‘নিশু’র মোবাইল একজন ফোন করে বলল, হ্যালো জান, কেমন আছ? তখনই বুঝতে পারলাম নিশু আরেকজনের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছে। নিশু আর আমার হবেনা সেটা আমি বুঝে গিয়েছিলাম। তারপরই তাকে খুন করব ঠিক করি। এখন মেরে ফেলেছি, জাস্ট একটু খারাপ লাগছে।’
নগরীর আগ্রাবাদে সিডিএ আবাসিক এলাকায় মা-মেয়েকে নৃশংসভাবে খুনের অভিযোগে গ্রেপ্তার আবু রায়হান (২৪) সাংবাদিকদের কাছে অকপটে বলেছেন এসব কথা।
বুধবার রায়হান ও তার সহযোগী শহীদকে গ্রেপ্তারের পর বৃহস্পতিবার সকালে সিএমপি কমিশনারের সম্মেলন কক্ষে তাদের সঙ্গে সাংবাদিকদের কথা হয়। এসময় এক সংবাদ সম্মেলনে সিএমপি কমিশনার মো.শফিকুল ইসলামও দু’জনকে জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য সাংবাদিকদের বলেন। সংবাদ সম্মেলনে নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) বনজ কুমার মজুমদার, অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক, অর্থ, প্রশাসন) মো.শহীদুর রহমান, উপ-কমিশনার (গোয়েন্দা) কুসুম দেওয়ান, অতিরিক্ত উপ কমিশনার (গোয়েন্দা) বাবুল আক্তার উপস্থিত ছিলেন।
গত ২৪ মার্চ সকালে নগরীর ডবলমুরিং থানার আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকার ১৭ নম্বর সড়কে যমুনা নামে একটি ভবনের চতুর্থ তলায় সিএণ্ডএফ ব্যবসায়ীর স্ত্রী রেজিয়া বেগম (৫০) এবং মেয়ে এসএসসি পরীক্ষার্থী সায়মা নাজনীন নিশাতকে (১৬) পায়ের রগ কেটে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
সম্পর্ক এক বছর ধরে
২০১৩ সালের মার্চে রায়হানদের দূরসম্পর্কের আত্মীয় ও নিশাতের বান্ধবী আনিকার কাছ থেকে নিশাতের মোবাইল নম্বর পায় রায়হান। সে নিশাতের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং নিজেকে ইউএসটিসি’র বিবিএ’র ছাত্র বলে পরিচয় দেয়। দু’জনের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে উঠে।
রায়হান বাংলানিউজকে জানায়, তারা দু’জন স্কুলের সামনে দেখা করত। হালিশহরের বিভিন্ন এলাকায়, ফয়’সলেক, খুলশী এলাকায় নিশাতকে নিয়ে বেড়াতে যেত রায়হান। সম্পর্কের এক পর্যায়ে নিশাতকে একটি মোবাইল এবং গ্রামীণ ফোনের সিম কিনে দেয় রায়হান। ওই নম্বরেই দু’জন কথা বলত।
শেষ দেখা ১২ মার্চ
রায়হান বাংলানিউজকে জানায়, এসএসসি পরীক্ষা শুরুর আগে থেকেই নিশাত ও রায়হানের মধ্যে যোগাযোগ কিছুটা কমে যায়। গত ১২ মার্চ তাদের মধ্যে শেষ দেখা হয়। ওইদিন বিকেলে নিশাত ও তার দু’বান্ধবী মিলে আগ্রাবাদে আক্তারুজ্জামান সেন্টারে বেড়াতে যায়। জানতে পেরে রায়হান সেখানে গিয়ে তাদের সঙ্গে দেখা করে।
রায়হান বাংলানিউজকে বলেন, ‘নিশু (নিশাত) আমাকে একটি স্যাণ্ডউইচ এবং একটি পারফিউম গিফট করে। স্যাণ্ডউইচ দিয়ে সে আমাকে বলেন, আমার পক্ষ থেকে তোমাকে দেয়া এটাই শেষ খাবার। আমি ভেবেছিলাম, সে ফান করছে। এরপর তার সঙ্গে আর দেখা হয়নি।’
রায়হান জানায়, ১৫ মার্চ থেকে নিশাতের পরিবর্তিত আচরণ তার কাছে স্পষ্ট হতে শুরু করে। ওইদিন নিশাত তাকে মোবাইলে একটি এসএমএস দিয়ে গ্রামীণ ফোনের একটি অফার সম্পর্কে জানতে চায়। রায়হান তাকে বলেন, তুমি গ্রামীণ ফোন ইউজ কর, তুমি কি অফার সম্পর্কে জাননা। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে সম্পর্কের প্রসঙ্গ উঠলে নিশাত তাকে জানায়, রায়হানের সঙ্গে সে আর সম্পর্ক রাখবে না। তাকে বলে, ‘তোমার সঙ্গে আমার হবেনা।’
এরপর ১৬ মার্চ থেকে নিশাতের সঙ্গে যোগাযোগ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। ১৭ মার্চ রায়হান সরাসরি নিশাতের বাসায় যায়। এসময় নিশাতের বাবা তাকে অপমান করে। ১৮ মার্চ নিশাত মোবাইল বন্ধ করে ফেলে।
১৯ মার্চ রায়হান নিশাতকে দেয়া তার সিমটি ব্লক করে নতুনভাবে সিমটি তুলে ফেলে। এরপর মোবাইল কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করে দেখতে পায় নিশাত অন্য একটি গ্রামীণ ফোনের নম্বরে প্রায়ই কথা বলে। এসময় রায়হান সিমটি চালু করার সঙ্গে সঙ্গে ওই গ্রামীণ নম্বর থেকে একটি ফোন আসে। বলে, ‘হ্যালো জান, কেমন আছ ? এতক্ষণে কেন ফোন অন করলা ?’
রায়হান বলেন, আমি কোন কথা না বলে চুপ করে থাকি। আমি নিশ্চিত হই নিশু আর আমার নেই। এরপর আমি নিশুকে একটা এসএমএস দিই। সে বুঝতে পারে, আমি তার সিম ব্লক করে নতুনভাবে সিম তুলেছি। পরে আমাকে একটা মিসকল দেয়। আমি ফোন করলে সে কেটে দিয়ে মোবাইল বন্ধ করে দেয়।
রায়হান বলেন, এরপরই আমি তাকে খুন করব ঠিক করি। আন্টিকে (নিশাতের মা) খুন করার পরিকল্পনা আমার ছিলনা। কিন্তু তিনি এসে বাধা দেয়ায় তাকেও খুন করি।
যেভাবে খুনের পরিকল্পনা ও হত্যাকাণ্ড
১৯ মার্চ ঢাকায় যাবার কথা বলে পুলিশ কর্মকর্তা আবুল বশরের ছেলে আবু রায়হান বাসা থেকে বের হয়। মায়ের কাছ থেকে নেয় ৩ হাজার টাকা। কিন্তু ঢাকায় না গিয়ে সে চলে যায় নগরীর খুলশীতে ক্রাউন রেসিডেন্সিয়াল গেস্ট হাউসে বন্ধু আতিকের কাছে।
রায়হান বাংলানিউজকে বলেন, মন খারাপ হওয়ায় আতিকের কাছে যাই। সেখানে শহীদের (গেস্ট হাউসের ড্রাইভার) সঙ্গে পরিচয় হয়। তাকে পুরো বিষয়টা জানাই। নিশাতকে খুন করার সিদ্ধান্তের কথা জানাই। তাকে ১০ হাজার টাকা দেয়ার কথা বললে সে রাজি হয়।
তবে এসময় শহীদ রায়হানের কথার প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, আমাকে খুন করার বিষয়ে কিছুই জানানো হয়নি। আমাকে বলা হয়েছে আলমিরায় বেশ দামি একটা জিনিস আছে। সেটা আনতে পারলে টাকা দেবে।
রায়হান জানায়, ২২ মার্চ রাতে অলংকার মোড়ে আলিম হোটেলে রায়হান এবং শহীদ মিলে পরিকল্পনা করে। সেখানে কামারের দোকান থেকে টোঁটা ও ছোরা কেনা হয়। শান্তিবাগ এলাকার অটোরিক্সা চালক রুবেলকে সকালে গাড়ি প্রস্তুত রাখার কথা বলে। তবে তাকে খুনের পরিকল্পনার বিষয়ে কিছুই জানানো হয়নি।
রায়হান জানায়, ২৪ মার্চ সকালে ছোটপুল থেকে রুবেলের অটোরিক্সা নিয়ে নিশাতের বাসার সামনে গিয়ে তারা অপেক্ষা করতে থাকে। পরিকল্পনা ছিল নিশাত বের হলে ছুরি মেরে তাকে খুন করবে। কিন্তু নিশাত বের হতে দেরি হওয়ায় দুজন বাসায় উঠে যায়। শহীদ কলিংবেল দিলে নিশাত ভেতর থেকে কে জিজ্ঞেস করে। শহীধ বলে, স্কুল থেকে সালমা ম্যাডাম পাঠিয়েছে।
তখন নিশাত দরজা খুলে দিলে রায়হান ভেতরে ঢুকতে চায়। এসময় নিশাত বাধা দিলে রায়হান তাকে ধাক্কা মেরে শহীদসহ ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। এর মধ্যে নিশাতের মা চলে আসেন। শহীদ নিশাতের মাকে নিয়ে ডাইনিং রুমে এবং রায়হান নিশাতকে নিয়ে ড্রইংরুমে চলে যায়।
বাঁচার জন্য কামড় দেয় নিশাত
রায়হান জানায়, ডাইনিং রুমে নিয়ে শহীদ প্রথমে নিশাতের মাকে ছুরিকাঘাত করে। এসময় নিশাত জোরে চিৎকার দিয়ে উঠে। নিজেকে বাঁচানোর জন্য অনেক অনুনয়-বিনয় করার চেষ্টা করে। কিন্তু রায়হান তার মুখ চেপে ধরে। বাঁচার জন্য নিশাত রায়হানের আঙ্গুলে জোরে কামড় দেয়। চিৎকার করে উঠে রায়হান। এসময় শহীদ গিয়ে নিশাতের পেটে ছুরি মেরে দেয়।
মা-মেয়ে দু’জনই মেঝেতে পড়ে কাতরাতে থাকে। এসময় রায়হান তার প্যান্টের উপর আরেকটি প্যান্ট পড়ে নেয়। শহীদ প্যাণ্ট খুলে ওই বাসা থেকে একটি লুঙ্গি খুলে নেয়। রায়হান আগেই বের হয়ে অটোরিক্সায় গিয়ে শহীদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। দু‘মিনিটের মাথায় শহীদও গিয়ে অটোরিক্সায় উঠলে তারা খুলশীর কৈবল্যধাম এলাকায় চলে যায়।
রায়হান জানায়, নিশাত ও তার মায়ের রগ কে কেটেছে সে দেখেনি। তবে শহীদ এ কথার প্রতিবাদ জানিয়ে বলে, আমরা যখন বের হচ্ছিলাম তখনও দুজনের সেন্স ছিল। সেজন্য রায়হান আমাকে রগ কেটে দিতে বললে আমি দুজনের পায়ে রগ কেটে দিই।
কেন ভাঙল দু’জনের সম্পর্ক ?
নিশাতের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হওয়ার পেছনে সাদামাটা যে বক্তব্য রায়হান দিয়েছে তা আংশিক সত্য বলে জানিয়েছেন নগর গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা।
তিনি বাংলানিউজকে জানান, সম্পর্কের এক পর্যায়ে নিশাত জেনে যায় রায়হান ইউএসটিসিতে পড়েনা। সে নামকাওয়াস্তে এসিসিএ নামে একটি কোর্সে ভর্তি হয়ে আছে। রায়হানের মিথ্যা বলা মেনে নিতে পারেনি নিশাত। আর সম্পর্কের এক পর্যায়ে নিশাত দেখতে পায়, রায়হানের চরিত্রও ভাল নয়। নিশাতের খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের, নিজের চেয়ে কমপক্ষে ২৫ বছরের বড় একজনের সঙ্গে রায়হান ‘গোপন সম্পর্ক’ গড়ে তুলে। খুলশীর ফয়’স লেক এলাকায় দারুচিনি নামের একটি রেস্টুরেন্টে তারা নিয়মিত দেখাসাক্ষাৎ করত।
নগর গোয়েন্দা পুলিশের ওই কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, নিজের কাছের মানুষের সঙ্গে রায়হানের সম্পর্ক, নৈতিকতাহীনতা মানতে পারেনি নিশাত। সেও মির্জা নামের আরেক ছেলের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ায়। অসম সম্পর্ক এক পর্যায়ে করুণ পরিণতি তৈরি করে।
‘মেরে ফেলেছি, খারাপ লাগছে’
আবু রায়হানের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, নিশাত ও তার মাকে হত্যার পর তার মধ্যে কোন অনুশোচনা তৈরি হয়েছে কিনা ?
খুবই নির্বিকার ভঙ্গিতে রায়হান বলেন, মেরে ফেলেছি, এটাই জাস্ট একটু খারাপ লাগছে। আর আণ্টিকে (নিশাতের মা) মারার কোন পরিকল্পনা ছিল না। এখন আদালতে যা হয়, সেটাই হবে।
তবে বেঁচে থাকলে নিশাত কোনদিন তার কাছে ফিরে আসত না বলে দাবি করে রায়হান।
যেভাবে ধরা পড়ে রায়হান-শহীদ
নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার বাবুল আক্তার বাংলানিউজকে জানান, হত্যাকাণ্ডের পরপরই নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে রায়হানের বিষয়ে অভিযোগ করা হয়। এতে মূলত তারা খুনী সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা পেয়ে যান। এরপর রায়হানের বাবা, মা, তিনজন বন্ধু ও নিশাতের বন্ধু মির্জাকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। তাদের কাছ থেকে সামগ্রিক তথ্য পান।
বাবুল আক্তার জানান, নিশাতের বাসার সামনে রাস্তায় অবস্থানকারী মঞ্জুর নামে বাকপ্রতিবন্ধী একজন দ্রুত রায়হান ও শহীদকে বের হয়ে যেতে দেখেন। প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে তাকে পেয়ে যায় নগর গোয়েন্দা পুলিশ। তাকে রায়হানের ছবি দেখালে সে শনাক্ত করে।
এরপর বিভিন্ন সূত্র থেকে নিশ্চিত হয়ে বুধবার রায়হানকে ঢাকার আরামবাগে একটি হোটেল থেকে এবং শহীদকে নগরীল মাষ্টার লেইন থেকে আটক করে নগর গোয়েন্দা পুলিশ। পরে তাদের স্বীকারোক্তি মোতাবেক নগরীর বিভিন্ন স্থান থেকে রক্তমাখ প্যাণ্ট, শার্ট উদ্ধার করা হয়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন