‘জামায়াতকে নিয়ে সরকার গড়ার চেষ্টা চালাতে পারে বিজেপি’
৯০টি আসন নিয়ে জম্মু ও কাশ্মীরের বিধানসভা। প্রথম দফায় বুধবার ২৪ আসনে ভোটগ্রহণ চলছে। সকাল ৭টা থেকে ভোটগ্রহণ শুরু হয়। এক দশক পরে আবার বিধানসভা ভোট হচ্ছে। নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও জামায়াতে ইসলামীর বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতা বা তাদের পরিবারের সদস্যরা অন্তত ১০-১২টি আসন থেকে প্রার্থী হয়েছেন, কাশ্মীরের একজন বিতর্কিত ও জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ ইঞ্জিনিয়ার রশিদের দল তাদের সমর্থনও করছে।
জামায়াতে ইসলামী এমন একটি সংগঠন- পাকিস্তান ও বাংলাদেশ-সহ দক্ষিণ এশিয়ার নানা প্রান্তেই যাদের সরব উপস্থিতি আছে। কাশ্মীরের জামায়াত অবশ্য আদর্শগত ও ঐতিহাসিকভাবে পাকিস্তানের জামায়াতেরই বেশি ঘনিষ্ঠ।
জামায়াত ১৯৮৭ সালে কাশ্মীরের বিধানসভার ভোটে শেষবারের মতো লড়েছিল। পর্যবেক্ষকরা বলেন, সেই ভোটে তাদের ভালো ফল করার সম্ভাবনা থাকলেও কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকারের মদতে নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি করে ফারুক আবদুল্লার ন্যাশনাল কনফারেন্সকে জিতিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
২০১৯-এ পুলওয়ামাতে যে জঙ্গি হামলায় ৪০ জনের বেশি ভারতীয় আধা সামরিক সেনা নিহত হয়, তারপর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জামায়াতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এর আগেও আবশ্য ১৯৭৫ ও ১৯৯০ সালে দু’দুবার জামায়াতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল।
কাশ্মীরে এবারের নির্বাচনে আর একটি বর্ণময় চরিত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন আওয়ামী ইত্তেহাদ পার্টির প্রধান ও শেইখ আবদুল রশিদ, যিনি গোটা রাজ্যে তার পুরনো পেশার কারণে ‘ইঞ্জিনিয়ার রশিদ’ নামেই বেশি পরিচিত।
২০১৭ সালে সন্ত্রাসবাদে অর্থায়নের একটি পুরনো মামলায় তিনি গত বেশ কয়েক বছর ধরে দিল্লির তিহার জেলে বন্দি ছিলেন।
অবশেষে গত সপ্তাহেই তিনি অন্তর্বর্তীকালীন জামিন পেয়েছেন এবং কাশ্মীরের নির্বাচনি প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন। তবে তার এই জামিন পাওয়া নিয়েও রাজনৈতিক বিতর্ক কম হয়নি।
মাসকয়েক আগে জেলের ভেতরে বন্দি অবস্থাতেই তিনি যেভাবে বারামুলা লোকসভা আসনে জিতে পার্লামেন্টে গেছেন, তা সারা দেশেই তাকে ব্যাপক পরিচিতি দিয়েছে।
বারামুলা সংসদীয় আসনে তিনি হারিয়েছিলেন ওমর আবদুল্লা ও সাজ্জাদ লোনের মতো রাজনৈতিকভাবে ওজনদার প্রার্থীদের।
অথচ জেলে থাকার কারণে ইঞ্জিনিয়ার রশিদ একদিনের জন্যও নির্বাচনি প্রচারণা চালাতে পারেনি, জেলবন্দি পিতার হয়ে তার ছেলেরাই পুরো প্রচারের কাজকর্ম দেখাশুনো করেছিলেন।
এহেন ইঞ্জিনিয়ার রশিদের দল এবারে নিজেরা রাজ্যের বেশ কতগুলো আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে – আর বাদবাকি আসনে তারা সমর্থন করছে জামায়াতের যে নেতারা ভোটে লড়ছেন, তাদের।
জামায়াতের সঙ্গে কেন জোট বেঁধেছেন, তার জন্য জোরালো সাফাই দিতেও কোনো ইতস্তত করছেন না ইঞ্জিনিয়ার রশিদ।
জামিন পাওয়ার পরে দেওয়া একাধিক সাক্ষাৎকারে তিনি দাবি করেছেন, ‘জামায়াতের সঙ্গে আমাদের বহু বিষয়ে মতপার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু আমাদের মধ্যে মিল একটাই – আমরা চাই একটি শান্তিপূর্ণ কাশ্মীর!’
কাশ্মীরের সামাজিক ও শিক্ষা খাতে জামায়াতের যে প্রভূত অবদান আছে, সে কথাও মনে করিয়ে দিচ্ছেন তিনি।
তিনি বলেছেন, ‘নাগাল্যান্ডের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যদি আলোচনা চালাতে পারে ও শত শত জঙ্গিকে আত্মসমর্পণ করাতে পারে, তাহলে জামায়াতের সঙ্গে আমরা জোট বাঁধলে অসুবিধা কোথায়?’
তবে ইঞ্জিনিয়ার রশিদ ও জামায়াতের এই ‘জোট’ নির্বাচনে কতটা ভালো ফল করবে, তা নিয়ে পর্যবেক্ষকদের মধ্যে দ্বিমত আছে।
রাজ্যের সাবেক পুলিশ প্রধান আলি মোহাম্মদ ওয়াতালির ধারণা, এ জোট অন্তত ১০-১২টা আসন পেতেই পারে এবং বিধানসভায় যদি কোনো দলই গরিষ্ঠতা না-পায়, সে ক্ষেত্রে বিজেপি জামায়াত ও ইঞ্জিনিয়ার রশিদের দলকে নিয়ে সরকার গড়ার চেষ্টা চালাতে পারে।
সাবেক ‘র’ প্রধান এ এস দুলাত অবশ্য বিশ্বাস করেন, ‘ভ্যালি’ বা কাশ্মীর উপত্যকায় জামায়াতের রাজনৈতিক সংগঠন তেমন শক্তিশালী নয় – তাদের পক্ষে দু’তিনটির বেশি আসন পাওয়াটা মুশকিল।
শ্রীনগর-ভিত্তিক সাংবাদিক ও গবেষক আকিব জাভেদ বলেছেন, ‘উত্তর কাশ্মীরের সোপোর আর দক্ষিণের পুলওয়ামা বা শোপিয়ানের মতো এলাকায় জামায়াত আসলে খুবই শক্তিশালী। তবে রাজ্যের প্রতিটি জেলাতেই তাদের ক্যাডার বেস আছে, এখন সেটাকে তারা কতটা ব্যালটে রূপান্তরিত করতে পারে সেটাই দেখার বিষয় হবে।’
অনেক পর্যবেক্ষকই আবার বলছেন, বিজেপি আসলে চাইছে রাজ্যে ‘বিজেপি-বিরোধী ভোট’ যত বেশি ভাগ হয় ততই তাদের জন্য সুবিধা – সে কারণেই জামায়াত বা ইঞ্জিনিয়ার রশিদের মতো শক্তিগুলোকে প্রচ্ছন্ন মদত দেওয়া হচ্ছে!
নির্বাচনের আরও যত আঙ্গিক
১৯৪৭-এ ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর থেকে জম্মু ও কাশ্মীরে এ পর্যন্ত মোট ১২টি বিধানসভা নির্বাচন হয়েছে। তবে এর মধ্যে বেশির ভাগ নির্বাচনেই সহিংসতা হয়েছে ব্যাপকভাবে, ভোটার উপস্থিতির হারও ছিল নগণ্য।
অতীতে নির্বাচনের সময় সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে বারবার হামলা চালিয়েছে, আবার নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠেছে তারা সাধারণ মানুষকে জোর করে পোলিং বুথে ধরে এনে ভোট দিতে বাধ্য করেছে।
১৯৯০র দশক থেকে কাশ্মীরের বহু রাজনৈতিক কর্মীও সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর হাতে অপহৃত বা খুন হয়েছেন।
তবে এবারের নির্বাচনের বড় একটি বৈশিষ্ট্য হল, কাশ্মীরের অনেক বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাও এই ভোটে অংশ নিচ্ছেন। ৯০ আসনের বিধানসভায় গরিষ্ঠতা পাওয়ার লক্ষ্যে ঝাঁপাচ্ছে মোট ১৩টি প্রধান রাজনৈতিক দল।
‘ভ্যালি’ বা কাশ্মীর উপত্যকায় চিরাচরিতভাবে প্রভাব বেশি দুটি আঞ্চলিক দলের – ওমর আবদুল্লার ন্যাশনাল কনফারেন্স ও মেহবুবা মুফতির পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টির। এরা দুজনেই এক সময় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন।
অন্য দিকে হিন্দু-প্রধান জম্মুতে লড়াইটা মূলত বিজেপি আর কংগ্রেসের মধ্যে। রাজ্য পর্যায়ে এবারে জোট হয়েছে কংগ্রেস আর ন্যাশনাল কনফারেন্সের মধ্যে।
নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রায় সব রাজনৈতিক দলই জম্মু ও কাশ্মীরের ‘পূর্ণ অঙ্গরাজ্যে’র মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে।
এখন ওই অঞ্চলটি একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে রয়েছে, যেখানে কেন্দ্রের নিযুক্ত একজন গভর্নরই প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদে আছেন।
বিজেপি ছাড়া সব দল ওই অঞ্চলের বিশেষ স্বীকৃতি ফিরিয়ে দেওয়ার কথাও বলছে – যদিও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার একাধিকবার জানিয়ে দিয়েছে তা আর কখনোই হওয়ার নয়!
রাজ্যের স্বশাসনের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি নাকচ করে দিলেও ভারতের শাসক দল বিজেপি অবশ্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, ‘নির্বাচনের পরে একটা উপযুক্ত সময় দেখে’ জম্মু ও কাশ্মীরের পূর্ণ অঙ্গরাজ্যের মর্যাদা পুনর্বহাল করা হবে।
তবে কাশ্মীরের বহু সাধারণ মানুষও সম্প্রতি বিবিসিকে বলেছেন, ৩৭০ ধারা ফিরিয়ে আনার কোনো ‘বাস্তবসম্মত সম্ভাবনা’ আছে বলে তারাও বিশ্বাস করেন না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কাশ্মীরি যুবক বিবিসিকে বলেন, আমরা এবারে ভোট দিতে যাচ্ছি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের ইস্যুগুলোর সমাধান হবে, এই আশায়। সার্বিকভাবে কাশ্মীর সংকটের সমাধান বা বিশেষ স্বীকৃতি বিলোপের সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই!
৩৮ বছরের জামির আহমেদ আবার বলছিলেন, বিশেষ স্বীকৃতি বিলোপ করাটা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু এর বিরুদ্ধে আমাদের যে প্রতিবাদ, সেটা আমরা ভোট দিয়েই রেজিস্টার করতে চাই!