আমেরিকানরা ‘জাতে মাতাল, তালে হুঁশ’ জাতি। সুতরাং ট্রাম্পের বিষয়ে যারা আজকে আনন্দিত, সম্ভবত তাদের আনন্দ খুব শীঘ্রই বিষাদে পরিণত হবে। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নিয়ে ট্রাম্পের বক্তব্য অতিমাত্রায় হাস্যকর হলেও, এটা ট্রাম্প অনেকটা বাধ্য হয়েছেন ভারতীয় বংশোদ্ভুত আমেরিকানদের ভোট টানতে। তাছাড়াও আমেরিকার নির্বাচনে ফান্ডিং একটা বড় ফ্যাক্টর। আর রিপাবলিকানরা এমনিতেই একটু ইসলামোফোব। সবমিলিয়ে ট্রাম্প বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে টুইট করতেই পারেন। মানিকে মানিক চেনে ইসে চেনে কচু। ট্রাম্পের মোদিকে চেনা তাই অসম্ভব কিছু নয়।
যাকগে, আমেরিকার নির্বাচনে জরিপ অনুযায়ী কমালা হ্যারিস এগিয়ে আছেন। ব্যবধান একটু কমেছে কিন্তু কমালাই এখন পর্যন্ত এগিয়ে। রয়টার্স-ইপসোস জরিপ অনুযায়ী কমালার ৪৪ শতাংশ ও ট্রাম্পের সমর্থন ৪৩ শতাংশে। এক শতাংশ সমর্থনে এগিয়ে আছেন কমালা। বাইডেনের নাটকীয় প্রস্থানের পর, কমালার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করাটা অনেকটাই ডেমোক্র্যাটদের জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সবাই ধারণা করেছিলেন এই টুইস্টে ট্রাম্প এগিয়ে যাবেন। কিন্তু বিধি বাম, কমালাই মন জয় করলেন আমেরিকান মানুষের এবং সর্বশেষ জরিপও তাই বলছে।
কমালার প্রতি আমেরিকানদের এই সমর্থনের পেছনে রয়েছে চরমপন্থার প্রতি তাদের ভয় ও ঘৃণা। ট্রাম্প গেলে চরমপন্থার উত্থান ঘটতে পারে। ট্রাম্পের সমর্থকদের হোয়াইট হাউস আক্রমণের স্মৃতি এখনো বিস্মৃত হয়নি। ট্রাম্প মূলত চরমপন্থীদের পছন্দের। সেকারণেই ট্রাম্প ভারতের বিজেপি সরকারের পছন্দ। গতবার তো ট্রাম্পের পক্ষে প্রকাশ্যেই সমর্থন জানিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি। ভারতে পূজা-অর্চনাও হয়েছিল ট্রাম্পের নামে। সুতরাং ট্রাম্প হিন্দুত্ববাদী চরমপন্থীদের খুশি করতে চাইবেন এটাই স্বাভাবিক। আর সে কারণেই তিনি বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতীয় চরমপন্থী দল বিজেপির সুরেই কথা বলেছেন।
এদিকে আমেরিকার আগাম ভোটে এগিয়ে আছেন কমালা হ্যারিস। ডেমোক্র্যাটদের জন্য এটা একটা স্বস্তির খবর। তবে রিপাবলিকানরাও অখুশি নন। তারাও প্রচুর সংখ্যক ভোট পড়ায় খুশি। আমেরিকার নিবন্ধিত ভোটার ১৬ কোটি। এবার আগাম ভোট পড়েছে ৬ কোটির বেশি। এই ভোটে বড় ব্যবধানে এগিয়ে আছেন কমালা। তবে বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোর ক্ষেত্রে ‘উল্টো বুঝলিরে রাম অবস্থা’।
অনেক গণমাধ্যমের খবরে ট্রাম্পের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। কোনো কোনো গণমাধ্যমের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে পারলে তারাই ট্রাম্পকে জিতিয়ে দিয়ে আসে। অথচ, সারাবিশ্বের গণমাধ্যমে অনেকটাই বিপরীত সুর। তারা লড়াইটাকে জোরালো বললেও, কমালাকেই এগিয়ে রেখেছে। ভারতের বিজেপি সমর্থিত গণমাধ্যমগুলোও ট্রাম্পকে এগিয়ে রেখেছে। বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোর দিকে তাকালে তাদের ওপর প্রতিবেশী ভারতের প্রভাবটা টের পাওয়া যায়।
বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা একসময় ছিল না, যা ছিল তার পুরোটাই সরকার নিয়ন্ত্রিত। ফ্যাসিস্ট রেজিমে একটা কথা খুব প্রচলিত ছিল, ‘খুশিতে, ঠেলায়, ঘুরতে’। তেমনি ফ্যাসিস্ট রেজিমে বেশিরভাগ গণমাধ্যমই ‘খুশিতে’ সরকারের নিয়ন্ত্রণ মেনে নিয়েছে। আবার কিছু গণমাধ্যম মেনে নিয়েছে ‘ঠেলায়’। সেই ‘খুশিতে’ নিয়ন্ত্রণ মেনে নেওয়া গণমাধ্যমগুলোই এখন ট্রাম্পকে এগিয়ে রাখছে। তাদের ধারণা ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে হয়তো ফ্যাসিস্ট রেজিমের প্রত্যাবর্তন ঘটবে। আবার তারা মৌমাছির মতন গুঞ্জন তুলে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস কনফারেন্সে তেলাঞ্জলি দিতে যাবেন। আবার হয়তো হাজার কোটি টাকা, ডজন ডজন ফ্ল্যাট, টেলিভিশন ও প্রতিষ্ঠানের মালিক হতে পারবেন। তাদের আফসোসটা মূলত এসব সুযোগ হারানোর কারণেই। জুলাই বিপ্লবে গঠিত সরকারকে এ বিষয়গুলো ভেবে দেখতে হবে। স্বাধীনতার অর্থ যদি হয় পক্ষপাত তাহলে সে স্বাধীনতা মূল্যহীন।
যাকগে বলছিলাম, আমেরিকার নির্বাচন নিয়ে। প্রথমেই বলেছি আমেরিকানদের প্রবীণ যে অংশটা রয়েছে তারা মূলত কনজারভেটিভ অন্যার্থে চরমপন্থার সমর্থকও বলতে পারেন। এদের বেশিরভাগই হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট। তারা হোয়াইট সুপ্রিমেসিকে দর্শন জ্ঞান করেন। অনেকটা আমাদের এখানের ‘সেক্যুলারিস্ট’দের মতন। তারা নিজেদের সবার চেয়ে সুপ্রিম মনে করেন। তাদের কাছে তারাই জ্ঞানী, অন্যরা সব মূর্খ কিংবা নির্জ্ঞান। হ্যাঁ, আমাদের এখানের ‘সেক্যুলার’ অনেকটা চরমপন্থীই। তাদের কাছে কালেমাখচিত কালো পতাকা এক্সট্রিমিজমের আইকন কিন্তু সনাতনী লেখা গেরুয়া পতাকার ব্যাপারে তাদের কোনো ‘রা’ নেই। জুলাই বিপ্লবের আমরা প্রতিবাদ করেছিলাম কালেমাখচিত কালো পতাকার বিষয়ে। বলেছিলাম, এই পতাকা আইসিসের, আল কায়েদার। বাংলাদেশে যারা এটা প্রদর্শন করতে চান তাদের উদ্দেশ্য ভালো নয়, তারা একটা সাম্প্রদায়িক হানাহানি সৃষ্টি করতে চান। যে হানাহানি ফ্যাসিস্ট রেজিম প্রত্যাবর্তনের একমাত্র পথ।
চট্টগ্রামের স্বাধীনতা স্তম্ভে টানানো বাংলাদেশের পতাকার ওপর সনাতনী লেখা গেরুয়া পতাকা তোলা হয়েছে। কিন্তু আমাদের সেক্যুলারগণ এ ব্যাপারে ‘স্পিকটি নট’! উল্টোটা যদি হতো, জাতীয় পতাকার ওপর কালো পতাকা তোলা হতো, তাহলে তারা বিকট শব্দে হামলে পড়তেন। তাদের উল্লম্ফনে রাতদিন এক হয়ে যেত। যেমন হয়েছিল জাতীয় সঙ্গীত বিষয়ে।
একজন লোক, যিনি আয়নাঘরে বন্দি ছিলেন, তিনি জাতীয় সংগীতের ব্যাপারে একটা কথা বললেন তাই নিয়ে দেশ-বিদেশ এক করে ফেলা হলো। জাতীয় পতাকার নকশারে কৃতিত্ব নিয়েও দেশ-বিদেশ কম বিতর্ক হলো না। কিন্তু যখন জাতীয় পতাকার ওপর গেরুয়া পতাকা টানানো হলো তখন তাদের মুখ সেলাই হয়ে গেলো। ওই যে কেউ খুশিতে সেলাই করে, কেউ করে ঠেলায়। আমরা এতদিন ঠেলায় মুখ সেলাই করে রেখেছিলাম। তারা খুশিতে।
সাম্প্রদায়িক হানাহানির ব্যাপারটা ট্রাম্পেরও ভালো লাগে, অতীত অন্তত তাই বলে। সুতরাং গেরুয়া পতাকা, ভারতের অতিরঞ্জন এবং ট্রাম্পের টুইট এরমধ্যে একটা যোগসূত্র অবশ্যই রয়েছে। অনেকে বলছেন, সনাতনী নাম ব্যবহার করে যে আন্দোলন প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে, তার ডিজাইন অনেকটা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মতন। ধীরে ধীরে একত্র করার চেষ্টা করা হচ্ছে সনাতনীদের, সেই ছাত্র আন্দোলনের কায়দায়। কথাটা মিথ্যে নয়, নকশাটা একই।
তবে মুশকিল হলো কোটা আন্দোলন থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, তারপর একদফার আন্দোলন যে কারণে সফল হয়েছিল, সে কারণটা গেরুয়া আন্দোলনে অনুপস্থিত। একদিকে তারা সংখ্যায় কম, তার ওপর তাদের অভিযোগটা কৃত্রিম। যে কারণে দেশের বেশিরভাগ মানুষ বরং বিরূপ হবে এ আন্দোলনে। কারণ দেশের সিংহভাগ মানুষ অসাম্প্রদায়িক। তারা রাত জেগে মন্দির পাহারা দেয়। সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেয় সব ধর্ম-সম্প্রদায়ের মানুষের সাথে। এমন অবস্থায় তাদের দায়ী করা হলে, সে অংশের সমর্থন পাওয়া অসম্ভব ব্যাপার। চাপিয়ে দেওয়া, কৃত্রিম অভিযোগে যে আন্দোলন সেটা বরং ব্যাকফায়ার করার সম্ভাবনাই বেশি। সম্ভবত আমেরিকার নির্বাচনেও এমন ব্যাকফায়ারের ঘটনা ঘটবে। কমালার এগিয়ে থাকা তাই বলে।
সাম্প্রদায়িক হানাহানির চেষ্টা জুলাই বিপ্লবের পর থেকেই হয়ে আসছে। দেশের কোথাও ধর্মের কারণে ৫ আগস্টের পর কারও ওপর আক্রমণের ঘটনা ঘটেনি। যা ঘটেছে তার সবটাই রাজনৈতিক। সেটাকেই ক্যাশ করেছে বাংলাদেশের সোকল্ড সেক্যুলার ও ভারতের গদি মিডিয়া। রিপাবলিক টিভির ময়ূখ রঞ্জন ঘোষের মতন এক মোষের উল্লম্ফনই তার প্রমাণ। এর বিপরীতে আমাদের ফ্যাসিস্ট রেজিমে ‘খুশিতে’ থাকা মিডিয়াগুলো অনেকটাই নিশ্চুপ। সত্য প্রকাশের তাদের যেন কোনো দায় নেই।
অথচ সত্যের প্রকাশটাই স্বাধীন গণমাধ্যমের কাজ। কিন্তু যারা অধীনতা চায়, তাদের মূলত স্বাধীনতার প্রয়োজন নেই। এটাকে মর্ষকামীতাও বলতে পারেন। অন্যকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পাওয়া আর কী। হাজার হাজার মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়ে কাতরাচ্ছে আর তারা বলছেন আরও গুলি চালাতে। এই মর্ষকামীদের মূলত গণমাধ্যমের চেয়ে মানসিক রোগের হাসপাতালেই স্থান হওয়া উচিত ছিল। এই যে সাম্প্রদায়িক হানাহানি সৃষ্টির চেষ্টা তাতে লাভ হবে কার, হবে ফ্যাসিস্টদের, হবে হিন্দুত্ববাদী চরমপন্থীদের। কিন্তু সাধারণ যারা হিন্দু জনগোষ্ঠীর মানুষ, তারা পড়বেন বিপদে। মূলত তাদেরকে ব্যবহার করা হচ্ছে বলির পাঠা হিসেবে। স্রেফ তাদেরকে বলি দিয়ে ক্ষমতার মসনদ ফিরে পাবার নির্লজ্জ চেষ্টা।
এ প্রচেষ্টা সফল হবে না। ১৭ বছরের জমানো ক্ষোভ হয়তো প্রশমিত কিছুটা। কেউ কেউ ১৭ বছরের অপরাধ ক্ষমা করে দেওয়ার কথাও চিন্তা করছেন। কিন্তু প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে যদি হানাহানি উসকে দেওয়া হয়। সংখ্যায় বেশি মানুষদের অন্যায় অপবাদ দেওয়া হয়, তবে সম্ভবত তারাও রুখে দাঁড়াবে। জুলাই বিপ্লবের মতন কিংবা তারও বেশি ঐক্য দেখা দেবে মানুষের মধ্যে। বেশি ঐক্যের কথাটা একটু পরিষ্কার করি।
জুলাই বিপ্লবে হেফাজত কিংবা অন্য ইসলামি সংগঠনগুলোর সরাসরি অংশগ্রহণ ছিল না। ইসলামি দলগুলো হয়তো ছিল, কিন্তু যারা রাজনীতির বাইরে ইসলামি সংগঠন করেন, তাদের সক্রিয়তা সব জায়গায় দেখা যায়নি। এবার যদি ষড়যন্ত্র হয় তখন বাম-ডান-ইসলাম সব এক হয়ে যাবে। ফলে সঙ্গতই পিছু হঠতে হবে, ভারতীয় চরমপন্থার সমর্থকদের। চরমপন্থীদের মূলত কোনো জায়গা নেই, সে অনুযায়ী ট্রাম্পেরও নেই। আগাম জরিপ অন্তত তাই বলে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন