ইকতেদার আহমেদ
দেশপ্রেম ও আত্মনির্ভরতা যেমন একটি অন্যটির পরিপূরক ও নিবিড় সম্পর্কযুক্ত; অনুরূপ স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বও নিবিড় সম্পর্কযুক্ত ও একটি অন্যটির পরিপূরক। দেশপ্রেম বলতে সহজ সরল ভাষায় আমরা যেটি বুঝি তা হলো নিজ দেশকে মনেপ্রাণে ভালোবাসা। এ ছাড়া নিজ দেশের স্বার্থ সব কিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দেয়া। আত্মনির্ভরতার অর্থ অন্যের ওপর নির্ভর না করে নিজ সহায়সম্বল দিয়ে পরিচালিত হওয়া। স্বাধীনতা হলো এক বা একাধিক জাতি সমন্বয়ে গঠিত একটি দেশ যার নিজস্ব শাসনব্যবস্থা দ্বারা দেশটির জনগণ শাসিত হবে। দেশটি তার ভূখণ্ডগত সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে চলবে। সার্বভৌমত্ব হলো একটি দেশের অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নির্ধারণের চূড়ান্ত ক্ষমতা। অন্য দেশের কোনোরূপ হস্তক্ষেপ ছাড়া কাজ করার পূর্ণ অধিকার ও ক্ষমতা সার্বভৌমত্বের প্রতীক। সার্বভৌমত্বের মাধ্যমে একটি দেশের স্বাতন্ত্র্য, স্বকীয়তা ও স্বাধীনতা বিকশিত হয়।
দেশের অন্য পরিভাষা হলো রাষ্ট্র। বর্তমান বিশ্বে জাতিসঙ্ঘভুক্ত দু’শতের কাছাকাছি রাষ্ট্র রয়েছে। আয়তনের দিক থেকে এর কোনোটি অতিক্ষুদ্র, কোনোটি ক্ষুদ্র, কোনোটি মাঝারি ও কোনোটি বৃহদাকার। মাঝারি ও বৃহদাকার রাষ্ট্রগুলোর সম্পূর্ণরূপে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার সুযোগ থাকলেও উৎপাদন খরচ, বৈদেশিক বাণিজ্য ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কে একটি রাষ্ট্রকে অন্য রাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল হতে হয়। অতিক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্রাকার রাষ্ট্রগুলোর পক্ষে আত্মনির্ভরশীল হওয়া প্রকৃত অর্থে দুরূহ। এরূপ রাষ্ট্রের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সম্পদ সীমিত। আবার কোনো কোনোটির জনসংখ্যা সীমিত কোনোটি জনবহুল।
একটি দেশ যখন তার চাহিদার সব পণ্য বা দ্রব্য উৎপন্ন করতে পারে না; তখন তাকে প্রতিবেশী দেশ বা নিজ অঞ্চলভুক্ত দেশ বা অঞ্চলবহির্ভূত দেশের উপর নির্ভর করতে হয়। বিশ্বের প্রতিটি দেশ সচেষ্ট থাকে যাতে নিজের চাহিদার পণ্যগুলো সাশ্রয়ীমূল্যে অন্য দেশ থেকে আমদানি করা যায়। অঞ্চলবহির্ভূত দূরবর্তী দেশ থেকে আমদানির ক্ষেত্রে পরিবহন খরচে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পায় যা প্রকারান্তরে আমদানিকৃত পণ্যের উচ্চমূল্যের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
এমন অনেক রাষ্ট্র রয়েছে পণ্য উৎপাদনে সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও বেশি উৎপাদন খরচে উৎপাদনের দিকে না গিয়ে এর বিকল্প হিসেবে আমদানির পথে অগ্রসর হয়। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, কানাডা, ব্রাজিল প্রভৃতি রাষ্ট্র আয়তনের দিক থেকে বৃহদাকার। এসব দেশের নিজ চাহিদার সব ধরনের কৃষি ও শিল্পপণ্য উৎপাদনের সক্ষমতা থাকলেও উৎপাদন ব্যয়ের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এরা কিছু পণ্য আমদানি করে থাকে।
আন্তর্জাতিক বাজারে একটি পণ্যের চাহিদা ও সরবরাহের উপর এর মূল্য নির্ভর করে। অনেক সময় দেখা যায়, বহু দেশ নৈকট্যের কারণে পরিবহন খরচ কম এটি বিবেচনায় পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দেয়। আবার অনেক সময় দেখা যায়, তাৎক্ষণিক চাহিদা মেটাতে দ্রুত পণ্যের জোগানের প্রয়োজন হলে আকস্মিক মূল্য বাড়িয়ে দেয়া হয়। এগুলো নৈতিকতার পরিপন্থী হলেও বন্ধুত্ব ও সুসম্পর্কের দাবিদার এমন অনেক দেশ উভয়ের উপর কালিমা লেপনে আকস্মিক অভ্যন্তরীণ ঘাটতির অলীক কাহিনীর অবতারণায় রফতানি বন্ধ করে দিয়ে বন্ধুপ্রতিম দেশকে বিপাকে ফেলে দেয়।
বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব দিকের সামান্য স্থল অংশ ছাড়া স্থলভাগের অন্য তিন দিক থেকে ভারত দ্বারা বেষ্টিত। বাংলাদেশের দক্ষিণে উন্মুক্ত বঙ্গোপসাগর হওয়ায় সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনে দেশটি কারো মুখাপেক্ষী নয়। বর্তমানে বাংলাদেশে ঘোষিত স্থলবন্দরের সংখ্যা ২৪টি। তবে ১২টি চালু রয়েছে। এর মধ্যে ১১টি বাংলাদেশ-ভারত স্থলবন্দর। অন্যটি বাংলাদেশ-মিয়ানমার স্থলবন্দর যেটিতে নৌপথে পণ্য পৌঁছে দেয়া হয়। তাছাড়া প্রস্তাবিত স্থলবন্দরের সংখ্যা দু’টি। উভয়টি বাংলাদেশ-ভারত স্থলবন্দর। স্থলবন্দরের মাধ্যমে পণ্য আমদানি বা রফতানিতে ট্রাক ব্যবহৃত হয়। ট্রাকে পণ্য ধারণক্ষমতা সীমিত হলেও স্বল্প দূরত্বে পণ্য পরিবহনমূল্য সাশ্রয়ী হয়।
চালু স্থলবন্দরগুলো দিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে কৃষি, শিল্প ও গবাদিপশু বিশেষত গরু আমদানি করা হয়। কৃষিপণ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো চাল, পেঁয়াজ, ফলমূল, টমেটো, এলাচ, ধনিয়া, গোলমরিচ, দারুচিনি, লং, তুলা ইত্যাদি। এ সব পণ্য ভারতে বিপুল উৎপন্ন হওয়ায় দেশটির চাহিদা মিটিয়ে রফতানির জন্য উদ্বৃত্ত থাকে। ভারতের যেকোনো রফতানিকারকের জন্য স্বল্প সময়ে পণ্য পৌঁছানোর সুযোগ থাকায় যেকোনো জিনিস সেখান থেকে বাংলাদেশে রফতানি সুবিধাজনক ও লাভজনক।
বাংলাদেশ যেসব কৃষিপণ্য ভারত থেকে আমদানি করে থাকে তা আমাদের কৃষিজমির স্বল্পতা সত্ত্বেও নিবিড় চাষাবাদ ও উন্নত জাতের বীজ ব্যবহারের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ চাহিদার সম্পূর্ণ মেটাতে সক্ষম। এসব বিষয়ে এযাবৎকাল পর্যন্ত বাংলাদেশ নজর না দিলেও সম্প্রতি ভারতের বৈরী আচরণে দৃষ্টি দেয়া অত্যাবশ্যক হয়ে দেখা দিয়েছে। পরপর গত দুই বছর ভারত আকস্মিক বাংলাদেশে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দিলে পেঁয়াজের দাম দুই শ’র কোটা ছাড়িয়ে যায়। পণ্যটির মূল্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে সরকার হন্যে হয়ে বিকল্প উৎস হতে পেঁয়াজ আমদানির ব্যবস্থা করে। বিকল্প উৎসগুলোর মধ্যে অন্যতম সার্কভুক্ত রাষ্ট্র পাকিস্তান, তুরস্ক ও মিসর, সীমান্তবর্তী বৈরী মিয়ানমার এবং চীন থেকে রাষ্ট্রীয় বিপণন সংস্থা টিসিবির মাধ্যমে পণ্যটি আমদানি করে সংস্থাটির উদ্যোগে জনসাধারণের মধ্যে বিক্রির ব্যবস্থা করা হয়।
আমদানির পরিমাণ পর্যাপ্ত হওয়ায় দেখা গেল দ্বিতীয়বার ভারতের আকস্মিক রফতানি বন্ধে বাংলাদেশের ভোক্তারা তেমন বিপর্যয়ে পড়েননি। টিসিবির খোলা ট্রাকে পণ্যটির প্রচুর সমাহার থাকলেও বর্তমানে দেখা যাচ্ছে ভোক্তারা পণ্যটির ক্রয়ে কোনো প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছেন না। বাংলাদেশে উৎপাদন ঘাটতির এসব পণ্য কৃষকদের মধ্যে আবাদের যে আগ্রহ দেখা দিয়েছে; তাতে আশা করা যায় আগামী দু-এক বছরের মধ্যে এসব পণ্যের আমদানির প্রয়োজন হবে না।
ছাদ কৃষি বাংলাদেশে ক্রমাগত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা শহর, উপজেলা শহর ও উপশহরে যে সংখ্যক ছাদসংবলিত আবাসিক ভবন রয়েছে; এগুলোর ছাদ কৃষির আওতায় আনা হলে একাধিক পরিবারের দৈনন্দিন শাকসবজির চাহিদা পূরণ সম্ভব। এমন অনেক মসলাজাতীয় পণ্য রয়েছে; যেগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও আমরা আমদানি করে চাহিদা মিটিয়ে আসছি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য এলাচ ও গোলমরিচ। অথচ আমরা প্রতিটি বাড়ির ছাদে কয়েকটি এলাচ ও গোলমরিচের গাছ লাগালে তা থেকে উৎপাদিত এলাচ ও গোলমরিচ দিয়ে একাধিক পরিবারের এই দু’টি মসলার সারা বছরের চাহিদা মেটানো যেতে পারে। ছাদ কৃষিতে বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে মাছ ও শাকসবজি একসাথে চাষ করা হচ্ছে। একুয়াফনিক্স নামক পদ্ধতিতে মাছের ব্যবহৃত পানি শাকসবজির উপর প্রয়োগ করা হয় এবং এতে অতিরিক্ত কোনো রাসায়নিক বা জৈবসারের প্রয়োজন পড়ে না।
