দিন আগে ৮ই জুলাই তাকে ভাসানটেক থানায় বদলি করা হয়েছিল। তাই তিনি ভাষানটেক থানায় ডিউটি করছিলেন। কিন্তু যে ঘটনায় তাকে আসামি করা হয়েছে সেটি রামপুরা এলাকার। রাশেদের প্রশ্ন তিনি ভাষানটেক থেকে কীভাবে রামপুরায় গুলি চালালেন। এই মামলায়ও তার কাছে টাকা দাবি করে পুলিশ।
নভেম্বর মাসে নওগাঁর বদলগাছী উপজেলা বিএনপি’র সহ-যুব সম্পাদক বেলাল হোসেন সৌখিনের বিরুদ্ধে মামলার আসামির তালিকা থেকে নাম বাদ দিতে এক আওয়ামী লীগ নেতার কাছ থেকে এক লাখ টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগ উঠেছে। উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক অর্থ সম্পাদক শামসুল আলম খানের কাছে তিনি এই চাঁদা দাবি করেন। টাকা দাবি করা কথোপকথনের ১ মিনিট ৩০ সেকেন্ডের একটি অডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ডিসেম্বর মাসের শুরুর দিকে রাজধানীর লালবাগের আজিমপুরের একটি এতিমখানার তত্ত্বাবধায়ককে তিনটি হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার এবং অভিযোগপত্রে নাম অন্তর্ভুক্ত করার হুমকি দিয়ে অর্থ আদায়ের অভিযোগে তিনজনকে আটক করে যৌথবাহিনী। আটক তিনজনের মধ্যে একজন র?্যাবের সদস্য ল্যান্স করপোরাল শাহীন। তিনি র?্যাব-১০ এ কাজ করতেন। অন্য দুজনের মধ্যে একজন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ল্যান্স করপোরাল সিরাজুল ইসলাম। আরেকজন উজ্জ্বল বিশ্বাস।হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে ৫ই আগস্ট পুলিশের গুলিতে ৯ জন নিহতের ঘটনায় করা মামলায় পাশের উপজেলা নবীগঞ্জের ২ জনকে আসামি করা হয়েছে। এই দুই জনের একজন আওয়ামী লীগ নেতা। অন্যজন রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত না।
সূত্রগুলো বলছে, গণঅভ্যুত্থানের পর যখন ঢালাও মামলা শুরু হয় তখন এসব মামলা নিয়ে একটা চক্র বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে তৎপরতা শুরু করে। থানার পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীরা এই বাণিজ্য শুরু করে। মামলার এজাহারে তখন অনেক নাম উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে দেয়া হয়েছিল। এ ছাড়া অজ্ঞাতনামা হিসেবে প্রতিটি মামলায় আসামি করা হয়। একদিকে এজাহারনামীয় আসামি অন্যদিকে অজ্ঞাতনামা হিসেবে টার্গেট করে করে হয়রানি করা হচ্ছে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক দ্বন্দ্ব, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, দলীয় কোন্দল, পূর্ব শত্রুতাসহ নানা কারণে গণহত্যার আসামি করা হচ্ছে। যারা টাকা দিচ্ছে তাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। গণহত্যার ঘটনায় এখন পর্যন্ত যতগুলো মামলা হয়েছে তার মধ্যে অনেক মামলা বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে করা হয়েছে।সারা দেশে মামলা বাণিজ্য কীভাবে হচ্ছে তার প্রমাণ মিলে আইন উপদেষ্টার এক বক্তব্য থেকে। ৩০শে ডিসেম্বর রাজধানীর নগর ভবনে এক অনুষ্ঠানে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, ‘মামলা বাণিজ্য শুরু হয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধ, হত্যার বিচারের দাবিতে ব্যবসা শুরু হয়েছে আমাদের সমাজে। তাদের আমরা চিহ্নিত করবো। অবশ্যই তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। তিনি বলেন, সাধারণ আদালতে মামলা নিয়ে অনেক অসংগতি হচ্ছে। মামলা নিয়ে ব্যবসা করছে। কোনো কোনো স্বার্থান্বেষী মহল ভুল মামলা দিচ্ছে। প্রকৃত অভিযুক্তের পাশাপাশি অনেক লোককে আসামি করে মামলা হালকা করার চেষ্টা করছে। এটা আমরা কীভাবে সমাধান করবো? একই মাসের শুরুর দিকে ৫ই ডিসেম্বর পুলিশ মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম পুলিশ সদর দপ্তরে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, মামলায় নাম থাকলেই গণহারে গ্রেপ্তার করা যাবে না। পাইকারি হারে কাউকে পুলিশ গ্রেপ্তার করবে না। নিরীহ কাউকে হয়রানি করা যাবে না।
ইচ্ছাকৃত মিথ্যা মামলা করলে বাদীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনদিন পরে ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেছেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিহতের ঘটনায় মামলা নিয়ে বাণিজ্য হচ্ছে। ওই সব মামলায় আসামি হলেই গ্রেপ্তার কিংবা বাসায় বাসায় গিয়ে হয়রানি করা যাবে না। তদন্তে ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলেই কেবল আইনের আওতায় আনা যাবে। তাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি মামলা হবে। মামলা অপকর্মে জড়িত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে। এর আগে গত বছরের ১৬ই নভেম্বর রংপুরে জুলাই অভ্যুত্থানের পর মামলা বাণিজ্য নিয়ে প্রশ্নের জবাবে সারজিস আলম বলেন, ‘মামলা বাণিজ্য শুধু রংপুরে নয়, সারা বাংলাদেশে চলছে। আমরা আমাদের জায়গা থেকে কঠোরভাবে বলতে চাই, আমার শহীদ ও আহত ভাইদের নিয়ে মামলা বাণিজ্য চলবে না। মামলায় টাকা দিয়ে নাম দিচ্ছে, টাকা নিয়ে নাম কাটাচ্ছে, এই ব্যবসা থেকে সামগ্রিকভাবে সবাইকে বের হতে হবে। দেশে যখন ঢালাওভাবে মামলা বাণিজ্য শুরু হয় তখন গত বছরের ১৪ই অক্টোবর মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা দায়েরকারী ও অপতৎপরতাকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সবার অবগতির জন্য সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘সাম্প্রতিক সময়ে চাঁদাবাজি, ব্ল্যাকমেইলিংসহ নানা রকম হয়রানি করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ব্যক্তির বিরুদ্ধে হত্যা মামলাসহ বিভিন্ন ধরনের মিথ্যা মামলা দেয়া হচ্ছে। এ ধরনের উদ্দেশ্যমূলক মামলা দায়ের বাংলাদেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী ফৌজদারি অপরাধ। এসব কর্মকাণ্ডে জড়িতদের কঠোরভাবে হুঁশিয়ারি প্রদানসহ তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার নিমিত্তে সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে এরইমধ্যে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) কমিশনার হাসিব আজিজ এক বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, ‘সম্প্রতি সিএমপি’র বিভিন্ন থানায় হওয়া মামলায় অব্যাহতি পাওয়ার সুযোগ এবং আসামি করার হুমকি দিয়ে একটি চক্র টাকা আদায় করছে বলে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। মামলাগুলো পুলিশ সদর দপ্তর ও সিএমপি’র ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মাধ্যমে কয়েকটি স্তরে তদারকি করা হচ্ছে। তাই এসব মামলায় অন্যায় ও অনৈতিক সুবিধা নেয়ার সুযোগ নেই। এ ধরনের প্রতারক চক্রের অপতৎপরতা থেকে সতর্ক থাকার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে অনুরোধ করা হলো। ২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর নগরের বিভিন্ন থানায় শতাধিক মামলা দায়ের করা হয়। অনেক মামলায় চিহ্নিত অপরাধীরাও বাদী হয়েছেন। এসব মামলায় আসামি করা ও অব্যাহতি দেয়া নিয়ে বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে।