Image description
কোরআন ক্লাস থেকে অস্ত্র মামলায় জেলে
সেই সময় চলছিল শেখ হাসিনার উন্মত্ত শাসন। একদিন মসজিদের ইমামদের নিয়ে কোরআন ক্লাস পরিচালনা-সংক্রান্ত বিষয়ে আলাপ করছিলেন ড. মাওলানা খলিলুর রহমান মাদানী। সেখান থেকেই তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর চলে নির্যাতন। এভাবে বারবার নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তিনি। কোনো একটি মামলায় জেল খেটে জামিনে মুক্তি পেলেও নতুন করে গ্রেপ্তার-নির্যাতনের আতঙ্ক সব সময় তাকে তাড়া করত। তার পেছনে লেগে থাকত গোয়েন্দারা। শুধু তিনি একা নন, তার কারণে তার পরিবারও শিকার হয়েছে হাসিনা সরকারের নিপীড়নের। এমনকি গ্রামে তার ভাইরাও বাদ যাননি। এক ভাই জেল খেটে বের হলে আরেক ভাইকে গ্রেপ্তার করা হতো। তার ওপর হাসিনা সরকারের এত ক্ষোভের কারণ কী? সহযোদ্ধা আলেমরা বলছেন, দেশে ইসলাম ও ধর্মবিরোধী বিভিন্ন ইস্যুতে রাজপথে প্রতিবাদ-বিক্ষোভের পাশাপাশি আলেম-ওলামাদের ঐক্যবদ্ধ করার কাজেও বেশ সক্রিয় ছিলেন সম্মিলিত ওলামা-মাশায়েখ পরিষদের আহ্বায়ক মাওলানা খলিলুর রহমান। এসব ভূমিকার কারণে হাসিনা সরকারের ১৫ বছরে বানোয়াট মামলা, দফায় দফায় কারাবন্দি, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার নানা হয়রানিসহ চরম জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তিনি। তবে আলেমদের ওপর আওয়ামী লীগ সরকারের জুলুম-নিপীড়নের মধ্যেই সারা দেশের ইমাম-খতিবদের নিয়ে সাধ্যমতো কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন বাংলাদেশ মসজিদ মিশনের সেক্রেটারি জেনারেল তরুণ এই আলেম। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর পরিস্থিতি পুরো পাল্টে যাওয়ায় তিনি এখন মুক্ত নাগরিকের জীবনযাপন করছেন। তবে বিগত ১৫ বছরের সেই ভীতিকর পরিস্থিতির কথা স্মরণ করে এখনো আতকে ওঠেন মাওলানা খলিলুর রহমান। জুলুম-নিপীড়নের সেই দিনগুলোর কিছু কথা তিনি জানিয়েছেন আমার দেশকে। হাসিনা সরকারের সময় দেশের আলেম-ওলামাদের নির্যাতন প্রসঙ্গে রাজধানীর তামিরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসার নবনিযুক্ত প্রিন্সিপাল মাওলানা খলিলুর রহমান বলেন, ‘সে সময় সমস্ত মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলেন আলেমরা। তারা নিজ ঘরে শান্তিতে ঘুমাতে পারতেন না, প্রতিষ্ঠানে যেতে পারতেন না। তারা কুরআন তালিম ক্লাসে বসলেও জঙ্গি মিটিং বলে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বলা হতো-তারা রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। রাস্তাঘাট ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে যখন-তখন আটক করে ভুয়া মামলায় জড়ানো হতো। এমনকি মুসলিম বিশ্বের কোনো সংকট বা ইসলামি ইস্যুতে আলেমরা মিছিল করতে গেলেও পুলিশের বেপরোয়া লাঠিচার্জ, টিয়ারশেল নিক্ষেপ, গ্রেপ্তার, বানোয়াট মামলাসহ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন আলেমরা। ইসলাম ও দেশবিরোধী ইস্যুতে সোচ্চার থাকার কারণে দেশের শীর্ষ ও প্রবীণ আলেমদের জেল-জুলুমের শিকার হতে হয়েছে। বহু আলেম-ওলামা শহিদ হয়েছেন। অনেকে আহত হয়েছেন। শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে নিরীহ আলেম, মাদ্রাসাশিক্ষার্থী ও ধর্মপ্রাণ মানুষের ওপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্র্যাকডাউনের বিভৎসতা জাতি কোনোদিন ভুলবে না। ’ নিজের গ্রেপ্তার-নির্যাতনের দুঃসহ স্মৃতি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘২০১০ সালের ১০ জুলাই কুরআনবিরোধী নারী নীতি ও ইসলামবিরোধী শিক্ষানীতি সংশোধনের দাবিতে সম্মিলিত ওলামা-মাশায়েখ পরিষদের পক্ষ থেকে গণসমাবেশ ডাকা হয়েছিল পল্টনের স্টেডিয়ামে। কিন্তু পুলিশ আমাদের সমাবেশ করতে না দিয়ে ১৪৪ ধারা জারি করে। পরে আমরা মুক্তাঙ্গনে জড়ো হয়ে প্রেস ক্লাবের দিকে মিছিল নিয়ে গেলে সেখানে বাধা দেওয়া হয়। সেখান থেকেই পরের দিন হরতাল ঘোষণা করা হয়। আর সেই হরতালের পক্ষে মাঠে নামতেই পল্টন এলাকা থেকে মাওলানা আব্দুর রব ইউসূফীসহ কয়েকজন আলেমের সঙ্গে আমাকেও টেনেহিঁচড়ে পুলিশের গাড়িতে তুলে পল্টন থানায় নেওয়া হয়। সেখানে মিডিয়াকর্মীরা উপস্থিত হলে আমাকে পুলিশ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সারা দিন চিকিৎসা দিয়ে আবার থানায় নিয়ে এসে সন্ধ্যার পর ছেড়ে দেয় পুলিশ।’ ২০১৭ সালে দ্বিতীয়বার গ্রেপ্তার করা হয় মাওলানা খলিলুর রহমানকে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ঢাকায় কুরআন ক্লাস পরিচালনা-সংক্রান্ত বিষয়ে একটি ঘরোয়া বৈঠক চলাকালে কদমতলী থানা পুলিশ আমাদের ঘেরাও করে। তখন বেশ কয়েকজন আলেম ও ইসলামি দলের শীর্ষ নেতাকে অন্যায়ভাবে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। আমাদের বিরুদ্ধে দেশীয় অস্ত্র ও বিস্ফোরক দ্রব্য উদ্ধার সংক্রান্ত বানোয়াট মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়।’ আলামত হিসেবে দেখানো হয় আমাদের কাছে থাকা মোবাইল ফোনকে। রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের নামে হয়রানির শিকার হই আমরা। তবে আদালতে আমাদের বিরুদ্ধে আনা পুলিশের অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। প্রায় দুই মাস অন্যায়ভাবে জেল খাটার পর জামিনে মুক্তির সময় আমাদের রিঅ্যারেস্ট দেখায় পুলিশ। যদিও নতুন মামলায় যে সময়ের কথা বলা হয় তখন আমি হজে ছিলাম। তাই একদিনের পর আমরা মুক্তি পাই। তিনি বলেন, ‘জামিনে মুক্তি পেলেও গ্রেপ্তার-নির্যাতনের আতঙ্ক আমার পিছু ছাড়েনি। সব সময় আমার পেছনে গোয়েন্দারা নজরদারি করতো। বাসা-অফিস সবখানেই পুলিশের আনাগোনা থাকতো।’ ad পরের বছর ২০১৮ সালে বরিশালে মসজিদ মিশনের একটি মিটিং থেকে একইভাবে গ্রেপ্তার হন মাওলানা খলিলুর রহমান। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মসজিদ মিশনের আঞ্চলিক নেতাদের নিয়ে একটি বৈঠক চলাকালে পুলিশ আমাদের আটক করে। পরে সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা ও গুদামে হামলার পরিকল্পনা-সংক্রান্ত একটি বানোয়াট মামলায় কারাগারে পাঠানো হয় আমাকে। সেবারও বিনা অপরাধে প্রায় দুই মাস জেলে কাটাতে হয়। এর মাঝে ছয় দিন রিমান্ডের নামে হয়রানির করা হয়। এ সময় থানায় অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ও হুমকি-ধমকি দেওয়া হয়। আর এই কাজে নেতৃত্ব দেওয়া পুলিশের দারোগা আরাফাত পরে জুলাই আন্দোলনে যাত্রাবাড়ী এলাকায় শিক্ষার্থী হত্যা ও লাশ পোড়ানোর ঘটনায় জড়িত ছিলেন বলে জানতে পারি।’ শুধু নিজেই জেল-জুলুমের শিকার হননি মাওলানা খলিলুর রহমান মাদানী। তার পরিবারেও নেমে আসে অত্যাচার-নির্যাতন। সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘গ্রামে আমার ভাইয়েরা কেউ বাড়িতে থাকতে পারতেন না। এক ভাই জেল খেটে বের হলে আরেকজনকে নেওয়া হতো। আমার বাবা-মা নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন। ঢাকায় আমার বাসায় পুলিশ দফায় দফায় হানা দিয়েছে। বিশেষ করে কোনো আলেম গ্রেপ্তার হওয়ার পর আমার সঙ্গে সম্পর্ক থাকার কথা বললেই পুলিশ আমার বাসায় গিয়ে তছনছ করেছে। মাঝে মাঝে যৌথ বাহিনী আমার বাসা গিয়ে সারা রাত বসে থাকতো। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ নিতো। আমার পরিবারের সদস্যদের মোবাইল নিয়ে যেত। আমার স্ত্রী-সন্তানরা অনেকটা জিম্মি হয়েছিল।’ আওয়ামী লীগ সরকারের ইসলামবিরোধী ভূমিকা প্রসঙ্গে মাওলানা খলিলুর রহমান বলেন, ‘ইসলাম ও দেশের আলেম-ওলামাদের প্রতি শেখ হাসিনার সরকার দরদের কথা বললেও বাস্তবে ইসলাম চর্চা ও ধর্মীয় শিক্ষা নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। নানা বাধা-বিঘ্নের শিকার হয়েছেন আলেম-ওলামা ও মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা। ইসলামি আন্দোলন ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের হেয় করার কৌশল হিসেবে আলেম-ওলামা, মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের জঙ্গি বা ধর্মান্ধ বলে অভিযোগ করা হতো। মূলত, এ দেশে ইসলামের দাওয়াতি কাজকে বাধাগ্রস্ত করতেই দুশমনরা এসব বাধা-বিঘ্ন সৃষ্টি করতো। দুঃখের বিষয় হলো এসব কর্মকাণ্ডে নামধারী কিছু আলেম-ওলামা আওয়ামী লীগ সরকারের সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন।’ সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার জয়নগর গ্রামে ১৯৭২ সালে জন্মগ্রহণ করেন মাওলানা খলিলুর রহমান। তিনি ফাজিল ও কামিল পাস করেন তামিরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসা থেকে। এরপর সৌদি আরবের মদিনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স করে দেশে ফিরে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। খুলনা নেছারিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতা শুরু করলেও পরে যোগ দেন আশুলিয়ার তামিরুল মিল্লাত মাদ্রাসায়। সেখানে ভাইস প্রিন্সিপাল পদে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালনের পর সম্প্রতি প্রিন্সিপাল হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। বর্তমান জীবনযাত্রা প্রসঙ্গে মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে তিনি বলেন, ‘গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জালেম ও ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের পর দেশের পরিস্থিতি পুরো পাল্টে গেছে। এখন আল্লাহর রহমতে আমাদের চলাফেরা ও কাজকর্মে কোনো বাধা-বিঘ্ন নেই। অফিস ও বাসায় নেই পুলিশ ও গোয়েন্দা হয়রানি। স্বস্তিতেই দিন কাটাতে পারছি।’ মাওলানা খলিলুর রহমানের ওপর নির্যাতন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব ও খেলাফত আন্দোলনের নায়েবে আমির মাওলানা মুজিবুর রহমান হামিদী বলেন, আলেম-ওলামাদের বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে পুলিশি হয়রানিসহ নানা জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তিনি।