আমাদের পার্শ্ববর্তী ভারত গরুর গোশত রফতানিতে বিশ্বে ব্রাজিলকে হটিয়ে বর্তমানে প্রথম স্থানে এসেছে। তবে ভারতে বিগত কয়েক বছর ধরে প্রকাশ্যে গরু জবাই এবং মুসলিম ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের গরুর গোশত খাওয়ার উপর অঘোষিত বিধিনিষেধ রয়েছে। এতে প্রায়ই গরু জবাই ও খাওয়া নিয়ে নারকীয় ঘটনার উদ্ভব হয়। অতীতে প্রতি বছর ভারত হতে বাংলাদেশে বিপুলসংখ্যক গরু রফতানি করা হতো। এর সংখ্যা ঈদুল আজহা অর্থাৎ কোরবানির ঈদের সময় বেড়ে যেত। ভারতে কট্টর হিন্দুত্ববাদী বিজেপি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর গরুর গোশত রফতানি অতীতের মতো অব্যাহত থাকলেও প্রকাশ্যে জবাই ও বাংলাদেশে রফতানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়।
ভারতের এ বিধিনিষেধ আরোপ পরবর্তী বাংলাদেশের কৃষকরা দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে গরু লালনপালনে গুরুত্বারোপ করেন। অনেক বেকার যুবকও এটিকে পেশা হিসেবে নিয়ে সফলতা পান। উদ্যোগটির ফলে বর্তমানে বাংলাদেশকে গরুর গোশতের চাহিদা এবং কোরবানির ঈদের সময় এই পশুটির চাহিদা পূরণে ভারতের দিকে চেয়ে থাকতে হয় না। আশা করা যায়, গরুর গোশত ও এর চাহিদা এবং পেঁয়াজের ঘাটতি মেটাতে বাংলাদেশের জনগণ দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে যে আত্মপ্রত্যয় জেগেছে তা আত্মনির্ভরতার ইঙ্গিতবাহী।
দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে ভারতের বাংলাদেশে রফতানি আমদানির চেয়ে ১০ গুণ বেশি। ভারতের অশুল্ক বাধা ও অ্যান্টিডাম্পিং ডিউটি আরোপে প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের রফতানি প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়। আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাথে ভারতের যে বিপুল ফারাক তা দূর করতে দেশটির সদিচ্ছার অভাব স্পষ্টত প্রতিভাত।
সার্ক একটি আঞ্চলিক জোট। জোটটি প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য হলো অঞ্চলভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ বাড়ানো। এই জোটভুক্ত প্রতিটি দেশ আন্তরিক হলে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নয়ন সম্ভব। নেপাল ও ভুটান ভারত দ্বারা স্থলবেষ্টিত হওয়ায় এ দেশ দু’টি ভারত ছাড়া অন্য কোনো দেশের সাথে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য করতে চাইলে দিল্লির শর্তের সম্মুখীন হতে হয়; যা দেশ দু’টির আমদানি ও রফতানিকারক দেশের জন্য স্বার্থের হানিকর হিসেবে দেখা দেয়। সার্ক প্রতিষ্ঠার পর প্রায় চার যুগের সময়কাল অতিবাহিত হলেও এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কিঞ্চিৎও অর্জিত হয়নি। আর তাই ভাবার সময় এসেছে কার কারণে সার্ক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনে ব্যর্থ। এমন বাস্তবতায় প্রয়োজন সমমতাদর্শের দেশগুলোর সামগ্রিক স্বার্থের বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে নিজ নিজ স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সুরক্ষায় সহযোগিতার নতুন ক্ষেত্রের উদ্ভাবন। যাতে প্রতিটি দেশ দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে আত্মনির্ভরতার পথে অগ্রসর হতে পারে।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক